স্ত্রীশিক্ষা আমাদের সমাজে এক বিপ্লবের জন্ম দেয়। শিক্ষাকে আশ্রয় নারীদের উন্নতি সমাজকে এক নতুন আলোর দিকে অগ্রসর করে। যুগ যুগ স্ত্রীলোকের সীমানাকে অন্দরমহলের চৌহদ্দির মধ্যে বন্দী করে তাদের স্বাধীনতার যে ডানা কেটে রেখেছিল পুরুষসমাজ, সেখান থেকে স্ত্রীজাতিকে উদ্ধার করতে বঙ্গসমাজে তথা ভারতভূমিতে যিনি আবির্ভূত হলেন তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (Pandit Ishwar Chandra Vidyasagar)। ইংরেজদের হাত ধরে উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে কলকাতায় নারীশিক্ষা সমিতি স্থাপিত হয়, তার কয়েক বছরের মধ্যেই স্থাপিত হয় কলকাতায় মেয়েদের জন্য আটটি স্কুল। শ্যামবাজারের কাছে মুসলিম মেয়েদের জন্য আলাদা একটি স্কুল তৈরি হয়। ১৮২৩-২৪ সালের মধ্যে কলকাতায় মেয়েদের স্কুলের সংখ্যা প্রায় বাইশটি। এরপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরেই সমাজে প্রকৃত নারী-শিক্ষার প্রচলন হয়েছে। মেয়েদের স্কুলে প্রধানত পুঁথিগত বিদ্যা-শিক্ষার কোন স্থান ছিল না। সেলাই শেখা, হাতের কাজ শেখা, অল্প বিস্তর হিসেব নিকেশ, গল্প পাঠ এইসবই ছিল তাঁদের শিক্ষার বিষয়। অন্যদিকে ছেলেদের জন্য ছিল নির্ধারিত সিলেবাস, যেখানে তাদের বিজ্ঞান ও গণিতেরও চর্চা করতে হত। ছেলে এবং মেয়ের শিক্ষার বিষয় নিয়ে এই ভেদাভেদ সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি করে এবং মেয়েদের ভাবতে বাধ্য করায় তাদের বোধ ও বুদ্ধি ছেলেদের সমকক্ষ কখনওই হতে পারে না , পারবেও না। কিন্তু ১৮৫৬ সালে ঈশ্বরচন্দ্র স্কুলের ইন্সপেক্টর পদে নিযুক্ত হলে, তিনি প্রথমেই লক্ষ করেন এই বৈষম্যকে। ছেলেদের নির্দিষ্ট সিলেবাস থাকলেও, উপযুক্ত পাঠ্য পুস্তক নেই এবং মেয়েদের আদতে কোন শিক্ষার উন্নতি নেই। তাই তিনি প্রথমে কম্বাইন্ড পড়াশুনার ব্যবস্থা নেন। ফলে ছেলেদের সিলেবাসেই মেয়েদের পড়াশুনার ব্যবস্থা হয়। এর ফলে মেয়েদের মধ্যেও এক বিশ্বাস ও বোধের উন্মোচন হয়। সঠিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ পেলে, সঠিক শিক্ষা পেলে তারাও যে সমাজের নানা সংস্কার থেকে মুক্ত হয়ে এগিয়ে যেতে পারবে এই বোধের জন্ম দেন বিদ্যাসাগর। তিনি শেখান সমাজের বিধি ও সংস্কার ভাঙার থেকেও সহজ কাজ এই সিলেবাস আয়ত্ত করা এবং একবার সিলেবাস আয়ত্ত করে ফেললে সহজেই ভেঙে ফেলা যাবে প্রচলিত সমস্ত কুসংস্কার ও অমানবিক নিয়মাবলী। তাঁর উৎসাহে মেয়েরা শিক্ষা গ্রহণে আরও বেশি আগ্রহী হয়ে পরে। ধীরে ধীরে ছাত্রীর সংখ্যা স্কুলগুলিতে বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে বেথুন সাহেবের সঙ্গে সহযোগিতায় বিদ্যাসাগর বেথুন স্কুলের প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার সর্বত উন্নতির চেষ্টা করেন। পরবর্তী সময়ে বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় স্কুলটি কলেজে পরিণত হয়। বিদ্যাসাগর মনে করতেন এক মাত্র শিক্ষার দ্বারাই সমাজের কল্যাণ যেমন সম্ভব তেমনই মেয়েদের কল্যাণের জন্যও এই শিক্ষাকেই অস্ত্র করে তুলতে হবে। প্রথম থেকেই তিনি বাল্যবিবাহের মতো অনৈতিক প্রথার বিরোধী ছিলেন। মেয়েদের ক্ষেত্রে