ধর্মতলার কে সি দাশ, গোলপার্কের গোলবাড়ি, শ্যামবাজারের পাঁচমাথা কিংবা শিয়ালদার প্রাচী, গুগল লোকেশন আসার বহু আগে থেকেই কলকাতা-ম্যাপের অপরিহার্য পয়েন্ট। শুধুমাত্র দোকান, বাড়ি, স্ট্যাচু কিংবা ‘হল’ নয়, এ শহরের মানুষের আবেগ ও ইতিহাসের অংশীদার এগুলি। তাই সবার আগে জানতে চাইব ‘প্রাচী’-র ইতিহাসের কথাই।
বিদিশা : একদম সঠিক কথাই বলেছেন। ইতিহাসের অংশীদার বা সাক্ষী যেটাই বলুন সেটা সত্যি। কারণ আমাদের স্বাধীনতার ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে প্রাচী-র যাত্রা শুরু। দিনটা ছিল ২৭ অগাস্ট । কিন্তু তিথি ছিল জন্মাষ্টমী। আমরা পারিবারিকভাবে প্রথম থেকে এই তিথিটাই উদযাপন করি হল-এর জন্মদিন হিসেবে। আসলে প্রাচী শুধুমাত্র একটা বিল্ডিং বা সিনেমা হল নয়, প্রাচী আমাদের পরিবারের অন্যতম সদস্য।
এই যে এত বছর আগে একটা সিনেমা হল তৈরির পরিকল্পনা, এটা কার ভাবনাপ্রসূত? হঠাৎ সিনেমা হল তৈরি কি ব্যবসার অঙ্গ হিসেবেই?
বিদিশা : প্রাচী তৈরি করেছিলেন আমার দাদু, মানে আমার বাবার কাকা জিতেন্দ্রনাথ বসু। ঠিক ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে শুরুটা হয়নি বলেই শুনেছি মা’র কাছ থেকে। আমাদের পরিবারে বরং শিক্ষাগত দিকে, কালচারাল দিকেই বেশি নজর দেওয়া হত। দাদু ছিলেন এমএসসি, এলএলবি, আমার বাবা ড. দীপেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রফেসর, কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয়ের ওপর বাবার থিসিস পেপার আছে। আমরা দুই বোন। ছোট থেকে আমাদেরও পড়াশোনার ওপরেই ধ্যান দেওয়ার কথা বলা হত। সিনেমা হল তো দূর, সিনেমা সংক্রান্ত কোনও কিছু আলোচনাতেই আমাদের রাখা হত না। দিদি লেখালিখি করে এখনও আর আমিও পড়াশোনা শেষ করে কর্পোরেট সেক্টরে ছিলাম। তাই ব্যবসায়িক লাভ-লোকসানের জন্য ঠিক ‘হল’ তৈরি হয়নি আমাদের। দাদুর সংস্কৃতি জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিলেন। তখনকার দিনে ‘স্পোর্টস অ্যান্ড স্ক্রিন’ নামে একটা ম্যাগাজিন বের হত। দাদু তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আরও নানা কালচারাল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এসব অ্যাসোসিয়েশনের কারণেই দাদুর মনে এই আইডিয়া এসেছিল। আসলে সিনেমা হল তখন ব্যবসার চেয়েও সংস্কৃতির অঙ্গ বেশি ছিল।
তার মানে পরিবারে একটা বাঙালি সংস্কৃতির ধারা বরাবর ছিল। সে কারণেই কি প্রাচী ধীরে ধীরে বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছিল?
