১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর আব্রাহাম লিঙ্কন পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দেওয়া একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। যে ভাষণের সময় ছিল মাত্র ২ মিনিট। সেই ২ মিনিটের ২৭২ শব্দের ভাষণে তিনি ইতিহাসের স্মরণীয় সেই বক্তব্যটি রেখেছিলেন, যা হল ‘ডেমোক্রেসি ইজ অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল’। অর্থাৎ গণতন্ত্র হচ্ছে জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য। এই বাক্যের মূল উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। এবং একটা দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় জনগণের দ্বারাই। জনগণের দেওয়া ভোট থেকেই নির্বাচিত যে সরকার গঠিত হয় সেই পদ্ধতিকেই বলে গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে কোনও সাদা-কালো নেই। গণতন্ত্র কোনও উচ্চনীচ ভেদ করে না। আর তারই ভিত্তিতে এই মার্কিন রাষ্ট্রপতি সেদিন দাসপ্রথার অবসান ঘটিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। তাঁরই পথানুসারী অনুরক্ত কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান ডেমোক্রেসির বার্তা দিতে লিখেছিলেন ‘ও ক্যাপ্টেন, মাই ক্যাপ্টেন’-এর মতো কবিতা। হুইটম্যানকে বলা হয় ‘পোয়ট অব ডেমোক্রেসি’, ‘মিস্টিক পোয়েট’, ‘মডার্ন পোয়েট’ও। কবি বলেছিলেন, ডেমোক্রেসির জয় একদিন হবেই। ডেমোক্রেসিই একমাত্র জনগণের জয়াবার্তা বহন করে আনে। যেখানে আদর্শ গণতন্ত্র নিয়ে আসে সর্বজনীন স্বাধীনতা, বৈষম্যহীন এক সমাজ। মূল কথা, যেখানে কোনও উচ্চ-নিচের ভেদাভেদ নেই। সবার অধিকার সমান। সবার কণ্ঠস্বর সমান। সমাজে সকলকে সমান মর্যাদা দেবার কথাই বলেছে গণতন্ত্রে। এই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াই ইতিহাসে বার-বার স্মরণীয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন ঘটনার নিরিখে। আজও যার থামা নেই।
আর এই গণতন্ত্রকেই সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠা ও সর্বজনীন করে তুলতে তৈরি হয়েছিল ‘ওয়ার্ল্ড ডেমোক্রেসি ডে’ বা ‘বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস’ (International Day of Democracy)। যার প্রথম সূত্রপাত হয় ১৯৪৮ সালে। এই ডেমোক্রেসি শব্দটা এসেছে গ্রিক শব্দ ‘ডেমোস’ (Demos) থেকে। নানা পথ পেরিয়ে ২০০৭ সালে জাতিসংঘ ১৫ সেপ্টেম্বর দিনটিকে গণতন্ত্র দিবস রূপে মর্যাদা দিয়েছে। যেখানে বিশ্বের ১৬২টিরও বেশি দেশ অংশগ্রহণ করে এই দিনটিকে সর্বসম্মত ভাবে গণতন্ত্র দিবস পালনের সম্মতি দিয়েছিল।
গণতন্ত্রের কোনও একটি নির্দিষ্ট মডেল নেই। এবং গণতন্ত্র কোনও দেশকাল গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। গণতন্ত্র হল জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ইচ্ছা বা মত প্রকাশের অধিকার। ১৯৯৭ সালে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন বা আইপিইউ ঘোষণা করে এবং গণতন্ত্রে একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো তৈরি করে। আইপিইউ-এর মত ও পরামর্শ অনুযায়ী ১৫ সেপ্টেম্বর গণতন্ত্র দিবস (International Day of Democracy) হিসেবে গ্রহণ করা হয়। যেখানে জনগণকে মূলত সরকার হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার সমার্থক শব্দ হয়ে ওঠে। এবং সেই থেকে প্রতি বছর এই দিনটি নানা অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে সাধারণ জনগণকে সজাগ ও সচেতন করার প্রয়াস চালিয়ে আসছে। ১৯৯৮ সাল দীর্ঘ ২০ বছরের স্বৈর শাসনের অবসান হয়েছিল ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট কোরাজন সি অ্যাকিনোর উদ্যোগে ফার্দিনান্দ মার্কোসকে পরাজিত করে। ‘পিপল পাওয়ার রেভোলিউশন’ সরকার সাংসদ ও নাগরিক সমাজের নতুন সংজ্ঞা তৈরি হয়েছিল।
আরও পড়ুন-দিচ্ছে ডাক লেহ-লাদাখ
২০০৮ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর আইপিইউ জেনেভার হাউস অব পার্লামেন্টস বিশেষ অনুষ্ঠান করে। ২০১৩ সালে আইপিইউ বিশ্বের ১৬২টি দেশের সদস্যদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের (International Day of Democracy) প্রচার করে। যেখানে স্লোগান ছিল ‘স্ট্রেনদিং ভয়েসেস ফর ডেমোক্রেসি’। ২০১৪ সালে স্লোগান ‘গণতন্ত্র যুবকদের সংযুক্ত করে’।
বছর-বছর নানান সচেতনার বার্তা দিলেও বর্তমান বিশ্বে নানা ঘটনায় গণতন্ত্রের ধ্বস্ত চেহারা আমাদের চোখের সামনে উঠে আসছে। যা গণতন্ত্রেরই লজ্জা। এই তো সেদিন ইউএস ওপেনে মেয়েদের সিঙ্গেলসে চ্যাম্পিয়ন হওয়া নাওমি ওসামা। গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ী ২২ বছরের ওসাকার মা জাপানের, বাবাব হাইতি-র। তিন বছর থেকে মার্কিন প্রবাসী এই কৃষ্ণাঙ্গ তরুণী সামনে দেখেছেন বর্ণবিদ্বেষের মতো অগণতান্ত্রিক অমানবিকতা। যার ফলে প্রতি ম্যাচে তিনি মুখে মাস্কে বর্ণবিদ্বেষের শিকার কোনও না কোনও ব্যক্তির নাম লিখে মাঠে নেমেছেন। আমরা গোটা বিশ্বেই গণতন্ত্রের ভয়ঙ্করতম কিছু উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত দেখতে পাব। সাহিত্য আকাদেমি প্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী কন্নড় লেখক কালবুর্গি, কিংবা লংকেশ পত্রিকার সম্পাদক গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভোলকর-এর মতো মানুষ গণতান্ত্রিক ভাবে নিজস্ব মত প্রকাশ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। দেশে-বিদেশে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধী গণতান্ত্রিক মত প্রচারের জন্য মিথ্যে মামলায় বন্দি ও নির্যাতিত আরও অনেক বিদ্বজ্জন। গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী একদল মানুষের হাতেই। শুধু এই দেশেই নয়, গোটা বিশ্বেই একদিকে গণতন্ত্র-গণতন্ত্র বলে সজাগ বার্তা দেওয়া হলেও প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কোথাও না কোথাও গণতন্ত্রের ধ্বস্ত ভয়ঙ্কর রূপ আমাদের সামনে ফুটে ওঠে আধুনিক প্রযুক্তির সংবাদের মাধ্যমে। তা সে ডাইনি অপবাদে হত্যাই হোক, বা বর্ণবিদ্বেষের কারণে।