মণিপুর (Manipur) নামের একটি ছোট্ট রাজ্যকে নিয়ে দেশের সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব হয়ে গেল। গত মে (২০২৩) মাসের প্রথম থেকে ক্রমাগত অশান্তি চলছে। ৭৯ দিন প্রধানমন্ত্রী রা কাড়েননি। অনাস্থা প্রস্তাবের জবাবিতে যা বলেছেন তা যে কোনও তৃতীয় শ্রেণির রাজনীতিবিদকে হার মানাবে। আপাতত এসব আলোচনা থাক। পরে হবে।
মণিপুরে (Manipur) ৩টি জনগোষ্ঠী— মেইতেই, কুকি ও নাগা। ২০১১ সালের জনগণনায় মেইতেই ৫৩ শতাংশ, কুকি ২৬ শতাংশ, নাগা ১৭ শতাংশ। ইংরেজ আমলে তৎকালীন রাজা বোধচন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল মেইতেইরা উপত্যকায় থাকবে। যা মণিপুরের মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশ। নাগা-কুকিরা থাকবে পাহাড়ে। স্বাধীনতার পূর্বে মেইতেইরা আদিবাসী হিসাবে গণ্য হতেন। (আদিবাসী শব্দটি এখন তফসিলি জাতি হিসাবে গণ্য) ১৯৪৯ সালে ভারত-মণিপুর সংযুক্তীকরণ হল। সেই চুক্তিতে শর্ত রইল মেইতেইরা আর আদিবাসী বলে গণ্য হবেন না। নাগা-কুকিরা আদিবাসী থাকবেন। ভারতের সংবিধানের ৩৭১(সি) ধারা অনুযায়ী যাঁরা আদিবাসী নন তাঁরা আদিবাসী অঞ্চলে জমি কিনতে পারবেন না। ক্ষোভ বাড়তে শুরু করল মেইতেইদের মধ্যে। তাঁরা জনসংখ্যার ৫৩%, থাকেন ১০% জমিতে। তাঁদের এলাকায় অন্যরা জমি কিনতে পারছে। কিন্তু তাঁরা ১০% জমির বাইরে জমি কিনতে পারছেন না। তা ছাড়া রাজ্যের বাইরে থেকে মানুষ এসে উপত্যকা এলাকাতেই বাস করছে। মেইতেইরা মণিপুর হাইকোর্টে তাঁদের আদিবাসী স্বীকৃতি দাবি করে একটি রিট আবেদন করলেন। ২৭ মার্চের ঘটনা। হাইকোর্ট কেন্দ্র সরকার ও রাজ্য সরকারকে নোটিশ পাঠাল তাদের এ-ব্যাপারে মতামতের জন্য। সময়সীমা জুলাই মাস। সময় থেমে থাকে না। মে মাস থেকেই শুরু বড় হাঙ্গামার। কুকি-অধ্যুষিত চুড়াচাঁদপুরে দেখা গেল হিংস্রতার চূড়ান্ত আকার।
অন্য আদিবাসীদের বক্তব্য হচ্ছে— মেইতেইরা রাজার জাত। পুরনো আমল থেকে ২-১টা ব্যতিক্রম ছাড়া মেইতেইরা রাজা হয়েছে। লেখাপড়া, চাকরি সব কিছুতে তারা এগিয়ে। সমস্ত উন্নয়ন ও ইম্ফলকেন্দ্রিক। এরপর যদি মেইতেইরা আদিবাসী স্বীকৃতি পেয়ে আদিবাসী এলাকায় জমিজমা কিনতে শুরু করে তাহলে কুকি-নাগাদের কী হবে? সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের আদেশের ভিত্তিতে মণিপুর হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক এ-ব্যাপারে শুনানি স্থগিত আছে। ইতিমধ্যে কুকি-নাগা-সহ ১০টি আদিবাসী সংগঠন মঞ্চ গঠন করে সংহতি আন্দোলন শুরু করেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নাগাপ্রধান এলাকা নিয়ে নাগা রাজ্য গঠনের আন্দোলন এই সুযোগে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। নাগা রাজ্যে কুকিপ্রধান এলাকাও আছে।
মুখ্যমন্ত্রী বীরেন্দ্র সিং মেইতেই সম্প্রদায়ের। কুকিদের মত হল তিনি কেবলমাত্র মেইতেইদের স্বার্থরক্ষা করেন এবং তাঁদের কথায় চলেন। তার প্রমাণ যৌথ মঞ্চের নেতারা ইতোমধ্যে পেশ করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম সংরক্ষিত অরণ্যের সীমানা বাড়াতে পাহাড়ি এলাকার অনেক তথাকথিত বে-আইনি গ্রাম উচ্ছেদ করা হয়েছে। যেখানে কুকি বা নাগাদের বাস ছিল। মাদক ব্যবসা বন্ধ করতে পোস্তচাষের