বিদিশা : এই দিকটায় আসলে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে শুরু থেকেই জোর দেওয়া হয়েছিল। কথায় বলে যে কোনও জিনিসের শুরু নিজের পরিবার থেকে হয়। মনের জোর বলুন কিংবা সাহস আসে পরিবারের অন্দর থেকেই। আমাদের বাড়িতে ঐতিহ্য ও প্রগতিশীলতার একটা অদ্ভুত ব্যালান্স ছিল। একটু উল্লেখ করলে বর্তমান প্রাচী’র বিবর্তনের ধারাবাহিকতার রুটটা ধরা সুবিধের হবে। এখনকার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাভাবিক ঠেকলেও অতদিন আগে সামাজিক প্রেক্ষাপট কিন্তু অনেক আলাদা ছিল। কিন্তু আমাদের পরিবারে ছেলেমেয়ের পার্থক্য করা হত না কোনওদিনই। বাবা মাইনরিটি মহিলাদের জন্য সে সময় কয়েকজনের সঙ্গে মিলে নাইট কলেজ করেছিলেন। তেরো বছর বয়সে আমার বাবার মৃত্যু হয়। আমার মা সেই সময় গৃহবধূ ছিলেন। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর আমাদের দুই বোনকে মানুষ করার পাশাপাশি দাদুর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ‘হল’-এর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। দাদু মা’কে বউমা কম, মেয়ে বেশি ভাবতেন। এরপর মা’ও যখন চলে গেলেন, দাদুর কথায় চাকরি ছেড়ে কলকাতা ফিরে আমি ‘হল’-এর দায়িত্ব নিলাম। দিদি যেমন সব সময় আমার পাশে আছে তেমনই আমার বিয়ের পর আমার স্বামীরও সম্পূর্ণ সাপোর্ট আমি পেয়েছিলাম। দুর্ভাগ্য গতবছর আচমকা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট-এ আমার স্বামীর মৃত্যু হয়। এখন আমি আমার আট বছরের ছোট মেয়ের দেখাশোনার সঙ্গে সঙ্গে ‘প্রাচী’র দেখভালও করি।
ভীষণ ব্যক্তিগত হলেও ভীষণ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা এটা বলতেই হয়। এর পরেও যেভাবে আপনি শহরের বুকে একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন প্রাচী’কে ঘিরে তা তো রীতিমতো ব্যক্তিগত ও পেশাদারি দুই ক্ষেত্রের লড়াইয়ের কথাই বলে।
বিদিশা : দেখুন, ভয়ঙ্কর ভেঙে পড়েছিলাম আমি। নিজেকে সামলাতে তাই খানিকটা সময়ও দিয়েছিলাম। তখন দুটো জিনিস মনে হয়েছে, সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতেই পারি কিন্তু তাতে জীবন থেমে থাকবে না, বিশেষত আমার ছোট্ট মেয়েটা আছে আর অন্যদিকে প্রাচী’ আমার বেড়ে ওঠার মানুষগুলোর, দিনগুলোর সঙ্গী যেমন তেমনই আরও অনেকগুলো মানুষের রুজি-রুটিও ওর সঙ্গে জড়িত। তাই সরে না গিয়ে, ছেড়ে না দিয়ে বরং এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি।
আপনার মনের জোর আর ভাবনাকে কুর্নিশ। ভাগ্যিস ভেবেছিলেন এভাবে তাই প্রাচী’র মতো একটা ঐতিহ্যমণ্ডিত সিনেমা হল নতুনভাবে ফিরে এল শহরের বুকে। এমন ভেঙে পড়া-পিছিয়ে পড়া আরও অনেক সিনেমা হল-মালিকদের উদ্দীপনা জোগাতে উদাহরণ হয়ে উঠল। এবার বলুন কী কী পরিকল্পনা আপনার প্রাচী ঘিরে।
বিদিশা : প্রাথমিক ভাবনাটা ছিল ঐতিহ্য বাঁচানোর। কিন্তু ঐতিহ্য বাঁচানোটার সেন্টিমেন্টাল দিক যেমন আছে তেমনই প্র্যাকটিক্যাল দিকও আছে। একটা পুরনো ভাঙা বিল্ডিংকে টিকিয়ে রেখে তো লাভ নেই। তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর সেই এগোনোটা হতে হবে সময়ের সঙ্গে এবং মানুষের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। একটা সময় ছিল যখন মানুষ শুধুই ছবি দেখার জন্য সিনেমা হল-এ যেত। এন্টারটেইনমেন্ট-এর পরিভাষাটা তখন ওটুকুই ছিল। এখন মানুষ সিনেমার পাশাপাশি সময়টাও উপভোগ করতে চায়। একটা গুড অ্যাম্বিয়েন্স চায়। কমফোর্ট চায়। সিনেমা দেখার সঙ্গে খাওয়া-দাওয়াও করতে চায়। আবার যেহেতু মানুষের হাতে সময়টা এখন ভীষণ কমে গেছে তাই একই লোকেশন-এ গিয়ে একটু ঘোরাঘুরি বা শপিং করার সুযোগ পেলে খুশি হন তাই প্রাথমিক ভাবনা শুরু করেছিলাম এগুলো মাথায় রেখেই। প্রথমেই তাই আমি এম বাজারের ফ্র্যাঞ্চাইজি নিই। একটা ফ্লোরে একেবারে মল কনসেপ্টে শপিং-এর ব্যবস্থা করি। এছাড়াও ফুড কোর্ট থাকছে আর টপ ফ্লোরে ‘হল’।
আচ্ছা, যদি আপনার কাছে খুব স্পেসিফিক্যালি জানতে চাই, এখনকার জেনারেশন মাল্টিপ্লেক্স ছেড়ে আপনার হল-এ কেন ছবি দেখতে যাবে?
