মৃতকোষ পুনরায় বেঁচে উঠবে

অমর জেলি ফিশ নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে চিকিৎসাক্ষেত্রে। লিখছেন তুহিন সাজ্জাদ শেখ

Must read

মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছিলেন, ‘‘জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা কবে”, — সত্যিই তো এই পৃথিবীতে কেউ কি সারাজীবন বেঁচে থাকে! অমর বলে কিছু হয় না— প্রকৃতির এই ধ্রুব সত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে প্রস্তুত এক ধরনের সামুদ্রিক জেলি ফিশ ‘টুরিটোপসিস দোহরনি’ (Immortal Jellyfish Turritopsis dohrnii)। জলজ বাস্তুতন্ত্রে এরা একপ্রকার অমর বলেই পরিচিত। বিজ্ঞানী মহলে একেবারে সাজ সাজ রব, ওই প্রকার জেলি ফিশের (Immortal Jellyfish Turritopsis dohrnii) দেহে ঘটে যাওয়া জৈবিক কলাকৌশলকে কাজে লাগিয়ে হয়তো মানবজাতির কিছু মৃত্যু-অনিবার্য ব্যাধিকে চিরতরে নির্মূল করা সম্ভব হবে এই আশায়।

সমুদ্র, ডক ও নোনা জলের খাঁড়িতে বসবাসকারী ‘অ্যানিমালিয়া’ রাজ্যের ‘হাইড্রোজোয়া’ শ্রেণির এই বিশেষ প্রজাতির জেলি ফিশ লম্বায় সর্বাধিক প্রায় ৪.৫ মিলিমিটার হয়ে থাকে। এই প্রকার জলজ জীবকে প্রথম ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ভূমধ্যসাগরে দেখা গিয়েছিল। ঘণ্টার মতো দেখতে প্রাণীটি দৈর্ঘ্যে ও প্রস্থে প্রায় সমান-সমান। এদের উজ্জ্বল লাল বর্ণের পাকস্থলী সহ ৮০-৯০টি শৃঙ্গ থাকে। বাচ্চা অবস্থায় এরা ১ মিলিমিটার ব্যাস বিশিষ্ট প্রায় আটটি মতো শৃঙ্গ নিয়ে পিণ্ডাকারে জলে ভাসমান অবস্থায় থাকে।
এই ধরনের জেলি ফিশ সচরাচর নাতিশীতোষ্ণ ও ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে বেশি দেখা যায়। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানী ওয়াইসম্যান বিজ্ঞানসম্মত ভাবে এর নাম দেন ‘টুরিটোপসিস দোহরনি’। অন্যান্য জলজ জীবের মতো এদের জীবনও ছোট্ট মুক্ত জলে ভাসমান ‘প্লানুলা’ নামক লার্ভা থেকে শুরু হয়, যা একটি নিষিক্ত ডিম থেকে জন্ম নেয়। পরবর্তীতে ওই লার্ভাগুলো একত্রিত হয়ে কলোনির মতো সমুদ্রের মেঝেতে ‘পলিপা’কারে বসবাস শুরু করে। তবে এর মধ্যে কিছু লার্ভা পলিপ হয়ে ওঠার পরে এক জায়গায় বসবাস না করে স্বাধীন ভাবে নিজেদের মতো চরে বেড়ায়, তারা জেলি ফিশ। অনেক সময় এদের ‘মেডুসা’ও বলা হয়ে থাকে। এরা পরিণত যৌন ক্ষমতার অধিকারী হয়। এদের শরীরের সামনের দিকে এপিডারমিস অঞ্চলে তৈরি হয় ঘন স্নায়ুকোষের জাল। স্ত্রী ‘মেডুসা’র পাকস্থলীর গাত্রস্থিত গোনাডে তৈরি হয় ডিমের কুঠুরি।

আরও পড়ুন: পড়াশুনা করা যায় ইউটিউব থেকেও

সচরাচর ১৪-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বেঁচে থাকতে সক্ষম এই অদ্ভুত সামুদ্রিক প্রাণীটিকে মনে করা হয় অমর। কেননা এই প্রজাতির জেলি ফিশ নিজের শরীরের মধ্যে পুনর্নবীকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষমতা রাখে আপনা থেকেই। শরীরটাকে সর্ম্পূণ প্রাথমিক উন্নয়নশীল পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে এই প্রাণীটি। যদি কোনও শিকারি প্রাণী তাদেরকে খেয়ে না ফেলে, তাহলে তারা নিজেদের দেহের যে কোনওরকম রোগ বা ক্ষতকে সারিয়ে পুনরায় লার্ভা অবস্থায় ফিরে যেতে সক্ষম। আবার নতুন জীবন শুরু করতে পারে এই প্রজাতির জেলি ফিশ।

সমুদ্রের নিচে থাকা ছোট ছোট উদ্ভিদ, প্রাণী, মাছের ডিম, কুঁচো শামুক প্রভৃতি খেয়ে বেঁচে থাকা এই ধরনের জেলি ফিশদের উপর সামুদ্রিক অ্যানিমোনস, টুনা ফিশ, হাঙর, সোর্ড ফিশ, সামুদ্রিক কচ্ছপ ও পেঙ্গুইনরা আক্রমণ করে। যদি ওদেরকে খেয়ে ফেলে সেটা আলাদা ব্যাপার, তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিংবা অন্য কোনও শারীরিক চাপ, খাদ্যের অভাব, হঠাৎ তাপমাত্রার তারতম্য, জলের লবণাক্ততা কমে যাওয়া এবং কোনও কৃত্রিম কারণে শরীরের যদি কোনও ক্ষতি হয় তাহলে ওরা ওদের জৈবিক কলাকৌশল দ্বারা পুনর্জীবন লাভ করে।

ওই প্রজাতির জেলি ফিশের দেহে ঘটিত জৈবিক কলাকৌশলের ফলে পুনরায় ওরা ‘পলিপ’ স্তরে ফিরে যায় এবং সানন্দে বসবাস শুরু করে। এই প্রক্রিয়ার শুরুতেই ‘মেডুসা’ তার শারীরিক গঠন, মেসোগ্লিয়া ও শৃঙ্গগুলির গঠনগত পরিবর্তনের কাজ শুরু করে দেয়। ওই প্রকার জেলি ফিশের দেহে ঘটে যাওয়া জৈবিক কলাকৌশল সম্পন্ন হয় নতুন কোষ উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়াটিকে জীববিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘ট্রান্সডিফারেনসিয়েশন’। এটি একটি রৈখিক পুনঃ কার্য প্রক্রিয়া যা প্রাণী জগতের জৈবিক চক্রকে সম্পূর্ণ উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দিতে সমর্থ। এই প্রক্রিয়ায় একটি পরিণত সোমাটিক কোষ তার সম্পূর্ণ জিনগত ধর্ম বজায় রেখে অন্য একটি পরিণত সোমাটিক কোষে রূপান্তরিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় স্টেম কোষের আন্তঃপরিবর্তন হয়। ফলে ‘ডিএনএ মিথাইলেশন’এর দ্বারা নতুন ডিএনএ-র ক্রোমাটিক গঠনের পরিবর্তন হয়।

এই বিশেষ প্রক্রিয়া এই ধরনের জেলি ফিশের দেহে সম্পন্ন হওয়ার পেছনে ‘মেডুসা’ -র মধ্যে উপস্থিত একধরনের বিশেষ জিন। এই ধরনের বিশেষ জিন অন্যান্য জলজ প্রাণীর তুলনায় এই ধরনের জেলি ফিশের দেহে প্রায় দশ গুণ বেশি আছে। এই বিশেষ প্রকারের জিন ‘ওনট্ সিগন্যাল’-এ সাড়া দেয় ফলে ওদের শরীরের কোষ মধ্যস্থিত প্রোটিনের রূপান্তর শুরু হয় যা কোষে-কোষে, কোষ মধ্যস্থিত এবং কোষ-শরীরের বহির্ভাগ একটি সংকেত তরঙ্গ প্রবাহিত হয়। এই সংকেতটিই পুরো পুনর্জীবন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে সাহায্য করে।

ঠিক এই বিষয়টি বিজ্ঞানীদের শুধু নজরই কাড়েনি বরঞ্চ রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, মানবজীবনে এই বিশেষ জীববিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দেহ বহু মারণ রোগের শিকার হয়। যেমন— ক্যানসার, অ্যালজাইমার ডিজিজ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যা, স্ট্রোক ও আরও অনেক কিছু। বিজ্ঞানীদের নিরলস কর্মপ্রচেষ্টা এগিয়ে চলেছে এই জৈবিক প্রযুক্তিকে মানবজীবনের স্বার্থে ব্যবহার করার লক্ষ্যে। অন্যান্য প্রজাতির জেলি ফিশরা আমাদের ভোজ্য হলেও এই বিশেষ প্রকারের প্রণীটির দেহে একটি বিশাল স্নায়বিক জাল আছে যা দিয়ে ওরা পরিবেশে আলোর তারতম্য আন্দাজ করতে পারে। এই ধরনের জেলি ফিশের দেহে ঘটে যাওয়া জৈবিক কলাকৌশলকে কাজে লাগিয়ে একদল বিজ্ঞানী এগিয়ে চলেছেন রোগনির্ণয় ও রোগ নিরাময়ের সহজ ও নিরাপদ পথ বার করার উদ্দেশ্যে।

Latest article