অনন্ত জিজ্ঞাসা নানা সময়ে বহু মানষুকে এক দেশ থেকে অন্য দেশে উড়িয়ে নিয়ে গেছে। সেই দেশ সেই ভূমিকেই তাঁরা আপন করে নিয়েছেন, সেই জলহাওয়ায় সমাজজীবনের দৈনন্দিন যাত্রায় সম্পক্তৃ করে দিয়েছেন নিজেদের। তেমনই ভারতের শিক্ষার অনন্ত সন্ধানেই সুদূর সুইডেন থেকে এক যুবক চলে এসেছিলেন এই কলকাতায়। তখন তিনি পয়ঁত্রিশের যবুক। পায়ে-পায়ে ঘুরছেন কলকাতার পথে-পথে। এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে। তখন এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়ার তেমন কোনও বিশেষ সুবিধা ছিল না। শোনা যায় এই যুবক সুইডেন থেকে প্রথমে ইংল্যান্ড তারপর সরাসরি কলকাতায় এসেছিলেন। তার অনেকটাই ছিল পায়ে হাঁটা। সুদূর সুইডেনে বসেই পড়ে ফেলেছিলেন রামমোহনের বই। সেই বই পড়েই তাঁর মনে উদয় হয়েছিল অনেক প্রশ্ন। পড়ে ফেলেছিলেন `বেদান্তসার’-এর জার্মান অনুবাদ। সেই বইই তাঁকে রামমোহনের স্বদেশভূমিকায় আসার উৎসাহ জুগিয়েছিল। অনুপ্রাণিত করেছিল রামমোহনের ভারতবর্ষকে জানার চেনার। সেই যে কলকাতায় এলেন আর ফিরে যাননি। সেটা ছিল ১৮৯৩ সালের জুলাই মাস। কাছে টাকা নেই, কোথাও কোনও পরিচিতি নেই। সেই যুবক কলকাতায় এসে উঠেছিলেন বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রনাথ বসুর কাছে, শিবনাথ শাস্ত্রীর সহায়তায়। সে সময়ে শিবনাথ শাস্ত্রী ছিলেন ভারতবর্ষে ব্রাহ্মবাদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে হামেরগ্রেনের পরিচয় হয়েছিল ইংল্যান্ডে। হামেরগ্রেন রামমোহনের ভাবনায় উদ্বদ্ধু হয়ে ব্রাহ্মবাদের প্রতি অনুরক্ত হয়ে ওঠেন। প্রখর বুদ্ধিমান, অত্যন্ত শিক্ষিত এই জ্ঞানান্বেষী কলকাতায় এসেছিলেন একেবারে নিঃস্ব কপর্দকহীন হয়ে। অথচ তা হবার কথা ছিল না। অল্প বয়সে পিতাকে হারালেও লেখাপড়ায় অসম্ভব ভাল ছিলেন। তাঁর ছোটবেলার এক বন্ধ আলবান্ট ব্লমু সুইডেনে বসে হামেরগ্রেন সম্বন্ধে সখেদে বলেছিলেন, একদিন হয়তো অধ্যাপনা জীবনেই তিনি যেতেন। কিন্তু হামেরগ্রেন সে-সব জলাঞ্জলি দিয়ে ভারতের পথেই পা বাড়িয়েছিলেন। প্রখর বিুদ্ধদীপ্ত এই যুবকটি যেমন ছিলেন শিক্ষিত তেমনই তাঁর রপ্ত ছিল অনেকগুলি ভাষা। একদিকে নিজের পড়াশোনা অন্যদিকে কলকাতার পথে-পথে ঘুরে বেড়ান আর কিছু নব্যশিক্ষিত ধনীর বাড়িতে ভাষা শিক্ষার পাঠ দেন। সেই ভাষা শিক্ষার পাঠ দিতেই একদিন পৌঁছে ছিলেন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম ঠিকানা জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। শিক্ষক হামেরগ্রেন, ছাত্র অবনীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথকে হামেরগ্রেন ফরাসি ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পেয়েছেন। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখলেন, `তারপরে একজন ফ্রেঞ্চ পড়াবার মাস্টার এলেন আমাদের জন্য, নাম তাঁর হামেরগ্রেন।