প্রতিবন্ধকতা পরাজিত যেখানে…

কেউ সামান্য ব্যর্থতায় ভেঙে পড়েন। আবার কেউ জীবনের চরম বিপর্যয় সত্ত্বেও হার-না-মানা মানসিকতায় অদম্য লড়াই করেন, বাঁচিয়ে রাখেন নিজের অস্তিত্ব। জয় করেন সব প্রতিবন্ধকতা। গতকাল ছিল বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। সেই উপলক্ষে হার-না-মানাদের নিয়ে লিখলেন সৌরভকুমার ভূঞ্যা

Must read

পৃথিবী আমাদের কাছে সেভাবে প্রতিভাত হবে যে-চোখে আমরা তাকে দেখব। মনের মধ্যে হতাশা গ্রাস করলে পৃথিবীর সব রং ধূসর মনে হয়। আবার খুশির আলোয় চোখ মেললে পৃথিবী হয়ে ওঠে বর্ণময়। জীবনটাও অনেকটা সেরকম। দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্যে বদলে যায় জীবনদর্শন, ভাবনাচিন্তা; রচিত হয় সাফল্য-ব্যর্থতার ইতিহাস। বহু মানুষ আছেন যাঁরা অল্পে হতাশ হয়ে পড়েন। সামান্য ব্যর্থতায় ভেঙে পড়েন। আবার অনেকে আছেন জীবনের চরম বিপর্যয় সত্ত্বেও হার-না-মানা মানসিকতায় অদম্য লড়াই করেন জীবনপ্রবাহে নিজের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখতে। এভাবেই কেউ কেউ অবিশ্বাস্য দক্ষতায় নিজেকে তুলে ধরেন ব্যতিক্রমী হিসেবে। পৃথিবীর চলমান ইতিহাসের পাতায় নিজের জন্য আলাদা একটা অধ্যায় রচনা করেন যা কালের প্রবাহে চির অমলিন থেকে যায়। বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে আমরা খুঁজে পাবে এমন অনেক মানুষ যাঁরা শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়েও নিজেদেরকে সাফল্যের এক বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
কাতারে শুরু হয়েছে ফুটবলের মহারণ। বিশ্বকাপের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে একজন যুবক বিশ্ববাসীর নজর কেড়ে নেয়। দেখা যায় যুবকটি হলিউড তারকা মরগ্যান ফ্রিম্যানের সঙ্গে উদ্বোধন মঞ্চে হাত মেলাচ্ছেন। যুবকটির শরীরের নিম্নাংশ নেই। বছর কুড়ির এই যুবক হলেন বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসাডর গনিম আল মুফতাহ্ (Ghanim Al Muftah)।
গনিম আল মুফতাহের (Ghanim Al Muftah) জন্ম ২০০২ সালের ৫ মে। মায়ের গর্ভে থাকাকালীন তিনি (Ghanim Al Muftah) বিরল কডাল রিগ্রেশান সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত হন। এটি এমন এক রোগ যাতে ভ্রূণের নিম্নাংশের বৃদ্ধি হয় না। ষাট হাজার জনে একজন এমন রোগে আক্রান্ত হয়। চিকিৎসক তার বাবা-মাকে পরামর্শ দেন গর্ভপাত করানোর জন্য। কিন্তু গনিমের (Ghanim Al Muftah) বাবা-মা সিদ্ধান্ত নেন সন্তান যেমনই হোক তাকে পৃথিবীর আলো দেখাবেন। বলেন তাঁরাই হবেন সন্তানের দুই পা। তাঁদের ভালবাসায় পৃথিবীর আলো দেখেন গনিম। ডাক্তার বলেছিলেন তার আয়ু বড় জোর পনেরো বছর। কিন্তু ডাক্তারের কথা ভুল প্রমাণিত করে গনিম (Ghanim Al Muftah) শুধু কুড়ি বছরে পদার্পণই করেননি, ইতিমধ্যেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন সফল মানুষ হিসেবে।

