প্রায় বিস্মৃত অতীতে হারিয়ে গিয়েছে ২৭ জুলাই ১৯৮৬-এর কালিম্পং। আজ পাহাড় অবশেষে শান্ত, জিটিএ নির্বাচন সম্পন্ন, এমনকী গোর্খাল্যান্ড নিয়ে আওয়াজ তোলাটাও প্রায় অতীত। সেদিন কিন্তু এমন আবহাওয়া ছিল না।
বাংলায় বাম পরিচালিত গণহত্যাতে মারিচঝাঁপি, বিজনসেতু, নানুর, নেতাই এমনকী ১৯৯৪-এর ২৩ সেপ্টেম্বর শিয়ালদহ স্টেশনে শাটার নামিয়ে ১৬ রাউন্ড গুলি চালানো ও ৬টি মৃত্যু মনে আসে সবার। কিন্ত কালিম্পং (Kalimpong Genocide)?
গোর্খাল্যান্ড আন্দোলনের একদম গোড়ার দিককার ঘটনা। ১৯৮৬-র ১৩ এপ্রিল পৃথক গোর্খাল্যান্ড রাজ্য গঠন ও ১৯৫০ সালের ভারত-নেপাল চুক্তি খারিজের দাবিতে জিএনএলএফের আন্দোলন শুরু হয়। নেতৃত্বে সেই সুবাস ঘিসিং আর পয়লা মে দার্জিলিং শহরে বিশাল মিছিল সংগঠিত হয় তাঁরই ডাকে। ১২ মে ৭২ ঘণ্টা পাহাড় বন্ধের শুরু, সম্ভবত পাহাড়ের প্রথম ম্যারাথন বন্ধ। সেই দিন অশান্তির জেরে পুলিশের গুলিতে একজনের মৃত্যু (Kalimpong Genocide) হয় আর আহত হন সাতজন। ২৫ মে কার্শিয়াঙে আরও পাঁচজন জিএনএলএফ কর্মী পুলিশের গুলিতে মারা যান আর আহত ২২। ২৮ মে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৫, এবার ১০৮ ঘণ্টা পাহাড় বন্ধ শুরু। উল্টোদিকে আক্রান্ত হতে থাকেন সিপিএম কর্মী-নেতারা।
পাহাড় ক্রমশ হাতের বাইরে যাচ্ছে দেখে নামানো হয় সিআরপিএফ। এখানে মনে রাখা উচিত সিআরপিএফ কিন্ত রাজ্য পুলিশের সঙ্গেই থাকে সব সময়। এরপর সুবাস ঘিসিং ডাক দিলেন ১৯৫০-এর নেপাল-ভারত চুক্তির ৭ম পরিচ্ছেদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের। ভারত- নেপাল চুক্তি অনুযায়ী উভয় দেশের সরকার তাদের নাগরিকদের সমান সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা বলে। এতে পাহাড়ের মানুষের উষ্মার কারণ কম ছিল না। দার্জিলিং বসবাসকারী নেপালিদের সমস্যা এবং কেউ কেউ আবার পাকাপাকি ভারতীয় হতে চান। আবার ১৯৭৭-এ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বলে বসেছিলেন যে নেপালি হল বিদেশি ভাষা আর ভারতে বসবাসকারী নেপালিভাষীরা নাগরিক নন। এতে ঘি ঢাললেন সুবাস ঘিসিং, ২৭ জুলাই কালিম্পং (kalimpong Genocide) জুড়ে মিছিল করে মেলা গ্রাউন্ডে মূল অনুষ্ঠান যেখানে চুক্তির প্রতিলিপি পোড়ানো হবে। এদিকে প্রমাদ গুনল জ্যোতি বসুর প্রশাসন। ওরা বাস-ট্রাম পোড়াতে পারেন আর অন্য কেউ বিক্ষোভের আগুন জ্বালালেই গুলি চালিয়ে নিরামিষ আন্দোলনে রক্তের স্বাদ এনে দিতে সিদ্ধহস্ত। সেটা তিয়েনামেন হোক বা তিলজলা, সাইবেরিয়া টু সোদপুর সেই ট্র্যাডিশন সমানে চালু