ফুটবল বিশ্বকাপের মধ্যেই দামামা বেজে গেল কলকাতা বইমেলার (Kolkata Book Fair)। নড়েচড়ে বসেছেন বইপ্রেমীরা। যতই সোশ্যাল মিডিয়া আসুক, বঙ্গজীবনে বইয়ের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। এখন হাতের মুঠোয় পৃথিবী। বিনোদনের রকমারি উপাদান। তবু বই পড়ার এবং কেনার উৎসাহে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। বরং বছর বছর বাড়ছে। পরিসংখ্যান অন্তত সেই কথাই বলে। পরে আসছি সেই প্রসঙ্গে।
একটা বিষয় ভেবে দেখুন তো, বইমেলায় যত জনসমাগম হয়, অন্যান্য মেলায় ততটা হয় কি? হয় না। নিন্দুকরা যুক্তি খাড়া করতে পারেন, বইমেলায় ভোজন রসিকরাই বেশি ভিড় জমান। বছর বছর ফুডপার্কগুলির রমরমা দেখলে সেটা বিলক্ষণ বোঝা যায়। প্রকৃত বইপ্রেমীর সংখ্যা তো মুষ্টিমেয়।
পাল্টা প্রশ্ন রাখা যায়, ফুড পার্কে ভিড়, ঠিক কথা। তবে ওই ভিড় জমানো মানুষগুলোর হাতে বইয়ের প্যাকেট কি চোখে পড়ে না? ধরে নেওয়া যাক, দশজনের মধ্যে দু’জন বইমেলায় শুধু ঘুরতে আসেন, খেতে আসেন। বাকি আটজন? তাঁরা তো বই কেনেন, পড়েন। সেটা কম কী? যাঁরা বই কেনেন না, শুধুই ঘুরতে আসেন, তাঁরা তো সময় কাটানোর জন্য অন্য মেলার বদলে বইমেলাকেই (Kolkata Book Fair) বেছে নেন। সুস্বাদু খাবারের পাশাপাশি একবুক নতুন বইয়ের গন্ধ নিয়ে ফিরে যান বাড়িতে। ভবিষ্যতে তাঁদের মধ্যে কেউ যে নতুন বই হাতে তুলে নেবেন না, কে বলতে পারে? অসংখ্য পরবের মধ্যে বঙ্গজীবনে বই-পরবের প্রভাব অপরিসীম। কমার তো প্রশ্নই নেই, বরং দিন দিন জনপ্রিয়তা বাড়ছে। শীতের মরশুমে নলেন গুড়কেও যেন হার মানায় নতুন বইয়ের গন্ধ।
আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা (Kolkata Book Fair) পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বইমেলা। অনেকেই একবাক্যে স্বীকার করেন। পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ড এই বইমেলার আয়োজক। সহযোগিতা থাকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের। মনে করা হয়, গত চার দশকে শারদীয়া উৎসবের পর রাজ্যের সবথেকে বড় উৎসব আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। বই-পরব এমন এক পরব যেখানে লাগে না ধর্মের রং। মহা সম্মিলন ঘটে নানা ভাষা, নানা মতের।
নামেই কলকাতা বইমেলা। আসলে এই বইমেলা সমগ্র রাজ্যের, দেশের। সারা পৃথিবীর বললেও ভুল বলা হয় না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এই বইমেলায় অংশগ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক মানের লেখকদের রচনার সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় ঘটে। পাশাপাশি পরিচয় ঘটে দেশের এবং রাজ্যের লেখকদের সঙ্গেও। মহানগরের লেখকদের কথা অনেকেই জানেন। তাঁদের পিছনে আছে বড় বড় সংস্থা। কলকাতা বইমেলায় তাঁদের বই যেমন হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়, তেমনই পাওয়া যায় বিভিন্ন জেলার ছোট শহর, মফসসল, প্রত্যন্ত গ্রামের লেখকদের বই। এমন কিছু বই, যেগুলো অন্য সময় কলেজ স্ট্রিট বই পাড়ায় হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ থাকে না। তাই কলকাতা বইমেলা আলোকিত লেখকদের যতটা, ততটাই অনালোকিত বা কম আলোকিত লেখকদের। যতটা প্রবীণ কবির, ততটাই মেলার মাঠে একলা ঘোরা উদাসীন নবীন কবির। কোনও কোনও সবুজ মনে ছুঁয়ে যায় প্রথম প্রকাশের আনন্দ।
আরও পড়ুন-প্রতিবন্ধকতা পরাজিত যেখানে…
বইমেলায় সমাবেশ ঘটে বিভিন্ন বয়সি পাঠকদের। কেউ কেনেন গল্পের বই, কেউ উপন্যাস, কেউ কবিতা-ছড়ার, কেউ বা নাটক বা প্রবন্ধের। এইভাবেই জিতে যায় বই। রুচিশীল শিক্ষিত সমাজ এইভাবেই বাঁচিয়ে রেখেছে একটা গোটা ইন্ডাস্ট্রিকে।