পড়াশোনা করতে গিয়ে প্রথমে বেশ সমস্যায় পড়েন গনিম। কোনও স্কুল তাকে ভর্তি নিতে চায় না। শেষমেশ একটি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান তিনি। কিন্তু সেখানে সহপাঠীরা তাকে নিয়ে ঠাট্টা-মজা করত। গনিমের মা তাকে উৎসাহিত করতেন ওই বন্ধুদের সঙ্গেই বেশি-বেশি করে মিশতে। তাদের নিজের জীবনের লড়াইয়ের কথা শোনাতে। এইভাবেই তিনি সহপাঠীদের আপন করে নেন। শুধু পড়াশোনা নয়, খেলাধুলোতেও গনিমের ছিল বেশ আগ্রহ। স্কুলে পড়ার সময় হাতে বুট পরে সহপাঠীদের সঙ্গে ফুটবল খেলেছেন। শুধু তাই নয় স্কেটবোর্ডিং, সুইমিং, স্কুবা ডাইভিং, হাইকিং প্রভৃতি করেছেন। এমনকী পর্বতারোহণও করেছেন তিনি। জয় করেছেন উপসাগরীয় অঞ্চলের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। স্বপ্ন দেখেন একদিন তিনি এভারেস্ট জয় করবেন। পাশাপাশি তাঁর ইচ্ছে ভবিষ্যতে বড় কূটনীতিবিদ হওয়া। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছেন তিনি।
গনিম একজন মোটিভেশন্যাল স্পিকার। নিজের জীবনের লড়াইয়ের কাহিনি শুনিয়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর লক্ষ-লক্ষ ফলোয়ার। পাশাপাশি তিনি কাতারের একজন সর্বকনিষ্ঠ উদ্যোক্তা। তিনি ঘারিসা আইসক্রিম ফ্যক্টরি স্থাপন করেছেন। গোটা কাতার জুড়ে এর ৬টি শাখা রয়েছে। ৬০ জন কর্মী এখানে কাজ করেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে জীবনে সাফল্যের কাহিনি রচনাকারী এই মানুষটিকে ফিফা কাতার বিশ্বকাপের অ্যাম্বাসাডর হিসেবে ঘোষণা করে।

গনিমের মতো অনেকটা একইরকম জীবনকাহিনি সাইপ্রসাদ বিশ্বনাথনের। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে তামিলনাড়ুর লালগুড়িতে তার জন্ম। ছোটবেলায় তার স্পাইন্যাল কর্ডের অতিরিক্ত বৃদ্ধি হয়। সার্জারি করে সেটা বাদ দিতে গিয়ে শরীরের নিম্নাংশ অসাড় হয়ে যায়। বহু হাসপাতাল ঘুরে, অনেক ডাক্তার দেখিয়েও কোনও কাজ হয়নি।
তার বাবা-মা বুঝেছিলেন একমাত্র শিক্ষাই পারে তাকে সমস্ত সমস্যা থেকে উদ্ধার করতে। তাকে স্কুলে ভর্তি করেন। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে বহুবার স্কুল পরিবর্তন করতে হয় তাকে। কিন্তু হার মানেননি তিনি। অদম্য জেদকে সঙ্গী করে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে তিনি পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পাশ করে CBIT কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। ইনফোসিসে কাজ পান। মাত্র চার মাস কাজ করে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। স্থির করেন বিদেশে পড়াশোনা করবেন। অনেক লড়াই ও ঝঞ্ঝাট পেরিয়ে তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখানে এসে তিনি মুগ্ধ হন। পড়াশোনা করার বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ পান।

