নীলিমা বিশাল, অনুসূয়া রাই, স্নিগ্ধা শৈব, সুমিতা বর্মন, চিন্তামণি বিহা, রুবেয়া সুলতানা, প্রতিমা মাইতি, কৃষ্ণা রায়বর্মন, তারান্নুম সুলতানা মির, পম্পা পাল, নিবেদিতা মহাত… চেনেন কেউ এঁদের? নাম শুনেছেন কোনও টিভি মিডিয়ার সান্ধ্য ঝগড়ায়?
শুনবেন না। অথচ এঁদের হাত ধরেই নিঃশব্দে ঘটে গেছে পুরুষতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজের একটি অঙ্গরাজ্যে প্রায় বিপ্লব। এই এগারো জন মহিলা সকলেই নিজ জেলার জেলা সভাধিপতি। বাংলার তেইশটি জেলার মধ্যে এগারোটি জেলার কর্মভারের দায়িত্বভার এঁদের হাতে তুলে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ মহিলা রিজার্ভেশনের আওতায় এখন বাংলার অর্ধেক জেলা। নারী ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে এটা প্রশাসক হিসাবে আবারও মুখ্যমন্ত্রীর অসামান্য পদক্ষেপ।
সত্যিই নিঃশব্দ বিপ্লব। এ নজির বাংলায় তো বটেই গোটা দেশেই প্রথম। আমরা জানি, ২০১০ সালেই নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেশে তেত্রিশ শতাংশ মহিলা রিজার্ভেশন বিল পাশ হয়ে গেছে। সেখানে কত ভাইব্র্যান্ট, কত নামীদামি অর্থনৈতিক ভাবে সুসক্ষম রাজ্যে সরকার তো দূর বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও-এর ঢাক বাজানো কেন্দ্রীয় সরকারও নির্বাচনের ময়দানে নামার সময় কিন্তু মোটেও ভরসা রাখতে পারেন না নারীদের প্রতি। হাতে গোনা মহিলা ক্যান্ডিডেট যাদের প্রায় চোখেই পড়ে না পুরুষের ভিড়ে।
এখানেই পার্থক্য হয়ে যায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) বাংলার সঙ্গে বাকি দেশের। আজও গণতান্ত্রিক ভারতে কিন্তু পুরুষতন্ত্র স্বমহিমায় বিরাজমান। মুখে আমরা যতই নারী-পুরুষের সমানাধিকারের গলা ফাটাই। আদতে নারীরা এখনও ভারতে অনেকটা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মতো। পুরুষের ইচ্ছেয় চলে তার দিনযাপন। সেই জায়গায় এই দেশেরই একটি রাজ্যের বেশিরভাগ জেলা পরিষদ চালিত হবে মহিলা দ্বারা… ভাবা যায়! ওনার একের পর এক উদ্ভাবনী ভাবনা ডানা মেলে আজ আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়া এই ব্যতিক্রমী কাণ্ড করার ক্ষমতা বর্তমানে কারও নেই। যে ভরসা তিনি রেখেছেন তাঁর মহিলা কর্মীদের উপর তার জন্য সাহস লাগে। প্রত্যয় লাগে। যা অতীতে বাংলায় কোথাও দেখা যায়নি। কংগ্রেসের শেষদিক থেকে বামেদের চৌত্রিশ হয়ে পরিবর্তনের বারো বছর হয়ে গেল… তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়া এত মহিলা মন্ত্রী, বিধায়ক, সাংসদ কোনও দলে ছিল না। বামেদের আমলে খুব অল্প কয়েকজনকেই বাম সরকার তাদের মন্ত্রী কিংবা বিধায়িকা করেছিলেন। বাকিরা ওই ঝান্ডা-ধরা পর্যন্তই। অথচ এরাই মুখে সবথেকে বেশি প্রগতির বুলি আওড়ায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বপ্ন দেখিয়ে পালিয়ে যান না। তিনি স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেন। আর সেই কারণেই তাঁর কন্যাশ্রী আজ বিশ্বসেরা। তাই তো তিনি জেলা সভাধিপতির মতো ঝঞ্ঝাটময় কাজের দায়িত্ব অনায়াসে তুলে দিতে পারেন পুরুলিয়ার নিবেদিতা মাহাতো কিংবা মুর্শিদাবাদের রুবেয়া সুলতানদের উপর। যিনি রাঁধেন তিনি চুলও বাঁধেন… প্রচলিত একথা মুখ্যমন্ত্রী প্রায়দিনই বলেন। বাস্তবে নারী হয়ে নিজে করে দেখিয়েছেন বলেই বোধয় অন্যদের প্রতি এতটা বিশ্বাস তাঁর!
