ভাস্কর ভট্টাচার্য: সাক্ষরতা একটি মানবাধিকার। দারিদ্র্য দূর করে সকলের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ৫০ বছরের বেশি হল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হয় প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে। যেখানে বলা হয়েছিল ‘এডুকেশন ফর অল’। সেই ভাবনা নিয়েই ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর ইউনেস্কোর একটি আলোচনাসভায় শিক্ষাকে সব স্তরে পোঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই ১৯৬৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর দিনটিকে প্রথম আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস (International Literacy Day) বা ‘ইন্টারন্যাশনাল লিটারেসি ডে’ হিসাবে ঘোষণা করেছিল। সেদিন থেকে প্রতি বছর বিশ্বের নানা প্রান্তে, নানা দেশে এই দিনটি নানা ভাবে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে ৭-৮ সেপ্টেম্বর এই দু দিন নানা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। দীর্ঘ প্রচেষ্টা চললেও সাক্ষরতার মানচিত্রটি অনেক দেশেই খুবই হতাশাজনক। যেমন আফগানিস্তানে।
একটু দেখে নেওয়া যাক বিশ্বের শিক্ষার মানচিত্রটি। যেখানে বলা হচ্ছে বিশ্বের ৭৫ কোটি পূর্ণবয়স্ক মানুষ এখনও লিখতে-পড়তে পারেন না। এক কথায়, নিরক্ষর। পৃথিবীত ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব সামগ্রিক জনসংখ্যার আন্তর্জাতিক সাক্ষরতার হার ৮৪.১ শতাংশ। যার মধ্যে পুরুষ সাক্ষরের হার ৮৮.৬ শতাংশ এবং মহিলা সাক্ষরতা ৭৯.৭ শতাংশ। শিক্ষায় মহিলা পুরুষ লিঙ্গবৈষম্য দূর করে নারীর ক্ষমতায়ন বা শিক্ষায় নারীকে অনেক বেশি উপরের দিকে তুলে আনার কথা ঘোষণা করা হলেও বাস্তবে আজও বিশ্বের বহু নারী-পুরুষ অশিক্ষার অন্ধকারে। পৃথিবীর পূর্ণবয়স্ক নিরক্ষরের সংখ্যার দুই তৃতীয়াংশ মহিলা। ৬০.৭ শতাংশ শিশু এখনও স্কুল শিক্ষার বাইরে। ১২ কোটি ২০ লাখ শিশু অশিক্ষিত, যার মধ্যে ৬০ শতাংশ মহিলা।
সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক অনুসারে পৃথবীর ৭৭.৫ কোটি পূর্ণবয়স্ক নিরক্ষরের প্রায় ৭৫ শতাংশ দশটি রাষ্ট্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। সেগুলি হল ভারত, চিন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র। সর্বনিম্ন সাক্ষরতর হার দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়া ও সাব সাহারান এলাকায়।
জাতিসংঘ এডুকেশন ফর অল স্লোগানের পাশাপাশি সাক্ষরতা ও স্বাস্থ্য নিয়েও বার্তা দিয়েছিল। কারণ ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, এইচআইভি প্রভৃতি কারণেও বিশ্বের একটা বড় অংশ শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে নারীশিক্ষাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ইউনেস্কার স্লোগান ছিল ‘সাক্ষরতা ও ক্ষমতায়ন’। যেখানে জোর দেওয়া হয়েছিল নারীশিক্ষার উপর। লিঙ্গবৈষম্য দূর করে নারীকে পুরুষের সমকক্ষ হয়ে ওঠার শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা। কিন্তু বাস্তবে তা হয়ে ওঠেনি। কোটি-কোটি মানুষ শিক্ষার অঙ্গন থেকে আজও দূরে, বহু দূরে, নিরক্ষর তকমা নিয়েও বেঁচে রয়েছেন।
আরও পড়ুন: হেরে অবসরের ইঙ্গিত নাদালের, চিলিচকে হারিয়ে শেষ আটে আলকারেজ
যে-কোনও দেশ যে-কোনও জাতিই লিঙ্গবৈষম্য দূর করে শিক্ষিত হয়ে উঠলেই আলোকিত সমাজ গড়ে ওঠে। তার প্রকৃত উদাহরণ আর্জেন্টিনা। যেখানে নারী-পুরুষ সমান সংখ্যায় শিক্ষিত। ছোট্ট দেশ অ্যান্ডোরায় একশো শতাংশই শিক্ষিত। অস্ট্রেলিয়ায় সাক্ষরতার (International Literacy Day) হার ৯৬ শতাংশ, চিন ৯৫ শতাংশ, ফ্রান্স ৯৯ শতাংশ। ফিনল্যান্ড ১০০ শতাংশ। প্রতি দশ বছর ইউনেস্কো যে গ্লোবাল লিটারেসি তালিকা তৈরি করে সেখানে বলা হচ্ছে ১৫ বছরের উপর বয়সিদের বর্তমান শিক্ষার হার ৮৬ শতাংশ। যেখানে পুরুষের হার ৯০.৫ শতাংশ। মহিলা ৮২.৭ শতাংশ।
ইউনেস্কো প্রতি বছর বিশ্বের নানা প্রান্তে শিক্ষার প্রসারে কাজ করে এমন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে মহান দার্শনিক পণ্ডিত কনফিউসিয়াসের নামে শিক্ষাপুরস্কার প্রদান করে আসছে ২০০৫ সাল থেকে। এ ছাড়াও ইন্টারন্যাশনাল লিটারেসি পুরস্কার, নোমা লিটারেসি পুরস্কার, কিং সেজং লিটারেসি পুরস্কার-সহ আরও নানান পুরস্কার প্রদান করা হয়েছে বিভিন্ন বছরে। নিরক্ষরতার অভিশাপ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে লেখকদের পাশাপাশি অনেক প্রতিষ্ঠান ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও রয়েছ যারা নিরক্ষতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাহায্য করে থাকে। গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার, ‘মন্টব্ল্যাঙ্ক’ জাতীয় সাক্ষরতার জন্য ও রোটারি ইন্টারন্যাশনাল নিরক্ষতা দূরীকরণে নানা কাজ করে চলেছে।
এ বছর আন্তর্জাতিক লিটারেসি ডে (International Literacy Day) এমন সময় পালিত হচ্ছে যখন গোটা বিশ্ব কোভিড নামক অতিমারির কারণে লক্ষ কোটি প্রাণের বিনিময়ে শুধু বিপর্যস্ত নয়, চরম দুরবস্থায়, লক্ষ-লক্ষ মানুষ কর্মচ্যূত হতে বাধ্য হয়েছেন এবং গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই এক বড় প্রশ্নের মুখে। এক তথ্য জানাচ্ছে বিশ্বের বহু কোটি ছাত্রছাত্রী বা পডুয়া এই অতিমারির কারণে শিক্ষার অঙ্গন থেকে ছিটকে যেতে বাধ্য হয়েছে বা হবে।
বর্তমান বিশ্ব নিও নর্মাল দুনিয়ায় ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে ঢুকে পড়েছে। যাকে বলা হচ্ছে লিটারেসি ইন ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড। সেখানে নিরক্ষরতা দূর করে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি ঘটানোই হবে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের মূল উদ্দেশ্য।