জমি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভারত-মায়ানমার সীমানায় কুকি-চিন-জো গোষ্ঠীর লোকজন মিলেমিশে থাকে। পারিবারিক শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে সীমানার দু’দিকে। অনেক সময় মায়ানমারের অশান্তির কারণে অনেকে সীমানা পেরিয়ে মণিপুরের মধ্যে চলে আসে। বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসাবে তাদের চিহ্নিত করা হয়। প্রত্যেকটা বিষয়ই কুকি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গেছে। বহুদিন থেকে কুকি ও মেইতেই দুই জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী আছে। এখন গ্রামরক্ষার নামে তারা আলাদা বাহিনী করেছে। বাঙ্কার তৈরি। সেনাবাহিনী বেছে বেছে কুকিদের বাঙ্কার ভেঙে দিচ্ছে। একটি রাজ্যের মানুষের মধ্যে যেন সেই দেশেরই সেনাবাহিনী যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সমস্যা সমাধানের কোনও রাজনৈতিক উদ্যোগ নেই।
আরও পড়ুন-বাবরি ধ্বংসের হোতার জীবনী, যোগীরাজ্যে স্কুলপাঠ্য
মাদক ও মণিপুরকে (Manipur) সমর্থক করে দেখানো হচ্ছে। আদিবাসীদের কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। প্রকৃত ঘটনা সংক্ষেপে জানা প্রয়োজন। তবে মাদকমুক্ত দেশ হোক এটা আমরা সবাই চাই। মাদক চাষ বন্ধ করে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা পপি বা গাঁজা চাষের বদলে অ্যালোভেরা ও প্যাশন ফ্রুট চাষের জন্য অর্থসাহায্য এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। কাজটা শুরুও হয়েছিল। কিন্তু অভিজ্ঞতায় বলছে এই চাষে সময় ও একাগ্রতা বেশি দিতে হয়। আর চাষ শেষ হওয়ার পর তার প্রক্রিয়াকরণ ও বাজারজাত করার ব্যাপারে কারও সাহায্য পাওয়া যায় না। আবার পুরনো চাষ ফিরে এল। মাদক চাষে কুকি-জো গোষ্ঠীদের উপর দোষ চাপানো হয়। সামান্য সংখ্যাতত্ত্বের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, ২০১৭-’২৩ সালের মধ্যে বেআইনি মাদক চাষ বা ব্যবসায় ধরা পড়েছে তাদের মধ্যে ৮৭৩ জন কুকি-জো, ৩৮১ জন মেইতেই, ১০৮৩ জন মুসলমান আর ১৮১ জন অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মানুষ। কুকি-জো গোষ্ঠী প্রধান এলাকাগুলির ১৩,১১২ একর ও নাগা জেলাগুলির ২,৩৪০ একর জমিতে পোস্ত চাষ হচ্ছে এমন সংবাদ রাজ্য প্রশাসনের কাছে আছে। মণিপুরের মানবাধিকার কর্মী বাবলু লুইথাং-বাম মনে করেন যে, মণিপুরের (Manipur) মাদকের ব্যবসা ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি। যা মণিপুর সরকারের বাজেটের চাইতে বেশি। মাদক ব্যবসা একটা সমান্তরাল অর্থনীতির জন্ম দিয়েছে। কিন্তু আসল রহস্য অন্য জায়গায়, মেইতেইরা হাতে করে পপি গাঁজার চাষ করে না। কিন্তু তারা ব্যবসাটা নিয়ন্ত্রণ করে। হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে। এখন দোষ চাপানো হচ্ছে আদিবাসীদের উপর। যারা ইতিমধ্যে হাজার হাজার ঘরবাড়ি ছেড়ে উৎখাত হয়েছে। অরণ্যের অধিকার হারাচ্ছে। চাষের অধিকার হারাচ্ছে। আদিবাসীদের মধ্যে বেশিরভাগই খ্রিস্টান। আর আছে কিছু মুসলমান। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে দিয়ে সংখ্যালঘুদের বিতাড়ন করা ও প্রান্তিক করে দেওয়া বিজেপির কৌশল। প্রধানমন্ত্রী সেই কারণে চুপ থাকতে পারেন।
(এরপর আগামীকাল)