পৃথিবীতে যা-কিছু শ্রেষ্ঠ-পাওয়া, হৃদয়-জুড়ে-পাওয়া, মন-ভরে-পাওয়া, জীবন-সার্থক-করে-পাওয়া, তা কেন এত ক্ষণস্থায়ী, এসেই ফুরিয়ে যায়? এই যে আমাদের সারা বছর অপেক্ষা করে থাকা, ঘরের মেয়ে কবে ফিরবে ঘরে, সেই প্রতীক্ষা কত দুঃখ-কষ্ট, প্রত্যাশা-হতাশার অনন্ত সরণি পেরিয়ে ঘরের মেয়েকে ঘরে পায় বটে, কিন্তু সে ঘরে ফিরতে-না-ফিরতেই তার চলে যাওয়ার সময়ও চলে আসে। কেন স্বাগত-বিদায় এত পিঠোপিঠি, এত গায়ে-গায়ে?
যত বয়েস বাড়ছে, যত এসে পৌঁছচ্ছি জীবনপ্রান্তে, যত ঘনিয়ে আসছে আমারও বিদায়ের সময় এবং যত ভালবাসছি এই পৃথিবী এবং বেঁচে-থাকাকে, ততই যেন দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও ক্ষণস্থায়ী পাওয়ার তাৎপর্য ও পরম অর্থটি ধরতে পারছি। ততই মনে হচ্ছে, ভবিষ্যৎ যত ছোট হয়ে আসছে, ততই যেন তাকে আঁকড়ে ধরছে মন! পিছন ফিরে তাকালে, অতীত কী দীর্ঘ! সামনে তাকালে ভবিষ্যৎ কী ক্ষুদ্র! আর মনের মধ্যে জাগছে এই প্রমা ও প্রার্থনা, যেন এখনও অপেক্ষমাণ ক্ষুদ্র ভবিষ্যৎটুকুর তলানি পর্যন্ত পান করতে পারি প্রাণভরে!
পৃথিবীর আর কোনও দেশ, আর কোনও ধর্ম, আর কোনও বিশ্বাস, দর্শন বা প্রেম প্রিয় মানুষটির জন্য দিন গোনা অপেক্ষাকে করে তুলতে পারেনি উদ্বুদ্ধ উন্মুখ উৎসব!
এই আশ্চর্য কাজটি করতে পেরেছে শুধুমাত্র বাঙালির ভালবাসা, বাঙালির সামাজিক পরিবেশ ও পরিবহ, বাঙালির কন্যাপ্রীতি। বাঙালি তার ঘরের মেয়েকে যত প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, যেভাবে সেই মেয়েকেই করে তোলে তার ঘরের কন্যাশ্রী, তার সংসারের লক্ষ্মীশ্রী, তার যাপনের শ্রেয়সী, তার জীবনের মধুশ্রী সেভাবে ঘরের মেয়ে আর কোনও সমাজে, আর কোনও ভিনদেশের কন্যাদর্শনে উদযাপিত হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
বাঙালির ঘরের মেয়ের নাম যাই হোক, কখনও ইন্দিরা, কখনও সপ্তমী কিংবা নবমী, কখনও সেকেলে রোহিণী কিংবা একেলে রিমঝিম, বাঙালির সব ঘরের মেয়ের নামই কিন্তু শেষ পর্যন্ত উমা (Goddess Durga)। উমা নামের কাছ থেকে পালাবার পথ নেই তার। এমনকী অমঙ্গল-নাশিনী দুর্গা যখন হয়ে ওঠেন বাঙালির ঘরের মেয়ে, শ্বশুরবাড়ি বা স্বামীর গৃহ থেকে সে বাড়ি ফেরে, তখন সেই দুর্গাও কিন্তু আটপৌরে উমা। তার যত কাছেই বিয়ে হোক না কেন, মেয়েটি যখন বাঙালি বাবা-মাকে ছেড়ে স্বামীর ঘর করতে যায়, তখন বাঙালি বাপ-মা গিরিরাজ আর মেনকা, মেয়েকে বিদায়-জানাতে তাদের বুক ফাটে। তাদের দিনগোনা শুরু হয়, কবে বাড়ি ফিরবে উমা (Goddess Durga)।
আরও পড়ুন-তুষারধসে দ্বিতীয় এভারেস্টজয়ী মহিলা পর্বতারোহীর মৃত্যু
এই দ্রুতির যুগে উমার পক্ষে দূরে যাওয়া, প্রায় অসম্ভব। অন্তত আপাতভাবে। উমা যদি বিয়ে করে আমেরিকাতেও চলে যায়, তাহলেও বাপ-মা-র সঙ্গে তার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একেবারেই সম্ভব নয়। হোয়াটসঅ্যাপ-কল, ভিডিও-কল, ফেসবুক, ইনস্ট্রাগ্রাম ইত্যাদি তাকে বাপেরবাড়ি ছুট্ হতে দেবে না কখনওই। এ-কথা যেমন সত্য, তেমনি এ-কথাও সত্য যে এই অবিশ্বাস্য গতি, প্রসারিত সংযোগ ব্যবস্থা এবং অহরহ মোবাইল-চর্চিত পৃথিবীতে তবু থেকে গেছে আদিম, প্রাচীন, চিরায়ত মন যেমন আমাদের প্রতিটি ঘরের মেয়ে উমার জন্য। দুর্গাপুজো তাই বাঙালি বাড়ির কন্যাশ্রীটির জন্য মনকেমনের উৎসব। তার কিছুদিনের জন্য বাপের বাড়িতে ফিরে আসার উৎসব। তাকে আদরে জড়িয়ে ধরে ঘরে তোলার উৎসব। এবং এই উৎসবে মিশে থাকে বিজয়া ও বিদায়-বেদনার অন্তর্স্রোত, তাও অস্বীকার করার উপায় নেই।
বাঙালির মেয়ের এই বাপের বাড়ি ফেরার উৎসব ক্রমশ পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি একটি সত্যকথা জানিয়ে গেল নিঃসন্দেহে। ঘরের মেয়ের প্রতি বাঙালির আবেগ সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে নতুন এক কন্যাদর্শনের জন্ম দিল। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দেহাতীত ভাবে এই নব কন্যাশ্রী-দর্শনের প্রাণন। তিনি দুর্গাপুজোর অন্তর আবেগকে নতুনভাবে, নব দ্যোতনায় প্রতিষ্ঠিত ও প্রসারিত করলেন বঙ্গদেশে। আমাদের ঘরের মেয়ে উমা আন্তর্জাতিক আদর ও সোহাগ পেল। বাঙালির কাছে এ-গর্ব খুব কম কথা নয় কিন্তু!