বিদিশা : যাবে, তার কারণ এই মুহূর্তে প্রাচী’র সাউন্ড সিস্টেম, পিকচার কোয়ালিটি যে কোনও মাল্টিপ্লেক্সের সঙ্গে অ্যাট পার। কিন্তু প্রাইম টাইম টিকিটের দাম প্রাচী’তে অনেকটা কম। সুতরাং যাবতীয় অ্যামেনিটিস তারা এক পাবে অথচ টাকাও বাঁচছে। কোভিড ফেজ-এর জন্য ফুড কোর্ট আমি এখনও পপকর্ন ও কোল্ডড্রিঙ্ক-এ লিমিটেড রেখেছি, পরে আরও এক্সটেন্ড করব। এছাড়া ‘হল’-এর হেলথ অ্যান্ড হাইজিনের দিকে ভীষণভাবে খেয়াল রাখা হয়েছে। আর আগেই যেটা বললাম টুকটাক শপিং, টাইম পাসের পর সুন্দর একটা পরিবেশে সিনেমা দেখতে পারবে যে কেউ।
সব মিলিয়ে তার মানে সুন্দর একতা ব্যাপার। কোন কোন ছবি দিয়ে নতুন প্রাচী যাত্রা শুরু করেছিল?
বিদিশা : ‘মুখোশ’ আর ‘বেল বটম’। সরকারি সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হল হল খোলার তার এক সপ্তাহ বাদে আমরা শুরু করেছিলাম। কারণ ওই সপ্তাহে নতুন রিলিজ ছিল না। পুজোয় তিনটি বাংলা ছবি চালিয়েছি৷ ‘গোলন্দাজ’, ‘বনি’ ও ‘ষড়রিপু’৷
প্রাচীর একটা বৈশিষ্ট্য ছিল বাংলা সিনেমা নিয়ে । মানুষ কিছু বছর আগে পর্যন্ত বড় কোনও বাংলা ছবি রিলিজ মানেই বুঝত প্রাচী’র কথা। সেটা কি আর ধরে রাখতে পারবেন?
বিদিশা : দেখুন, এটা একদম ঠিক কথা যে একসময় নির্দিষ্ট কয়েকটি হল না পেলে প্রযোজক-পরিবেশকরা বাংলা ছবি রিলিজ পর্যন্ত পিছিয়ে দিতেন। প্রাচী তার মধ্যে অন্যতম ছিল। কিন্তু ওই যে বললাম, সারভাইভ করতে গেলে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। এখন শুধুমাত্র বাংলা ছবি চালিয়ে একটা ‘হল’ রান করা সম্ভব নয়। প্রাচীতে আমি অনেক আগেই নুন শো বা মর্নিং শোতে ইংরেজি ছবি চালানো শুরু করেছি। আগে যেমন হত এক-একটা বাংলা ছবি সপ্তাহের পর সপ্তাহ চলত, দর্শকও ছিলেন সেরকম । এখন তো শুধু বাঙালি দর্শক বা বাংলা ভাষার দর্শক সেই সংখ্যায় নেই। কসমোপলিটন কালচার সর্বত্র। তাই হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি সব ভাষার ছবিই আমি প্রাচী’তে চালাই।
তার মানে প্রাচী সব অর্থেই বিবর্তিত?
বিদিশা : অবশ্যই। তবে তার মধ্যেও আমি চেষ্টা চালিয়েছি আমাদের সিগনেচার ধরে রাখতে। আমাদের টিকেটিং সিস্টেমে, সিট অ্যারেঞ্জমেন্ট-এ এখনও বাংলায় লেখা হয়। কলকাতার আর কোনও হল-এ এটা আছে কি না জানি না। বাংলা ছবির টিকিট সব বিক্রি হয়ে গেলে আমরা এখনও ‘হাউসফুল’ না লিখে ‘প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ’ কথাটাই লিখি। এ প্রসঙ্গে দাদুর কাছে শোনা একটা গল্প মনে পড়ে গেল, সে সময় শুধুই বাংলা ছবি চালানো হত, উত্তমকুমার তখন ‘ছোটি সি মুলাকাত’ প্রোডিউস করেছেন ছবি রিলিজের সময় দাদু আর বাবাকে নাকি কনভিন্স করানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন, বাংলা ছবি না হলেও বাঙালি প্রযোজকের ছবি তো, প্রাচী’তে চালাতেই হবে। শেষ অবধি ওঁর অনুরোধ ফেলতে পারেননি ওঁরা। ‘ছোটি সি মুলাকাত’ প্রাচীতে চলেছিল। বলতে পারেন দাদু-বাবার সেই ধারাই আমি বয়ে নিয়ে চলেছি।
ছবি : সুদীপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়