সন ২০১৮, রাজস্থানে সমাবেশ। বক্তা অমিত শাহ। তিনি বলেছিলেন, ‘‘অম্ল-মিষ্ট, সত্য-মিথ্যা, যে কোনও বার্তা আমরা চাইলে জনগণকে দিতে পারি। আমরা পারি, কারণ আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলোতে ৩২ লাখ সদস্য আছেন।’’
সন ২০২৩, কর্নাটকে সমাবেশ, বক্তা জে পি নাড্ডা। তিনি বলেছিলেন, ‘‘মোদিজির চেয়ে মহান কোনও প্রধানমন্ত্রী ভারতের ইতিহাসে আসেননি। তিনি রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ থামিয়ে ইউক্রেন থেকে ২২,৫০০ ভারতীয় ছাত্রকে দেশে ফিরিয়ে আনেন।’’ এর অন্য অনেকে এমন দাবি করেছিল, তখন সেগুলো উড়িয়ে দিয়েছিল, অন্য কোনও বিদেশি সংস্থা নয়, ভারতের বিদেশ মন্ত্রক।
যখন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শাসক দলের সভাপতির ট্র্যাক রেকর্ড এরকম, তখন সম্প্রতি দেশের সরকার তথ্য-প্রযুক্তি আইনে যে রদবদল আনতে উৎসাহী, সেই ব্যাপারে সন্দেহের সংশয়ের অবকাশ আছে বইকি। তথ্য-প্রযুক্তি আইনের এই সংশোধনী অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকার ভুয়ো, মিথ্যা, (Fake News) বিভ্রান্তিকর খবরগুলো চিহ্নিত করে সত্য তথ্যের তল্লাশ চালাবে।
আরে বাবা, দেশে ৫০ কোটি হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারী আছে। ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩০ কোটি। এঁদের সুবাদে ভারত দেশটা স্বয়ং বিশ্বে সর্ববৃহৎ তথ্যানুসন্ধানী সংস্থা। আন্তর্জাতিক শংসাপত্রসম্পন্ন ১১টি এরকম সংস্থা এদেশে কাজ করে।
আরও পড়ুন- আগুনের উৎস খুঁজে বার করবে ড্রোন
একদিক দিয়ে দেখতে গেলে তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই করাটা এখন একটা ব্যবসায়ে পরিণত হয়েছে। একটি সংস্থা কতগুলো তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই বাছাই করল, সেটাই সবাই বিচার করে সেই যাচাই প্রক্রিয়ার মান নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। মেট্রো শহরগুলোতে এখন লোকে গড়ে দিনে ঘণ্টা দুয়েক ব্যয় করে তাদের মোবাইল ফোনের তথ্যগুলোর সত্যাসত্য যাচাই করতে। যারা মোবাইল ফোনে ওই তথ্যগুলো পাঠায়, তারা বুঝে গিয়েছে যত বেশি তথ্য, সে সত্যি হোক বা ভুয়ো, তারা পাঠাতে পারবে, তত বেশি অর্থ তারা রোজগার করতে পারবে।
রাজনীতিকদের এই সত্যাসত্য যাচাই নিয়ে উদ্বেগ আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ‘মেটা’র প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকেরবার্গ বহুবার বলেছেন, প্রতিটি তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই করার মতো সময় কিংবা লোকবল তাঁদের নেই। এ-নিয়ে তাঁদের বিশেষ মাথাব্যথাও নেই, কারণ রাজনীতিবিদেরা ‘ওভার স্ক্রুটিনাইজড’ হন। সোজা কথায়, সুদূর সানফ্রান্সিসকোতে বসে ভারতের মতো দেশের সমাজ-অর্থনীতির টানাপোড়েনে জড়িয়ে পড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তাঁদের আছে বলে মনে হয় না।
যখন নীতিগতভাবে ফেসবুক তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, তখন তথ্যানুসন্ধানকারী সংস্থাগুলো এ-কাজ করতে আদৌ উৎসাহী নয়, সেটাও সহজেই অনুভববেদ্য। সবাই প্রায় জানে ফেসবুকের তথ্য যাচাইকারী কার্যক্রমের অংশীদার বিজেপির তৈরি ভুয়ো খবর যাচাই করার কষ্ট স্বীকার করে না। সেজন্যই বিজেপির কুখ্যাত আইটি সেল বারবার ভুয়ো খবর ছড়িয়েও পার পেয়ে যায়। বিজেপি ট্রোল করার জন্য ভাড়াটে বাহিনী নিয়োগ করে নিজেদের ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে।
যদি মোদি সরকার সত্যি সত্যি এই ভ্রান্ত খবর ছড়ানোর সমস্যা মোকাবিলা করতে চাইত তবে ২০১৭-তে প্রতিষ্ঠিত অল্ট নিউজ তথ্যানুসন্ধানের জন্য কী পদক্ষেপ করা উচিত তা ঠিক করে ফেলত।
তথ্যে গরমিল ঠেকানোর ক্ষেত্রে সমস্যা মূলত দ্বিবিধ। এক, তথ্য প্রদানকারী সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং শিক্ষার হার। এই দুটো ক্ষেত্রেই আমাদের পিছিয়ে থাকাটা এ-সংক্রান্ত তাবৎ সমস্যার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত।
ছেলেধরা নিয়ে হোক বা কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে হোক, কিংবা গোমাংস ভক্ষণ নিয়ে হোক, মিথ্যা গুজব আমাদের দেশে সাম্প্রতিক অতীতে বহু নিরীহ প্রাণের বলিদানের কারণ হয়েছে। বছরের প্রায় প্রত্যেক দিন, মিথ্যা গুজবের জেরে প্রাণহানির সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে রোজ সিঁটিয়ে থাকেন। এই গুজবগুলো মূল ধারার প্রচারমাধ্যম এবং সমাজমাধ্যমের অনৈতিক গাঁটবন্ধনের জেরে সৃষ্টি হয়। এমন বিদ্বেষবিষে আচ্ছন্ন পরিবেশে ঘৃণা-অপরাধ, বেআইনি গ্রেফতার ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে কোনও বিশেষ গোষ্ঠীকে বাদ দেওয়ার প্রবণতা প্রশ্রয় পায়।
অল্ট নিউজ নিজেদের প্রধান দফতর গুজরাট থেকে কলকাতায় সরিয়ে নিয়েছে। কারণ, তারা বিদ্যালয়স্তর থেকে ছাত্রছাত্রীদের ভুয়ো খবরের (Fake News) বিরুদ্ধে সচেতন করে তুলতে চায়। ভারতীয় জঞ্জাল পার্টির পাঠশালা তাই এ-সবের মোকাবিলায় তথ্য- প্রযুক্তি আইনে সংশোধনে আগ্রহী। এই সংশোধনীতে তথ্যপ্রবাহে জোয়ার আটকিয়ে ভাটা-সৃষ্টির সম্ভাবনা প্রায় ১০০ শতাংশ।
অতএব, সাধু সাবধান!