এখানে পড়াশোনা করার সময় একদিন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে স্কাই ডাইভিং-এর বিজ্ঞাপন দেখেন। তাঁর মনে ইচ্ছে জাগে স্কাই ডাইভিং করার। চোদ্দো হাজার ফুট উচ্চতায় স্কাই ডাইভিং করে প্রথম ভারতীয় প্রতিবন্ধী স্কাই ডাইভার হিসেবে লিমকা বুক অব রেকর্ডসে নাম লিখিয়ে ফেলেন। আলাদা কিছু করার বাসনা নিয়ে তিনি স্থির করেন অ্যান্টার্কটিকা যাবেন। এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। অবশেষে প্রথম ভারতীয় প্রতিবন্ধী হিসেবে ২০১৩ সালে তিনি অ্যান্টার্কটিকা অভিযান করেন।

কেবল নিজে সফল হয়ে তিনি থেমে থাকেননি। তাঁর মতো মানুষেরা যাতে সফল হতে পারেন, তাঁদের সাহায্য করার জন্য তিনি চার বন্ধুর সহায়তায় ‘সহস্র’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন। গরিব, মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা উচ্চশিক্ষার জন্য এই সংস্থা স্কলারশিপ প্রদান করে। প্রতিবন্ধকতার অন্ধকার তাকে গ্রাস করতে পারেনি। উল্টে সেই অন্ধকারকে হার মানিয়ে নিজের জীবনে আলো জ্বালার পাশাপাশি সমাজকে নিয়ে চলেছেন আলোর পথে।

দীপা মালিক নামটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। তাঁর জীবনের কাহিনি অনেকটা পূর্বোক্ত দুজনের মতোই। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর হরিয়ানার সেনাপাত জেলার ভাইসওয়ালে এক সেনা পরিবারে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন খুব সাহসী। খেলাধুলোর পাশাপাশি তার পছন্দের বিষয় ছিল বাইক। ৬ বছর বয়সে তার মেরুদণ্ডে সিস্ট ধরা পড়ে। অপারেশন করার পর তিন বছর শয্যাশায়ী থাকতে হয়। টানা চিকিৎসা ও থেরাপির পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন তিনি। সময় এগিয়ে চলে। এক সময় তাঁর বিয়ে হয়। দুই মেয়েও হয়। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি পুনরায় খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরীক্ষা করে দেখা যায় মেরুদণ্ডের সিস্ট আবারও ফিরে এসেছে। তিনটি বড় অপারেশন করতে হয় তার। তাতে জীবন বাঁচে ঠিকই কিন্তু কোমর থেকে নিম্নাংশ অসাড় হয়ে যায়। হুইলচেয়ার হয় তাঁর সঙ্গী।

প্রতিবন্ধকতা তাঁকে গৃহবন্দি করে দেয়। এভাবে তিনি হাঁপিয়ে উঠছিলেন। আলাদা কিছু করার মানসিকতা নিয়ে তিনি রেস্টুরেন্ট খোলেন। এখানে আর্মির বেশকিছু অফিসার খেতে আসতেন। তাঁদেরই একজন তাঁর বাইক চালানোর ভালবাসার কথা জানতে পারেন। তিনি তাঁকে আবারও বাইক চালানোর ব্যাপারে অনুপ্রাণিত করেন। তাঁর পরামর্শে দীপা দিল্লির বসন্তকুঞ্জের স্পাইন্যাল ইনজুরি সেন্টারে যান। সেখানে দীপাকে পরামর্শ দেয় হাত আর কাঁধের জোর বাড়াতে সাঁতার অনুশীলন করতে। সাঁতার অনুশীলন করতে গিয়ে সাঁতারকে ভালবেসে ফেলেন তিনি। স্থির করেন সাঁতারু হবেন। বার্লিনে আয়োজিত ওয়ার্লড চ্যাম্পিয়ানশিপ সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এখানে দশম স্থান পান। সাঁতার নিয়ে যখন তিনি এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন, চিকিৎসকেরা জানান সারা বছর তাঁর পক্ষে সাঁতার শেখা সম্ভব নয়। তাতে হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। সাঁতার ছেড়ে দীপা অ্যাথলেটিক্স বেছে নেন। কোচের পরামর্শে জ্যাভেলিনে আসেন।