অল্প বয়সে বিবাহ এবং ভাগ্য বিড়ম্বনায় সংসার বুঝে ওঠার আগেই বৈধব্য এক অমানবিক যন্ত্রণা। অল্প বয়সে বধূ হওয়ায় পিতা মাতার স্নেহ থেকে বঞ্চনা একটি মেয়ের জীবনকে অনেকাংশে শূন্য করে দেয়। দিনের পর দিন শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে একটি মেয়ের জীবন নরকের থেকেও অধিক যন্ত্রণাময় হয়ে ওঠে। আর, অকাল বৈধব্যের যে কষ্ট তা ব্যাখ্যার অতীত। সেকারণেই বিদ্যাসাগর মনে করেছিলেন এক মাত্র শিক্ষার আলোই পারবে মেয়েদের জীবন থেকে যাবতীয় অন্ধকার দূর করতে। ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে একই শিক্ষায় শিক্ষিত হলে মেয়েদের মধ্যে জন্মাবে আত্মবিশ্বাস। সেই বিশ্বাসকে সঙ্গী করে তারা লড়াই করতে পারবে সমাজের যাবতীয় কুপ্রথার বিরুদ্ধে, তাদের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচার, নিপীড়ন ও অবহেলার বিরুদ্ধে। বিদ্যাসাগর লক্ষ করেছিলেন, কলকাতার তুলনায় গ্রামের দিকে মেয়ের ওপর অন্যায়ের মাত্রা অধিক। সেকারণে তিনি গ্রামে শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারের চেষ্টা করেন। তাঁর উদ্যোগে গ্রামগুলিতে একের পর এক স্কুল প্রতিষ্ঠা হল। সেখানেও শুরু হল প্রকৃত শিক্ষার পাঠদান। গ্রামীণ সমাজের মেয়েরা সব থেকে বেশি সামাজিক শোষণ ও নির্যাতনের শিকার। তাদের মুক্তির পথ দেখাতে পারে একমাত্র শিক্ষা। নারীশিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের এই পদক্ষেপ সমাজের উন্নতির পথকে আরও মসৃণ করে তোলে। নারীশিক্ষার থেকে সমাজ থেকে বাধাও এসেছিল অনেক। তার মধ্যে প্রধান ধর্মের বাধা। ধর্মের ভয় দেখিয়ে মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণের থেকে বঞ্চিত করতে যারা চেয়েছিল তাদের নিবারণের পথ খুঁজে নিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। কলকাতায় পালকি করে যে মেয়েরা স্কুলে আসত তাদের পালকির গায়ে লিখে দিয়েছিলেন মহানির্বানতন্ত্রের একটি শ্লোক – “কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষানীয়াতি যত্নতঃ” অর্থাৎ, পুত্রের ন্যায় কন্যা সন্তানকেও পালন করতে ও শিক্ষা দিতে হবে। মেয়েদের শিক্ষাদানের যে সংকল্প বিদ্যাসাগর (Pandit Ishwar Chandra Vidyasagar) করেছিলেন তা তিনি যথাযথ পালনের চেষ্টাও করেছেন আজীবন। হাওড়া, হুগলী, বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগণার প্রত্যন্ত গ্রামেও তিনি প্রায় পঁয়ত্রিশটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে সক্ষম হন নিজের খরচায়। পরে এই সাধু উদ্যোগে সরকারি সাহায্য পান তিনি। বিভিন্ন জেলায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘স্ত্রী শিক্ষা বিধায়নী সম্মিলনী’। স্ত্রীশিক্ষায় তাঁর সর্বশেষ কর্ম মাতা ভগবতী দেবীর স্মৃতিতে বীরসিংহ গ্রামে ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ভগবতী বিদ্যালয়’। স্ত্রীশিক্ষায় বিদ্যাসাগরের যে অন্তরের নিষ্ঠা ছিল তার জন্যই মেয়েরা ধীরে ধীরে হলেও নিজেদের ডানা মেলতে পেরেছে, উড়তে শিখেছে।
আরও পড়ুন: পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন মুখ্যমন্ত্রীর