ছিল। ২৫ তারিখ থেকেই জারি হল ১৪৪ ধারা, যেন কপিবুক ২১শে জুলাই, মোডাস অপারেন্ডি একই। সেদিনের জমায়েতের উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ, সত্যি বলতে সরকারি সম্পত্তি নষ্টের কোনও অভিপ্রায়ই ছিল না। রাজ্য সরকার অবশ্য অন্যরকম ভেবেছিল, ক্রমেই জমাটবাঁধা বিচ্ছিন্নতাবাদকে দমনের চেয়েও বড় হয়ে গেল সিপিএমের হারানো জমি উদ্ধারের প্রয়াস। পুরো দায়িত্ব দেওয়া হল রাজ্য ডিআইজি (সিআইডি) কমল মজুমদারকে। ২৬ জুলাই, শনিবার। কালিম্পংয়ে হাটবার হওয়াতে দিনটা নির্বিঘ্নেই কেটে গেল, যদিও বাড়তে থাকল উর্দিধারীদের উপস্থিতি। আসলে কেউই ভাবেনি যে প্রশাসনিক বাড়াবাড়ি আদৌ হতে পারে। ভুল যেটা হয়েছিল যে সশস্ত্র কেন্দ্রীয় পুলিশের পোজিশন নেওয়াটা। রুট মার্চ, টহল দেওয়া আট কোম্পানি আধাসামরিক বাহিনী পাঠিয়েছিলেন গৃহমন্ত্রী বুটা সিং। ২৬ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুরু হল কার্ফু। এদিকে একই সময় তরাই, ডুয়ার্স থেকে মানুষজন আসতে শুরু করছেন আর তাঁদের কালিম্পঙে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে উর্দিধারী। পরদিন সকাল ১১টার মধ্যে ছোট্ট শহরটা প্রায় উপচে পড়েছে ভিড়ে। ১১টা ৪০ নাগাদ কিছু ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হল থানায়। এদিকে লাভা, পেডং, আলগারা ইত্যাদি থেকে ভিড় আর লাভা-গারুবাথান সড়ক প্রায় আটকেই গিয়েছে। দুপুর দেড়টার ঠিক আগে সিআরপিএফ রিশি রোড আর আরসি মিন্ত্রি রোডের সংযোগস্থলে প্রথম আটকায় বিক্ষোভকারীদের। আর প্রতক্ষ্যদর্শীর মতে প্রথম গুলি চলে সেভেন্থ মাইলের কাছে। আচমকাই পুলিশ গুলি চালিয়ে দেয়। ঘটনাস্থলেই মারা যায় দুই বালিকা-সহ সাতজন।
আরও পড়ুন: ব্যোমকেশ হত্যামঞ্চ মুক্তি অগাস্টে
বলা বাহুল্য, সিআরপি বা পুলিশের ওপর কোনও আক্রমণেই হয়নি তখন অব্দি। কিন্তু তারপর ক্ষিপ্র জনতা শুরু করে ইটবৃষ্টি। প্রায় সব মিছিলই তখন থানার কাছাকাছি, উসকানিমূলকভাবে পাথরছোঁড়া শুরু হয় জিপিওর ছাদ থেকে। যেন এই মুহূর্তটারই অপেক্ষায় ছিল জ্যোতির বসুর প্রিয় ডিআইজি (সিআইডি) কমল মজুমদার। এবার কোনও টিয়ার গ্যাস নয়, লাঠি নয়— সরু রাস্তার দু’পাশের বাড়ির ছাদ থেকে আসতে থাকে ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট। বিরোধী দমন করতে বামসরকার সিদ্ধহস্ত। সেদিন মৃতের সংখ্যা সরকারি হিসেবে ১৩ হলেও বেসরকারি হিসেবে অনেক বেশি। যেমন গোটা ছয়েক মৃতদেহ নাকি ওন্ডেঙ রোডের পাশের ঝোপের মধ্যে থেকেই উদ্ধার হয়, আর প্রায় সবারই পিঠে গুলি। এর মানে তারা প্রাণ বাঁচানোর জন্যে পালাচ্ছিল। আর সেইদিন গোর্খারাও ছেড়ে দেয়নি। জিএনএলএফ কর্মীদের খুকুরির আঘাতে মৃত্যু হয় এক জওয়ানের। আহত হন ডিআইজি (সিআইডি) কমল মজুমদার-সহ ৩০ জন। শুরু হয় ১০৮ ঘণ্টা পাহাড় বন্ধ। উলটোদিকে আক্রান্ত হতে থাকে সিপিএম কর্মী-নেতারা। ৭ সেপ্টেম্বর সোনাদায় সিপিএম সাংসদ আনন্দ পাঠকের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। অক্টোবরে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয় সিপিএমের দার্জিলিঙের দলীয় দপ্তর। বলা যায় এটাই শুরু, আর কোনওদিন স্বাভাবিক হয়নি কলকাতার সঙ্গে পাহাড়ের সম্পর্ক। ১৯৮৮-তে সুবাস ঘিসিং আর জ্যোতি বসুকে এক টেবিলে বসিয়ে বুটা সিং একটি শান্তি চুক্তি স্থাপন করলেও বরফ কোনওদিন গলেনি। লোকদেখানি কারবার করতে প্রতিবছর হলং গেলেও দার্জিলিংটা কালেভদ্রেই গেছিলেন শেয়ালহত্যাকারী। আর পাহাড়ে কোনও উন্নয়নই হয়নি ২০১০ অব্দি। সর্বহারার পার্টি তো অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান কিছুই করেনি তাঁদের জমানাতে, তাই ক্ষোভ কম ছিল না আর ২০০৭-এ তা চরম আকার নিয়ে মাথাচাড়া দেয়। শিলিগুড়িতে অশোক ভট্টাচার্য একাধিপত্য কায়েম করলেও পাহাড়ে (Kalimpong Genocide) লবডঙ্গা ছিলেন। পাহাড়ে যে কোনও সিটে সিপিএমের এমএলএ শেষ জিতেছিল ১৯৮৭-তে। এই মুহূর্তে কিছুটা হলেও শান্ত এবং সুশাসনের পরিবেশ ফিরে এসেছে বর্তমান রাজ্য সরকারের চেষ্টায়। আজ বামফ্রন্ট যেমন তাদের অধিকাংশ কুকীর্তির দলিল মুছেছে এটাও তাই আর সরকারি নথি এই বিষয়ে নেই বললেই চলে। পাহাড়ে যদিও দিনটি মর্যাদার সঙ্গেই পালন হয়। The Darjeeling Chronicle সেই নিয়ে লিখেছিল : But as a towering figure himself now in today’s Bengal holding the august office of the Chief Minister, Mr. Jyoti Basu lacks the courage to accept and implement what he himself propounded— the honorable fulfillment of the very cause he so courageously championed in favor of the people of the hills of Darjeeling some three decades ago. শোনা যায় সিআরপিএফের আইজি সি কে হান্ডা-কে সরাসরি ওয়াকিটকি-তে নির্দেশ মহাকরণ থেকেই এসেছিল। আর তারপর, হুইস্পারিং ক্যাম্পেনে সিদ্ধহস্তরা বাকি রাজ্যে রটিয়ে দেয় যে ‘দার্জিলিং গেলেই খুকরি দিয়ে গলা কেটে দিচ্ছে গোর্খারা।’ কোথায় লাগে আজকের আইটি সেল! তবে আজ ঘিসিং নেই, সিপিএম শুধু পাহাড় নয় রাজ্যেই গোল্লা, হারিয়ে গেছে বিমল গুরুংও। আছে সেই সেইদিনের স্বজনহারাদের বেদনা। আর পাহাড়ে এসেছে শান্তি।