আমাদের রাজ্যে বইমেলার রাজা অবশ্যই আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। পাশাপাশি শীতের মরশুমে প্রতিটি জেলায় সরকারি উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় জেলা বইমেলা। মূলত গ্রন্থাগার পরিষেবা দফতরের ব্যবস্থাপনায়। অনেক জায়গায় ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। এছাড়াও বিভিন্ন শহর-গ্রামে বেসরকারি উদ্যোগেও বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠিত হয় গ্রামে গ্রামে বইমেলা, নববর্ষে বইমেলা, আবাসন বইমেলা ইত্যাদি। এই মুহূর্তে কলেজ স্ট্রিটে চলছে বাংলাদেশ বইমেলা।
এত বইমেলা কেন? প্রশ্ন উঠতেই পারে। উত্তর একটাই, আজও রয়েছে বইয়ের বিপুল চাহিদা। তাই এত বইমেলা। সাফল্য না এলে প্রকাশকরা বছর বছর এত বই ছাপতেন কি? বইয়ের হাত ধরেই মানুষ অজানাকে জানতে চায়, অচেনাকে চিনতে চায়। সেই কারণেই অন্যান্য মেলাগুলোকে বেশ কয়েক কদম পিছনে ফেলে বইমেলার জনপ্রিয়তা বছর বছর বেড়েই চলেছে। আগামিদিনে আরও বাড়বে।
ফুটবল বিশ্বকাপের মধ্যেই দামামা বেজে গেছে ২০২৩-এর কলকাতা বইমেলার। ৪৬তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার উদ্বোধন হবে ৩০ জানুয়ারি। চলবে ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। উদ্বোধন করবেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৩০ নভেম্বর কলকাতার দ্য ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে এই কথা জানিয়েছেন পাবলিশার্স অ্যান্ড বুকসেলার্স গিল্ডের সাধারণ সম্পাদক ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং সভাপতি সুধাংশুশেখর দে।
সবথেকে আনন্দের, বহু প্রাঙ্গণ ঘোরার পর এতদিনে বইমেলা পেয়েছে নিজস্ব ঠিকানা ‘বইমেলা প্রাঙ্গণ’। গত বইমেলার উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কের এই নামকরণ করেছেন। পাশাপাশি জানিয়েছেন, প্রতি বছর বইমেলা হবে এই প্রাঙ্গণেই।
এবার একটি পরিসংখ্যান দেওয়া যাক। ২০২২-এর বইমেলায় ২২ লক্ষ বইপ্রেমী মানুষ এসেছিলেন। বই বিক্রির পরিমাণ ২৩ কোটি। অতীতের সমস্ত বইমেলার থেকে বেশি। এটা খুব কম কথা নয়। বরং আহ্লাদিত হওয়ার মতোই। পরিসংখ্যানটি প্রমাণ করে, সত্যিই সোশ্যাল মিডিয়া বইয়ের জনপ্রিয়তায় আজও বিন্দুমাত্র থাবা বসাতে পারেনি।
২০২৩-এর বইমেলায় ফোকাল থিম কান্ট্রি স্পেন। এর আগে ২০০৬ সালে বইমেলার থিম কান্ট্রি হিসেবে স্পেন অংশগ্রহণ করেছিল। স্পেন ছাড়াও প্রতিবছরের মতো আগামী বইমেলায় অংশগ্রহণ করবেন অন্যান্য দেশ এবং ভারতের অন্যান্য রাজ্যের প্রকাশনা সংস্থা। থাকবেন বইপাড়ার ছোট-বড়-মাঝারি প্রকাশকরা এবং লেখকদের আঁতুড়ঘর লিটল ম্যাগাজিন। সেজে উঠবে স্টল, প্যাভেলিয়ন, টেবিল। উজ্জ্বল হাসি ছড়াবে নানা রঙের বই, পত্রিকা।
আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা ২০২৩-এর আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ নবম কলকাতা লিটারেচার ফেস্টিভ্যাল। অনুষ্ঠিত হবে ৯ থেকে ১১ ফেব্রুয়ারি। অন্য লেখকদের পাশাপাশি উপস্থিত থাকবেন স্পেনের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীরা।
এছাড়াও বিভিন্ন মঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে বই প্রকাশ, আলোচনাসভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অটোগ্রাফ নয়, এখন ফটোগ্রাফের যুগ। প্রিয় লেখকদের সামনে পেয়ে অনেকেই তুলবেন সেলফি। বই ছাড়াও কেউ কেউ কিনবেন হস্তশিল্পীদের কাজ, চিত্রশিল্পীদের আঁকা ছবি। সবকিছু নিয়েই কলকাতা বইমেলা। এক আন্তরিক আয়োজন। সাড়ে চার দশকে যার চরিত্রে বিন্দুমাত্র বদল ঘটেনি।
কান পাতুন। ওই ডাকছে বই। তাই তো এই মুহূর্তে জোরকদমে চলছে প্রস্তুতি। নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই বইপাড়ায়। লেখকরা ব্যস্ত, ব্যস্ত প্রকাশক, সম্পাদকরা। প্রুফরিডার, প্রচ্ছদ-অলংকরণ শিল্পীদের ব্যস্ততাও কম নয়। ব্যস্ত মুদ্রণশিল্পী, বাঁধাই শিল্পীরাও। সময়ের মধ্যে বই রেডি করতে হবে যে। তবেই তো বইমেলা প্রাঙ্গণে হাসি ফুটবে অগণিত পাঠক-পাঠিকার মুখে।