জে এন ইউ-এর ফতোয়া আসলে কী বোঝাল

রাতারাতি বদলে গেল যৌন হেনস্থা নিয়ে জে এন ইউ কর্তৃপক্ষের বক্তব্য। কিন্তু ভাষ্যফক্কিকায় কি চাপা দেওয়া যায় গেরুয়া পার্টির রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা নারী বিদ্বেষের ফণাগুলো? না কি সেগুলো হেলদুলে নিজেদের ছন্দে রোজ সন্ত্রস্ত করে নারী স্বাধীনতার উঠোন? উত্তর খুঁজতে, হাল-হকিকত বুঝতে কলম ধরেছেন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক অরুন্ধতী দাস

Must read

দেশ জুড়ে ছিছিক্কার শুরু হয়েছে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল কমপ্লেইনস কমিটির সাম্প্রতিক কীর্তি নিয়ে। আগামী ১৭ জানুয়ারিতে যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে একটি কাউন্সেলিং সেশনের আয়োজন করতে চলেছে এই অভ্যন্তরীণ অভিযোগ কমিটি। সেই সূত্রেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে আমন্ত্রণমূলক বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। প্রতি মাসে একবার করে এই বৈঠকের আগাম খবর জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে এই কাউন্সেলিং সেশনের উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য ‘সেশনের প্রয়োজনীয়তা কী?’ এই মর্মে একটি ছোটো অনুচ্ছেদ রাখা হয়েছে সেই প্রাতিষ্ঠানিক নোটিফিকেশনে। আর এইখানেই বেধেছে গোল।

সোজা বাংলায় বক্তব্যের অনুবাদ করলে যা দাঁড়ায়, সেখানে বলা আছে, ‘আইসিসির কাছে যেসব দৃষ্টান্ত বারবার উঠে এসেছে, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ঘনিষ্ঠ বন্ধুবৃত্তের মধ্যেই সাধারণত যৌন হেনস্থার ঘটনা ঘটে। ছেলেরাই সাধারণত (কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে, কখনও বা অনিচ্ছাকৃতভাবে) বন্ধুত্বপূর্ণ খুনসুটি আর যৌন হেনস্থার মধ্যে থাকা সূক্ষ্ম ভেদরেখাটি অতিক্রম করে ফেলে। আর এই ধরনের যে-কোনো হেনস্থার পরিস্থিতি এড়িয়ে চলার জন্য মেয়েদেরই উচিত পুরুষ বন্ধুদের থেকে তাদের নিজেদের কীভাবে স্পষ্ট তফাত বজায় রাখতে হবে।
স্পষ্ট বোঝা যায় কট্টর মিসোজিনিস্ট, নারী বিদ্বেষী যে গৈরিক মৌলবাদ নানা অছিলায় বারবার ধর্ষণের জন্য, শ্লীলতাহানির জন্য মেয়েদের আচরণবিধিকে কাঠগড়ায় তুলতে চায়, নারীস্বাধীনতার ওপরে হস্তক্ষেপ করে বারবার পুরুষতান্ত্রিক পেশিপ্রদর্শনের দোষ ভুলতে চায়, ঠিক সেই মানসিকতাই বেরিয়ে পড়েছে এই জবানির ছত্রে ছত্রে।

বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্ট রয়েছে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়—ছেলেরা যে ভেদরেখা চেয়ে বা না চেয়ে অতিক্রম করে ফেলে, তাকে সচেতনে বজায় রাখার দায়িত্ব শুধু মেয়েদেরই! মেয়েরা সচেতন হলে তবেই এড়ানো যাবে যৌন হেনস্থা—এ জাতীয় বক্তব্যের মোদ্দা অর্থ এটাই দাঁড়ায় যে, মেয়েদের অসচেতনতা বা অজ্ঞতা বা মূর্খামিই যৌন হেনস্থার কারণ। আর ছেলেরা অনেকসময় না বুঝেই যৌন হেনস্থা করে ফেলে! আহা রে! অবশ্য পিঠ তো চাপড়াতেই হত! যে হারে গেরুয়া শিবিরের নেতামন্ত্রীরা ধর্ষণ আর শ্লীলতাহানির দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন, তাতে মহিলাদের ওপরে দায় না চাপালেই যে নয়!