২০১২ খ্রিস্টাব্দে প্যারা কমনওয়েলথ গেমসে অংশ নেন তিনি। ২০১৪ ও ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের এশিয়ান প্যারা গেমসে পদক জেতেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল প্যারা-অলিম্পিকে অংশ নেওয়া। কিন্তু ২০১২ সালের লন্ডন প্যারা-অলিম্পিকে সুযোগ মেলে না। ২০১৬-এর অলিম্পিকের জন্য জোর প্রস্তুতি নেন তিনি। তিন বছর কঠোর অনুশীলন করার পর পান চরম দুঃসংবাদ। অলিম্পিক কমিটি প্রতিযোগিতা থেকে জ্যাভলিন বাদ দিয়ে তার জায়গায় শটপাট ঢোকান। খবরটা তার কাছে ছিল চরম আঘাত। কিন্তু এত সহজে হার মানার পাত্রী দীপা নন। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় তিনি অংশগ্রহণ করবেন। নতুন করে শটপাট অনুশীলন শুরু করেন। এই সময় শারীরিক ও পারিপার্শ্বিক অনেক কঠিন ও অপমানজনক অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। যা-ই হোক, শেষমেশ অলিম্পিকে রুপো জেতেন তিনি। প্যারা অলিম্পিকের ইতিহাসে প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে এই কৃতিত্ব তাঁর। অর্জুন পুরস্কার, পদ্মশ্রী পুরস্কার-সহ অসংখ্য সম্মান ও খেতাব পেয়েছেন তিনি। নিজেকে দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন প্রতিবন্ধকতায়, হতাশায় ভেঙে না পড়ে যদি জেদ আর ইচ্ছাশক্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায় তা হলে সাফল্য ধরা দিতে বাধ্য।

আরও পড়ুন-গানের কবি

মালাথি কৃষ্ণমূর্তি হোল্লার কথা হয়তো অনেকেই জানেন না। ১৯৫৮-এর ৬ জুলাই কর্নাটকের কোটায় তাঁর জন্ম। একবছর বয়সে পোলিও আক্রান্ত হয়ে ঘাড় থেকে শরীরের নিম্নাংশ অসাড় হয়ে যায়। চিকিৎসা করে পরবর্তীকালে শরীরের ওপরের অংশের জোর বাড়লেও কোমর থেকে নিচের অংশ অসাড় থেকে যায়।
ছোটবেলায় বন্ধুদের ছোটাছুটি করতে দেখে তারও খুব ইচ্ছে হত দৌড়তে। কিন্তু একটা সময় কঠোর বাস্তবটা বুঝে যান। শিক্ষাই তাকে এই জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে পারে— এই ভবনায় বাবা তাকে স্কুলে ভর্তি করেন। এদিকে চিকিৎসাও চলছিল। পড়াশোনা করার সময় তার শরীরের উপরাংশের শক্তি বৃদ্ধি পায়। মালাথির মনের মধ্যে খেলাধুলোর প্রতি ভালবাসা ছিল। বেঙ্গালুরুতে মহারানি কলেজে পড়াশোনা করার সময় তিনি খেলাধুলো করতেন। পরবর্তী সময়ে স্থির করেন হুইলচেয়ার স্পোর্টস-এ অংশ নেবেন। লড়াকু ছিলেন তিনি। চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসতেন। স্পোর্টসকে বেছে নেন জীবনের অঙ্গ হিসেবে।

