২০০৫-এ ‘হারবার্ট’ ছবি দিয়ে আত্মপ্রকাশেই সাড়া ফেলেছিলেন পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায়। এরপর ‘চতুরঙ্গ’, ‘মহানগর@কলকাতা’, ‘কাঙাল মালসাট’, ‘শেষের কবিতা’, ‘অসমাপ্ত’ প্রতিটি ছবিতেই নিজের ‘সিগনেচার’ রেখেছিলেন সুমন। বলিউডে লাক ট্রাই করতে গিয়ে বাংলা ছবির সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল মাঝের সময়টায়। মুম্বইয়ে বেশ কিছু কাজের পর ফের ফিরছেন বাংলায় এবং স্বমহিমায়। বিষয় নির্বাচন অন্তত তাই বলছে। সুমন যদিও জানিয়েছেন, মনের মধ্যে বিষয়টি বহু আগেই নির্বাচিত হয়ে ছিল। কারণ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসটি আর পাঁচটা বাঙালির মতো তাঁর মননকেও ধাক্কা দিয়েছিল পড়া ইস্তক। সেই সঙ্গে বাবা নাট্যকার অরুণ মুখোপাধ্যায় যখন এই উপন্যাস মঞ্চস্থ করেছিলেন সেই নাট্যরূপ দেখার পর তাঁরও মাথায় ঘুরত কোনও দিন যদি সেলুলয়েডে তুলে ধরতে পারেন এই উপন্যাস! ২০০৮ থেকে সিরিয়াসলি ভাবলেও বাদ সেধেছিল উপন্যাসের রাইটস সংক্রান্ত জটিলতা ও বাজেট। একই সঙ্গে সুমন বর্তমানের বাংলা ছবির ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ ফরম্যাটে কোনওদিনই কাজ করেন না। ছবির বিষয়ের সঙ্গে যাপন তাঁর কাজের অন্যতম ধরন। তাই প্রস্তুতিপর্বেও কিছু সময় লেগেছে। কাজে লাগিয়েছেন লকডাউন পর্বকেও। তারপর এই ঘোষণা।
‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথমদিকের উপন্যাস। উপন্যাসে আছে একাধিক চরিত্র আর সেইসব চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের টানাপোড়েন ছাড়াও লেখক একই সঙ্গে গুরুত্ব দিয়েছেন তাঁদের নিজ নিজ মানসিক টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্বকেও। সুমন জানিয়েছেন, উপন্যাসের পুরো ক্যানভাসকে পর্দায় তুলে ধরা সম্ভব নয় আর সে চেষ্টা করাও উচিত নয় কোনও সাহিত্যকর্মের ক্ষেত্রেই। কারণ দুটো মিডিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন তাই তাদের বলা বা চলার ধরনও ভিন্ন হবে, সেটাই স্বাভাবিক। মূল উপন্যাসের সময়কালটা তাই তিনি খানিকটা এগিয়ে এনেছেন। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়কে ধরছেন তিনি। সেই সঙ্গে চরিত্রদের পারস্পরিক রসায়নকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ছবির একটা চমকপ্রদ কাস্টিংও করেছেন। প্রধান চরিত্রগুলো রূপায়িত করবেন আবির চট্টোপাধ্যায়, জয়া এহসান, পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। সুমন নিজে জানিয়েছেন, ‘‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র মতো উপন্যাসকে চিত্রায়িত করতে সবচেয়ে জরুরি ছিল দক্ষ অভিনেতা নির্বাচন আর জরুরি ছিল উপস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট। প্রযোজক সমীরণ দাস দুটি ব্যাপারেই আমায় সাহায্য করেছেন।”
মানুষের জীবন আদতে এক রঙ্গমঞ্চ। সেই মঞ্চে পুতুলনাচের পাত্র হয়েই তাকে কাটিয়ে দিতে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। আর অদৃশ্য এক সুতো তাকে নাচিয়ে চলে জীবনভর। এই সুতোর টানকে নিয়ন্ত্রণ করা তার হাতে থাকে না। তেমনই উপায় থাকে না এই সুতোকে টান মেরে ছিঁড়ে বেরিয়ে যাওয়ারও। গাওদিয়া গ্রামের ডাক্তার শশীও এই টানাপোড়েনেই তার সারা জীবন কাটায়। শশীর মনন দ্বিমুখী। তার জীবনে তার বাবার প্রভাব না চাইতেও থেকে যায় অদৃশ্যভাবে। একই সঙ্গে কুসুম, মতি, কুমুদ, গোপাল, যাদবের মতো চরিত্ররাও প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে তার ওপর প্রভাব ফেলে। শশী নিজেও বুঝতে পারে না সে আসলে কী চায়, কোনটা তার জীবনের জন্য সঠিক পদক্ষেপ, দৃঢ়চেতা হয়ে নিতে পারে না জোরালো কোনও সিদ্ধান্ত। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে জেরবার হয়। ফ্রয়েড-দর্শনে প্রভাবিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় শশীকে তার ইগো-সুপার ইগোর চক্করে বিস্তর ঘুরপাক খাইয়েছেন। চিরকাল গ্রামের বদ্ধ জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চাওয়া, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জীবনের স্বপ্ন দেখা শশী শেষ অবধি নিজের গ্রামের জীবনেই আবদ্ধ থেকে যায়।
আরও পড়ুন-মৌমাছি-চাষে লাভের রাস্তা দেখাচ্ছে কৃষি দফতর
শশীর চরিত্রে অভিনয় করবেন আবির। কুমুদের চরিত্রে পরমব্রত আর কুসুমের চরিত্রে জয়া। শশীর চরিত্রকে প্রাধান্য দিয়েই চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন সুমন। ‘বাস্তুশাপ’ এবং ‘শাহজাহান রিজেন্সি’র পর ফের আবির-পরমব্রত একসঙ্গে। জয়া এই বাংলায় পরপর ছবি করে যাচ্ছেন। আর অনন্যা চট্টোপাধ্যায়ের মতো অভিনেত্রীকে ছবিতে পাওয়া যাবে অনেকদিন পর। এই ছবিকে সুমন প্রাসঙ্গিকতা দিয়েও ব্যাখ্যা করেছেন। বর্তমান সমাজেও আমরা এক ব্যবস্থা দেখি। এক শ্রেণির মানুষের হাতে অর্থ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত। বাকি অংশের মানুষকে তারা পুতুলের মতোই নাচায়। গত প্রায় একটা পুরো শতাব্দী জুড়েই একটা ইন্টেলেকচুয়াল ফেলিওর-এর ছবি দেখা যায়। বুদ্ধিজীবী, শিক্ষিত মানুষেরা সচেতনভাবেই কম্প্রোমাইজ করে চলেছেন আর তাই আজ সমাজের একটা বৃহৎ অংশের মানুষ দ্বিধান্বিত জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়ে চলেছেন। শশী তারই একটা প্রতীক।
আপাতত শান্তিনিকেতনে এই ছবির আউটডোরের প্রস্তুতি চলছে। শুটিং শিডিউল সাজানো হয়েছে ২৫ দিনের। ছবির আবহসংগীতের দায়িত্বে আছেন প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা মঞ্চে ইতিমধ্যেই ফিরেছেন সুমন ‘ডন, তাকে ভালো লাগে’তে অভিনয় করেছেন পঁচিশ বছর পর। নতুন করে ‘মেফিস্টো’ মঞ্চস্থ করেছেন। এবার একই সঙ্গে চলচ্চিত্র ও মঞ্চ উভয় মাধ্যমেই কাজ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সুমন। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ তাঁর নতুনভাবে শুরুর পদক্ষেপ।