আজ থেকে প্রায় আটশো থেকে এক হাজার বছর আগে বাংলা ভাষায় রচিত চর্যাপদে বাংলার অন্ত্যজ চণ্ডাল শ্রেণির উল্লেখ পাওয়া যায়, যারা মূল নগরের অভ্যন্তরে বসবাসের অধিকার পেত না। তারা হাতে লোহার বালা পরবে, মাথায় পাগড়ি থাকবে, শ্মশানে মৃতদেহ সৎকার করবে— এমনই ছিল মধ্যযুগের বাংলায় চণ্ডালদের জন্য সামাজিক বিধান। ঔপনিবেশিক শাসনকালেও চণ্ডাল সম্প্রদায়ের প্রতি উচ্চবর্ণের ‘বিচার’ অপরিবর্তিত ছিল। ঔপনিবেশিক বাংলায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু। তারা সাধারণভাবে ‘দলিত’ বা ‘তফসিলি সম্প্রদায়’ নামে পরিচিত। দলিত হিন্দুদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই ছিল চণ্ডাল সম্প্রদায়ভুক্ত। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে এই সম্প্রদায়ের নাম হয় ‘নমঃশূদ্র’। পূর্ববঙ্গের হিন্দু কৃষকদের মধ্যে ৯০ শতাংশই ছিল নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ভুক্ত। ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, যশোহর, ফরিদপুর, বাখরগঞ্জ প্রভৃতি জেলায় নমঃশূদ্রদের আধিক্য ছিল। তারা সাধারণত চাষবাস, মাছ ধরা, তাঁত বোনা, অন্যের বাড়ি ও জমিতে দিনমজুরের কাজ করা প্রভৃতি পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিল।
উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এরা ছিল মূলত দরিদ্র চাষি। তাদের বেশিরভাগই উচ্চবর্ণের জমিতে মজুরের কাজ করত। অনেকে ঘর ছাওয়া, নৌকা বাওয়া প্রভৃতি কাজ করত। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নমঃশূদ্রদের ঘৃণার চোখে দেখত এবং ‘চণ্ডাল’ বলত। নদীনালা, বনজঙ্গল প্রভৃতির ধারে বসবাসকারী চণ্ডালদের মধ্যে শিক্ষার প্রসারের সুযোগ তো দূরের কথা, উচ্চবর্ণের উঠোন দিয়ে হাঁটাও ছিল তাদের অপরাধ। উচ্চবর্ণের বাড়িতে কাজ করলেও তাদের জন্য পৃথক মাটির থালায় পৃথক খাবার আসত, যা বাড়ির মূল ফটকের বাইরে বসে তাদের খেতে হত। অশিক্ষা, অচিকিৎসা, দারিদ্র, রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতার অভাব ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। ব্রিটিশ শাসনকালে সরকার এবং তাদের অনুগত জমিদারশ্রেণি নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের উপর তীব্র শোষণ-পীড়ন ও সামাজিক অবিচার চালায়। সমাজ চারিদিক থেকে তাদের বেঁধে রেখেছিল। সামাজিক ক্ষেত্রে অস্পৃশ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চাদপদ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নিঃস্ব, যুগে যুগে উচ্চবর্ণের বঞ্চনা ও অবহেলার শিকার এই দলিতরা ভারতীয় সমাজের চরম অবিচারের শিকার ছিল। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়, “এই দলিতরা— ঘুঁটে কুড়োনির ছানা। এ দুয়ারে যায় ‘দূর, দূর!’ ও দুয়ারে যায় ‘ছেই, ছেই!’”