শ্রীরামচন্দ্র দুর্গাশক্তিকে জাগ্রত করেছিলেন রাবণ নামের অশুভ শক্তিকে নাশ করার জন্য। সেই বোধন কিন্তু বাঙালির মননে ও কল্পনায় রূপান্তরিত উমা-উৎসবে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কন্যাশ্রী উৎসব আমাদের এই উমা-উপাসনা, উমা-সোহাগ এবং উমা-দর্শন। উমা-দর্শন ছাড়া উমার বাপের বাড়ি ফেরাকে এমন বিপুল উৎসবে শান্তায়িত করা সম্ভব হত না। এবার কলকাতার একটি বারোয়ারি পুজোয় (নলিন সরকার স্ট্রিট) দুর্গাপুজোর বদলে আক্ষরিক অর্থেই উমাপুজো দেখলাম। উমার হাতে কোনও বর্শা নেই। তার পায়ের কাছে পড়ে নেই কোনও বর্শা-বিক্ষত অসুর। উমা বাপের বাড়ি ফেরার পথে কোনও যুদ্ধ করেছে বলেও মনে হল না। সেই একটি অতি সাধারণ বাঙালি স্বামীর একেবারে আটপৌরে শাড়ি পরা ঘরের বউ। সে যেন এই মাত্র এসে দাঁড়িয়েছে তার বাপের বাড়ির দরজায়। দুই ছেলে আর দুই মেয়েকে নিয়ে। উমার চোখে কিন্তু তার বাড়ি ফেরার আনন্দ উদযাপিত হয়েছে, এমনই উজ্জ্বল আলো তার আঁখিপাতে। কী জানি কেন, মনে হল আমার, এই উমার মধ্যে আমি দেখতে পেলাম ভবিষ্যতে বাঙালির ঘরে ঘরে এই সোহাগী চাঁদবদনী উমারই শারদ প্রত্যাবর্তন! বাঙালি যত আধুনিক হবে তার ভাবনায় ও যাপনে, যত প্রসারিত হবে তার সাফল্যে ও কৌশলে, তার কর্মে ও বুদ্ধিমত্তায়, ততই বাঙালি ঋণীবোধ করবে উমাশক্তির কাছে। আমাদের ঘরেরে মেয়েই হয়ে উঠবে আমাদের চালিকা শক্তির উৎস। ‘উমা’, এই ঘরোয়া নামের মধ্যে ধরা রইল অসীম নারীশক্তির জাগৃতি ও স্বীকৃতি! ‘উমা’ই ধরণীর আল্টিমেট নারীশ্রী।
আমাদের ছোটবেলায় দুর্গাপ্রতিমার সামনে মেয়েদের সিঁদুরখেলার মধ্যে একটি মধুর রস থাকত বটে। কিন্তু সেই মধুর রসে একটি বিষণ্ণতা, একটি তির্ষক বিভাজনও থাকত। কারণ এই সিঁদুরখেলা-উৎসব শুধুমাত্র সধবাদের জন্য। বিধবা ও কুমারীদের কোনও স্থান নেই এই উৎসবে। এই বিভাজন কিন্তু বিজয়ার আনুষ্ঠানিক একটি পরিসর থেকে কুমারী ও বিধবা মেয়েদের সরিয়ে রেখেছে। বিশেষ করে বিধবানারী বিজয়ার দিনে বিশেষভাবে একা বোধ করতে পারেন এই বিভাজনের কারণে।
বিজয়ার দিনে ঘরের মেয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে স্বামীগৃহে। বাপের বাড়িতে আবার শুরু হবে তার জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা এবং দিন গোনা। কবে বাড়ি ফিরবে উমা (Goddess Durga)? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উমার বাড়ি ফেরাকেও এক বিপুল উৎসব বা কার্নিভালে পরিণত করেছেন। সেই কার্নিভালের হৃদয়বার্তা হল, প্রতি প্রত্যাবর্তনে উমার শক্তি, সাফল্য, উজ্জ্বলতাও প্রাণিধান হয়ে উঠছে আরও প্রসারী, আরও প্রতিভাত। কার্নিভাল শব্দটির মধ্যে ধৃত আছে উদযাপনের দ্যোতনা। কীসের এই বর্ণময় উদযাপন?
আমাদের ঘরের মেয়ে অনন্য উমার (Goddess Durga) স্বাগত-বিদায়ের!
উমা, নির্বিঘ্নে ফিরে এসো আবার। যোগাযোগ রেখো আমাদের আলোয়, আঁধারে, আমাদের আনন্দে, আমার বিষাদে।