… তাঁর কাছে একট-একটু ফ্রেঞ্চ পড়তাম। তিনি খুব ভাল পড়াতেন। শুধু ভাষা শিক্ষাই নয়, হামেরগ্রেন সে সময়ের কলকাতায় রামমোহনের নামে একটি মিউজিয়াম গড়ারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন।’ ভারতপথিক হামেরগ্রেন কলকাতার পল্লিতে পল্লিতে ঘুরে-ঘুরে সাধারণ মানুষদের সঙ্গে মিশতেন, তাঁদের আচার-আচরণের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাইতেন আর চাইতেন সাধারণ মানুষকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। আজ থেকে কত বছর আগে সেই সে কালে সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর এমন উদ্যোগী হামেরগ্রেনকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন আরও কাছ থেকে। তাঁর প্রখর বিদ্যার তারিফ করেছিলেন শুধু এ দেশেই নয়, নোবেল পরুস্কার প্রাপ্তির অনেক পরে হামেরগ্রেনের জন্মভূমি সুইডেনে গিয়েও। রবীন্দ্রনাথের বলার আগে হামেরগ্রেনকে বস্তুত সে দেশের কেউই তেমন ভাবে জানত না। সইুডেনের মানুষ নোবেলজয়ী রবীন্দ্রনাথের মুখে হামেরগ্রেনের কথা শুনে চমকিত। রবীন্দ্রনাথ এই হামেরগ্রেন সম্বন্ধে লিখেছেন, তখন তরুণ, যুরোপ থেকে বঙ্গদেশে এক বিদেশি এলেন। তিনি সাধারণ লোকদের মধ্যে সাধারণের মতোই থাকতেন, তাঁদের মতোই সামান্য খাবার খেতেন। আর স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাদের সেবা করতেন। ধনীগৃহে ফরাসি এবং জার্মান ভাষা শেখানো তাঁর কাজ। এইভাবে যেটুকু উপার্জন করতেন দুঃস্থ ছাত্রদের বই কিনে দিতে তা ব্যয় করতেন। এই গরমের দেশে দপুুরের রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহনের পয়সা বাঁচাতে তাঁকে হাঁটতে হত। নিজের প্রতি নির্মম হয়ে অর্থ শক্তি সময় সব দিক ভেবেই তাঁকে কঠোর দুঃখ সহ্য করে চলতে হয়েছে। এ সবই তাদের জন্য যাদের মধ্যে তিনি জন্মগ্রহণ করেননি, যাদের তিনি জানতেন না অথচ যাদের তিনি গভীর ভাবে ভালবেসেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন এই কলকাতাতেই। তাঁর ইচ্ছামতো তাঁকে দাহ করা হয়েছিল নিমতলা শ্মশানে । শুধু হামেরগ্রেন নন, ভারতবর্ষের দর্শন হামেরগ্রেনের মতো আরও বহু মানষুকে টেনে এনেছিল এ দেশে। উইলিয়াম জোন্স, হ্বিন্টারনিটশ থেকে অ্যানি বেসান্ত যেমন দর্শনের টানে এসেছিলেন এবং এ-দেশের জল- মিশিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস তাঁদের প্রজ্ঞার আলো তেমনই নতুন আলোর দিশারী হয়ে ভারতের মাটিতে পা রেখেছিলেন সিস্টার নিবেদিতা থেকে উলিয়াম কেরি, ডিরোজিও, ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথনু, ডেভিড হেয়ার-এর মতো অসংখ্য মানষু। কেউ ব্যবসা করতে কেউ শিক্ষার আলো নিয়ে। হামেরগ্রেন এসেছিলেন ভারত থকে শিক্ষা নিতে। ভারতকে ভারতের দর্শনকে আরও-আরও বেশি করে আত্মস্থ করতে।