সমাজের যাবতীয় কাজকর্ম যাদের হাতে সম্পন্ন হত, বাংলায় সেই চণ্ডাল সম্প্রদায়ই যুগ যুগ ধরে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত ছিল। অথচ তাদের সংখ্যা, শক্তি, মেধা কোনওটিই কম ছিল না। নিপীড়ণ থেকে তাদের মুক্তি দিতে এই সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২-১৮৭৮)। উচ্চবর্ণের শোষণ, লাঞ্ছনা, অবহেলা থেকে এই সম্প্রদায়কে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন পথে নিজ সম্প্রদায়ের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। ১৮৩২-৩৪ সাল থেকে চণ্ডালদের প্রতি উচ্চবর্ণের সামাজিক বৈষম্যের প্রতিবাদে তিনি সরব হতে শুরু করেন। এই প্রতিবাদ ১৮৭২-৭৩ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয়। এই সময় ফরিদপুর-বাখরগঞ্জ অঞ্চলের এক বিশিষ্ট নমঃশূদ্র নেতার মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে উচ্চবর্ণের লোকজন আসতে অস্বীকার করায় শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের নেতৃত্বে নমঃশূদ্ররা উচ্চবর্ণের সঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। উঁচুজাতের কৃষিকাজ, ঘর ছাওয়া বা অন্যান্য কাজ করতে নমঃশূদ্ররা অস্বীকার করে। কিছুকাল পর তিনি ‘মতুয়া’ (Matua) নামে ধর্মীয় সংগঠনের মাধ্যমে নমঃশূদ্রদের ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। মতুয়া ভাবধারাকে কেন্দ্র করে ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে নমঃশূদ্রদের আন্দোলনে নতুন গতি আসে।
আরও পড়ুন: কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতি, পেট্রোপণ্য, ওষুধ ইত্যাদির দামবৃদ্ধি প্রতিবাদে উত্তাল দক্ষিণবঙ্গ
হিমালয়-সম সামাজিক বৈষম্য দূর করার যে কাজ শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর শুরু করেছিলেন, তা তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তাই তাঁর সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্বের হাল ধরেন তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর। শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ ঠাকুর আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলেন। নমঃশূদ্রদের ঐক্যবদ্ধ করা, তাদের কর্মতৎপর করে তোলা, তাদের মধ্যে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটানো, রাজনৈতিক আঙিনায় এই সম্প্রদায়কে প্রস্তুত করা প্রভৃতি উদ্যোগে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন। ‘মুখে নাম, হাতে কাম’, ‘যার দল নাই, তার বল নাই’, ‘যে জাতির রাজা নাই, সেই জাতি তাজা নাই’ প্রভৃতি ভাবধারা প্রচার করে তিনি চণ্ডাল জাতির মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করেন। আবার গুরুচাঁদ ঠাকুরের আন্দোলনের ধারাকে পরবর্তীকালে বহন করেছেন তাঁর নাতি প্রমথরঞ্জন ঠাকুর। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর প্রমথরঞ্জনের পরিবার এবং মতুয়াদের একটি বড় অংশ পূর্ববঙ্গ থেকে ভারতে চলে আসে এবং তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত হতে থাকে।
তবে পশ্চিমবঙ্গে বাম দলগুলি বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ কলে বামফ্রন্টের শাসনকালে নমঃশূদ্র-মতুয়াদের সামাজিক আন্দোলনের গতিকে সুকৌশলে দুর্বল করার চেষ্টা করেছিল, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচনে দুই নমঃশূদ্র নেতা প্রমথরঞ্জন ঠাকুর ও যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়া এই আন্দোলনের যথেষ্ট ক্ষতি করেছিল বই কী! যাই হোক, ঠাকুরনগরের মতুয়া (Matua) ঠাকুরবাড়ির ছত্রছায়ায় সেই সামাজিক আন্দোলনের ধারা আজও বহমান।
দলিত মতুয়া-নমঃশূদ্রদের (Matua) যতটুকু সামাজিক অগ্রগতি ঘটেছে, সামাজিক অগ্রগতির সূত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ঘটেছে, তার মূলে রয়েছে শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের উদ্যোগে শুরু হওয়া মতুয়া আন্দোলন। এখন মতুয়া সম্প্রদায়ের সামাজিক অগ্রগতি অনেকটাই চোখে পড়ে। কিন্তু এটুকু অগ্রগতিই যথেষ্ট নয়। কেননা, অনগ্রসর মতুয়া সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ আজও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, বঞ্চিত নাগরিক অধিকার থেকেও। বহু উদ্বাস্তু মতুয়া (Matua) পরিবার আজও ফুটপাথে পড়ে থেকে কায়ক্লেশে দিন যাপন করেন। শিশু শ্রমিক এই সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচুর। একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও তাদের অস্পৃশ্যতার শিকার হতে হয়। তাই আজ থেকে দেড়শো বছর আগে শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুর উচ্চবর্ণের বঞ্চনা, অবহেলা, অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে যে সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছিলেন, তা আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
তিথি অনুযায়ী আজ শ্রীশ্রীহরিচাঁদ ঠাকুরের ২১১তম জন্মবার্ষিকী। আজ রাজ্য সরকার ছুটি ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এত কিছু উদ্যোগ সেদিনই সম্পূর্ণ অর্থবহ হয়ে উঠবে, যেদিন সামাজিক অনগ্রসরতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে এই সম্প্রদায় সকলের সমান সামাজিক মর্যাদা লাভ করবে।