১৯৭৭ সালে সিওল প্যারা অলিম্পিকে তিনি দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এরপর বার্সেলানা, এথেন্স আর বেজিং প্যারা অলিম্পিকেও তিনি অংশ নেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিলে ৩৮৯টি সোনা, ২৭টি রুপো ও ৫টি পদক লাভ করেছেন তিনি। পেয়েছেন অর্জুন পুরস্কার, পদ্মশ্রী পুরস্কার। শারীরিক প্রতিবন্ধী শিশুদের সাহায্য করার জন্য মাথারু ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা গড়ে তুলেছেন তিনি। প্রতিবন্ধকতা জয় করে নিজের জীবনে জ্বেলেছেন সাফল্যের আলো। সেই আলোয় পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করছেন তাঁর মতো মানুষদের।
অরুণিমা সিনহার নামটি সকলের কাছে খুব পরিচিত। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ২০ জুলাই উত্তরপ্রদেশের আহমদনগরে তার জন্ম। তিনি ছিলেন জাতীয় স্তরের ভলিবল প্লেয়ার। ২০১১ সালের ১২ এপ্রিল তিনি পদ্মাবতী এক্সপ্রেসে করে লখনউ থেকে দিল্লি যাচ্ছিলেন সিআইএসএফ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। রাত একটার সময় কিছু ডাকাত সেই ট্রেনে উঠে যাত্রীদের জিনিসপত্র লুঠ করতে থাকে। তারা তাঁর গলার চেন ছিনিয়ে নিতে গেলে সাহসী অরুণিমা বাধা দেন। ডাকাতরা তাঁকে চলন্ত ট্রেন থেকে ফেলে দেয়। সেই সময় উল্টোদিক থেকে একটি ট্রেন আসছিল। সেটি তাঁর এক পায়ের ওপর দিয়ে চলে যায়।

সকালে গ্রামবাসীরা তাঁকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করে। পরবর্তী সময়ে ক্রীড়ামন্ত্রীর সহায়তায় তাঁকে AIMS-এর ট্রমা সেন্টারে ভর্তি করে। হাসপাতালে থাকার সময় তাঁর দুর্ঘটনা নিয়ে নানান বিভ্রান্তিকর ও অপমানজনক বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অরুণিমা স্থির করেন এর জবাব দেবেন। হাসপাতালের বেডে শুয়েই স্থির করেন এভারেস্টে উঠবেন। তাঁর কথা হাসপাতালে যারা শুনত তারা হাসত। ভাবত দুর্ঘটনার কারণে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। যা-ই হোক, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বাড়ি না গিয়ে তিনি সরাসরি বাচেন্দ্রী পালের কাছে যান। তাঁর জেদ আর মনোবল দেখে বচেন্দ্রী পাল মুগ্ধ হন। সাহস দিয়ে বলেন, ‘তুমি ইতিমধ্যেই এভারেস্টে উঠে গেছ। এখন কেবল বাকি বিশ্ববাসীর কাছে সেটা প্রমাণ করে দেখানো।’
এরপর শুরু হয় তাঁর কঠোর সংগ্রাম। প্রথম-প্রথম অনুশীলন করতে প্রচণ্ড কষ্ট হত। অদম্য জিদ নিয়ে তিনি অনুশীলন চালিয়ে যেতে থাকেন। অবশেষে স্বপ্ন সফল হয় তাঁর। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি এভারেস্ট জয় করেন। অরুণিমা হলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি এক পা নিয়ে এভারেস্টে উঠেছেন। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। এরপর একে একে জয় করেছেন মাউন্ট কিলিমাঞ্জারো, মাউন্ট এলব্রুশ, মাউন্ট কাসিয়াসিকো, মাউন্ট অ্যাঙ্কারাগুয়া, ক্রিস্টেন পিরামিড ও মাউন্ট ভিনসেন। পদ্মশ্রী পুরস্কার-সহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে লিখেছেন সাফল্যের কথা। মানুষকেও ভাবতে বাধ্য করিয়েছেন তাঁকে নিয়ে।

বিশ্ব ইতহাসের পাতা ওল্টালে আমরা খুঁজে পাই এরকম অসংখ্য মানুষকে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যাঁদের হার মানাতে পারেনি। উল্টে তাঁদের ইচ্ছাশক্তি, অদম্য জেদ আর লড়াকু মানসিকতার কাছে হার মেনেছে সমস্তরকম প্রতিবন্ধকতা। আর সেই সকল মানুষ জীবনে সাফল্যের ইতিহাস রচনার পাশাপাশি সকলের সামনে নিজেদের তুলে ধরেছেন আলোক পথযাত্রী হিসেবে।

Latest article