বেশিদূরে যেতে হবে না, আদিত্যনাথ যোগীর রাজ্যেই স্বয়ং রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য মীনা কুমারী আলিগড়ের সাংবাদিক সম্মেলনে ধর্ষণের উদ্বেগজনক হার বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বলেছেন, মেয়েদের অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারই এর জন্য দায়ী! ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে কথা বলে, ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে তারা ছেলেদের সঙ্গে পালিয়ে যায়, স্বভাব বিগড়ে যায় তাদের। মেয়ের মায়েদের দিকে রীতিমতো হুমকির সুরে তোপ দেগেছেন তিনি—মেয়েরা যদি এভাবে নষ্ট হয়ে যায়, এর জন্য তাদের মায়েরাই নাকি দায়ী! এই মন্তব্যের চেয়ে জেএনইউ-এর আইসিসির বক্তব্যের কি খুব ফারাক আদৌ আছে?

পশ্চিমবঙ্গে বিগত বিধানসভা নির্বাচনের ইস্তেহারে বিজেপি প্রচার করেছিল, ক্ষমতায় এলে নাকি সরকারি বাসে মেয়েদের বিনা ভাড়ায় যাতায়াতের সুযোগ মিলবে! নারীর ক্ষমতায়ন বলতে তো এই অযাচিত এবং অবশ্যই অপ্রয়োজনীয় গিমিক ছাড়া তাঁরা আর কিছু বোঝেনই না! সংরক্ষণ নয়, সমানাধিকারই যে সসম্মান সহাবস্থানের মূল পথ, এ বিষয়টা তাঁদের ভুলে থাকলেই সুবিধা। নইলে ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন’-এর রিপোর্ট কেন বলছে, ১৯৯৯-২০০০ সালে ভারতে যত সংখ্যক মহিলা কর্মরতা ছিল, তার হার ১৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে? গোটা মনোযোগটা মেয়েদের পোশাকের দৈর্ঘ্য আর আচরণীয় বিধি শেখানোর দিকে না দিয়ে ছাপ্পান্ন ইঞ্চির পেশিপ্রদর্শনের নোংরা পৌরুষের দাপাদাপিটা একটু কমালে ভালো হত না? রাজ্যের মহিলা মুখ্যমন্ত্রী যখন ভাঙা পা নিয়েও প্রচারসভা করছেন, তখন সামান্যতম সৌজন্যবিনিময়ের কুশলজিজ্ঞাসাটুকুও না করে তাঁকে ‘ঠ্যাং’ না দেখিয়ে ‘বারমুডা পরে’ বসে থাকার বিধান দিলীপ ঘোষ যদি না দিতেন, ভালো কি হত না?

ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন (NCW)-এর চেয়ারপার্সন রেখা শর্মা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো পর্যন্ত প্রত্যেকে সরব হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘৃণ্য লিঙ্গবৈষম্যের অশালীন প্রদর্শনের বিরুদ্ধে। চাপের মুখে অবশেষে পুরোনো বক্তব্য প্রত্যাহার করে নতুন নোটিস ঝুলেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে। সেখানে এখন লেখা আছে, ‘ছেলেদের শেখানো হবে কীভাবে বন্ধুত্ব আর যৌন হেনস্থামূলক আচরণের তফাত করা যায়। আর মেয়েদের শেখানো হবে, কীভাবে যৌন হেনস্থা এড়িয়ে চলা যায়।’

এত কিছুর পরেও আইসিসির কর্মকর্তারা এটুকু বুঝলেন না যে, যৌন হেনস্থা বিষয়ে কাউন্সেলিং সেশনের প্রথম পাঠ আগে হওয়া উচিত বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অসাম্যমূলক মনোভাব বদল করা, ক্ষমতার জোরে, পেশির জোরে অবমাননাকর আচরণ না করা। আর তার জন্য প্রয়োজন যে-কোনো হেনস্থার পরিস্থিতিকে একইসঙ্গে রুখতে চাওয়ার সদর্থক পদক্ষেপ। প্রথম ধাপেই যদি ছেলে এবং মেয়েদের শিক্ষণীয় বিষয়গুলিকে শুধু লিঙ্গের ভেদে আলাদা করে ফেলা হয়, তাহলে একথা বলাটা বোধহয় খুব ভুল নয় যে, গলদটা আসলে গোড়ায়। যাঁরা যৌন হেনস্থার বিচারশালা বসাবেন, সেই কর্মকর্তাদেরই যদি মেয়েদের প্রতি সমালোচনামূলক এমন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা হয়, তাহলে সরষের মধ্যে থাকা ভূত তাড়াবে কে?

Latest article