আশ্চর্য হয়েছি, এই খবর আজ পর্যন্ত কোনও মিডিয়ায় দেখানো হয়নি। সেই যে পঞ্চায়েতের যুদ্ধ থেকে যাদবপুরের পড়ুয়ার মৃত্যু হয়ে এখন ফ্ল্যাটের পজিশন না পাওয়া নিয়ে পরপর ঘণ্টাখানেক চলছে। কিন্তু পাশাপাশি বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে পঞ্চায়েত বোর্ড গঠন সম্পূর্ণ। কিন্তু এ-খবর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাল কাজের প্রচার করা হবে কিনা তাই ওটা বঙ্গ মিডিয়ার পক্ষে মেনে নেওয়া কার্যত অসম্ভব।
সাংবাদিক হিসাবে প্রায় ত্রিশ বছরের উপর বাংলার রাজনৈতিক ময়দানে ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। এটা অনস্বীকার্য যে বাংলায় মেয়েরা অনেক স্বাধীন। সে সংসারে হোক কি কর্মক্ষেত্রে। কিন্তু তথাকথিত চাকরি ব্যতিরেক সরাসরি সামাজিক প্রতিনিধিত্ব করার উদাহরণ খুবই কম ছিল। কিন্তু উন্নত দেশগুলিতে মহিলাদের সামাজিক ব্যাপ্তির আকাশ খুবই বিস্তৃত। সেই শূন্যস্থানও এবার হয়তো ধীরে ধীরে পূর্ণ হতে চলেছে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সংগঠনের একটা বিশাল অংশ জুড়ে আছে মেয়েরা। বলতে গেলে মেয়েরাই প্রথম এটা অনুভব করেছিল যে, ‘এই মেয়েটি আমাদের মতো।’ মেয়েদের সঙ্গেই একাত্ম হয়ে তিনি একের পর এক আন্দোলনের ভিত গড়ে তুলেছিলেন। আজ তাই তাঁর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, সবুজসাথী বিরোধীদের কাছে তুচ্ছ হলেও উনি জানেন লক্ষ্মীরাই সমাজের মূল চালিকশক্তি। মেয়েদের দিয়ে জেলা পরিষদ চালনা করার সিদ্ধান্ত মুখ্যমন্ত্রীকে সফলতার মুকুটে আরও একটি পালক সংযুক্ত করল বলাই যায়। এরা ব্লকে, পাড়ায়, গ্রামে, বুথে মানুষের মুখ হয়ে উঠবে। এদের পারিবারিক ইতিহাসে কোনও নামধারী ছাতা নেই তথাকথিত ‘দাদা’ নেই। বরং এরা খুবই সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা মহিলা। যারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আদর্শ মেনে আর তাঁর আশীর্বাদে নিজগুণে সমাজের দায়ভার স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করেছে। এদের সাফল্য আদতে সমাজে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব আরও প্রতিষ্ঠিত হবে। এরাই একদিন উজ্জ্বল মুখ হয়ে উঠবে গোটা বাংলার। সেই যে মার্ক্সের স্বপ্ন, গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলা… বাম আমলে শুধু স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছিল। আজ বদলে যাওয়া শাসকের বিচক্ষণতায় এদের দেখে সেই স্বপ্নকে যেন চোখের সামনে ভাসতে দেখছি। গ্রামের মেয়েদের চিরাচরিত সেই জড়তামাখা আড়ষ্টতা কেটে যাচ্ছে। সত্যিই গ্রাম যেন শহর ঘিরে ফেলেছে। এই এদেরই হাত ধরে বিভেদ মুছে যাবে শহর-গ্রামের।
এই তত্ত্ব কোনও অর্থনীতির মোটা মোটা বইয়ের পাতায় পাওয়া যাবে না। কোনও তাত্ত্বিকের গুরুগম্ভীর ক্লাসেও বুঝতে পারবেন না। সমাজ বদল শুধু স্লোগান দিলেই হয় না। সমাজের আর্থ সামাজিক বদল পিছিয়ে পড়াদের মূলস্রোতে ফেরানোর চেষ্টাতেই একমাত্র সম্ভব। সেই লক্ষ্যেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এইসব পদক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ওঁর এই তত্ত্ব বুঝতে যে শিক্ষা লাগে সেটা কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিতে পারবে না। এর জন্য দরকার শুধু একটা উদার মনের। যে মনের ভাষা সমাজের দুর্বলরা সহজেই বুঝতে পারবে।
শেষে এটুকুই বলার যে, প্রাচীন কাল থেকেই নারীদের পিছনের সারিতে ঠেলে দেবার যে ট্র্যাডিশন শুরু হয়েছিল তা সময়ের পরতে পরতে কিছুটা অবলুপ্ত হলেও এখনও ভারতীয় সমাজে মেয়েদের সামাজিকভাবে এগোনোর পথে বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। বাংলা তথা ভারতবর্ষের একমাত্র মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর নেওয়া এই অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক পটভুমিতে কি বটবৃক্ষ প্রতিষ্ঠিত হল? সময় একদিন এর উত্তর দেবে।