আরএসএস ও বিজেপি (RSS-BJP) একে অপরের পরিপূরক। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, দুটি সংগঠনেরই নানা পরিবর্তন হয়েছে। কখনও কখনও সেই পরিবর্তনগুলিকে মৌলিক বলে ভ্রম হতে পারে। আসলে নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে নিরঙ্কুশ শাসনক্ষমতা দখলই উভয় সংগঠনের ক্ষেত্রে একমাত্র পরিবর্তন বলে মনে হয়। বাকি যা-কিছু তার সবটাই শাসক হিসেবে স্বাভাবিক পরিবর্তন। মূল ভাবনাচিন্তা বা ভাবাদর্শ একই আছে। শাসক হিসেবে জনগণকে সমাবেশিত করার ক্ষেত্রে আরএসএস বিজেপি কৌশলের দিক থেকে নানা পরিবর্তন এনেছে।
প্রকৃত অর্থেই আরএসএসকে (RSS-BJP) আমরা যেভাবে দেখি, তা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। যা দেখা যায়, সঙ্ঘের প্রভাব তার থেকে অনেক বেশি। ২০১৪-র সাধারণ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদিকে পছন্দ করা এবং এগিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আরএসএস ক্যাডাররা নির্ণায়ক ভূমিকা নেয়। ২০১৯-এর নির্বাচন পর্যন্ত সেই ভূমিকার কারণেই জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির বিপুল উত্থান সম্ভব হয়। কীভাবে সঙ্ঘ নেতৃত্ব তাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক সংগঠনগুলির যৌথ প্রয়াসে ভারতীয় জনমানসের গভীরে প্রবেশ করে তা আরও ভাল করে জানা দরকার। বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী এই শক্তিকে ক্ষমতাচ্যূত করতে হলে, সমাজমানসে এদের প্রভাব খর্ব করা প্রয়োজন। সামাজিক ভাবে প্রভাব বিস্তারের জন্য সঙ্ঘশক্তি (বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, বিজেপি-সহ আরএসএস প্রভাবিত অসংখ্য সংগঠন) তাদের কাজের ধরন পাল্টেছে। তারা দলিত, ওবিসি, আদিবাসী এবং অন্যান্য প্রান্তিক মানুষের কাছে হিন্দুত্বের দক্ষিণপন্থী ভাবধারাকে নম্রভাবে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছে। ফলে ভারতের বিপুলতর মানুষের কাছে তারা পৌঁছে গিয়েছে। বর্ণভিত্তিক নির্বাচনী রাজনীতিকে মুছে ফেলার পরিবর্তে, তাকে ব্যবহার করে অনেকটাই লাভবান হয়েছে। এর জন্য তাদের বলতে হয়েছে, আমরা বর্ণবিদ্বেষী নই। আমরা দলিত-বিরোধী নই, আমরা ওবিসিদের পক্ষে এবং মুসলিম বিরোধী নই— এসব বিরোধীদের মিথ্যা প্রচার।
এইভাবে তারা সমাজের তৃণমূল স্তরের নতুন সামাজিক শক্তিকে নিজেদের পক্ষে অনেকটাই নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। হিন্দুত্ববাদী শক্তি এভাবেই ভারতীয় গণতন্ত্রের ধারাকে আত্মসাৎ করে। মুখে গণতন্ত্র এবং কাজে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরতন্ত্রের নয়া জমানার শুরু এভাবেই। এখন তার বিস্তার ঘটছে।
আরএসএস ও বিজেপির (RSS-BJP) সম্পর্কের বন্ধন যথেষ্ট শক্তিশালী। বিজেপিকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে আরএসএস-এর অবদান বিরাট। বিজেপি হল আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা। অন্যদিকে, সঙ্ঘের সহায়তায় বিজেপি বাস্তব ক্ষেত্রে ভারতীয় জনসাধারণের উপর তার কর্তৃত্ববাদী প্রভাব তৈরি করেছে। বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারে আরএসএস তার বিরাট কর্মীবাহিনীকে কাজে লাগিয়েছে। সরকারি নীতি ও কার্যক্রমকে সমর্থন করেছে। এবং করে যাচ্ছে।
২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সময়কালে আরএসএস নিজেকে একটি প্রভাব বিস্তারের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কেউ কেউ মনে করেন মোদি আরএসএসকে অকার্যকরী করে দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তব সত্য হল আরএসএস মোদিকে নিঃশর্ত সমর্থন করছে সব দিক দিয়ে। মোদির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে তারা সর্বাত্মক ভূমিকা নিয়েছে, তৃণমূলস্তর পর্যন্ত। মোদির মনোভাব এবং বিশ্ব দৃষ্টিকোণ আরএসএসের মধ্যে থেকেই গড়ে উঠেছে।
আরও পড়ুন-মাত্র দশ মাসে অসাধারণ সাফল্য রাজ্যের স্বাস্থ্য ইঙ্গিত প্রকল্পে
আরএসএস-বিজেপি (RSS-BJP) তাদের সাবেকি ধারণা বজায় রেখেই আধুনিক কলাকৌশলকে কাজে লাগাচ্ছে। ফোন-ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারে এরা সকলের থেকে এগিয়ে আছে। সাংগঠনিক যোগাযোগ এবং মিথ্যা প্রচারে সঙ্ঘশক্তি সকলকেই হার মানাচ্ছে। এসবের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী প্রচারে এদের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। সঙ্ঘ পরিবারের বড় বড় সংগঠন সম্পর্কে আমরা শুনেছি বা কিছুটা জানি। কিন্তু বিজেপি ক্ষমতা দখল করার পর সঙ্ঘবাদী হাজার হাজার আঞ্চলিক ও স্থানীয় সংগঠনের কথা আমরা ততটা জানি না। এদের সকলের কাজ হল— হিন্দু সচেতনতা এবং হিন্দুত্বের ভাবাদর্শের বিস্তার ঘটানো। এই প্রান্তিক সংগঠনগুলি উপেক্ষার মতো নয়। তাই আরএসএসের যা কিছু দৃষ্টিগোচর তার থেকে অনেক বেশি দৃষ্টিগোচর নয়।
বিরোধী পক্ষের গরমাগরম টিভি-বিতর্কের মধ্যে এদের প্রকৃত শক্তি ধরা পড়ে না। এদের নির্বাচনী বিজয় বা সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে এদের বর্ণনার মধ্যে যে সমালোচনা তা অত্যন্ত অগভীর চিন্তার প্রকাশ। আরএসএসের যে চালু ভাবমূর্তি, তার সমালোচনা করে থেমে থাকলে চলবে না। একই সঙ্গে এদের বর্তমান সময়ের রূপ ও কৌশলকে বুঝতে হবে। তা না হলে গোটাটাই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধের মতো হয়ে দাঁড়াবে। কখনও কখনও আরএসএসের কার্যকলাপ মোদির অ্যাজেন্ডার পক্ষে কাজ করে। কিন্তু এটা বুঝতে হবে আরএসএস একটু নতুন হিন্দুত্বেষর রাজনীতি গড়ে তুলছে। যা, সাভারকার, গোলওয়ালকারের রাজনীতি থেকে বেশ কিছুটা আলাদা। নতুন হিন্দুত্বের রাজনীতর মধ্যে বহুত্ববাদের কথা আছে। আছে সবাইকে হিন্দুত্বের মধ্যে টেনে আনার কথা। দলিত, ওবিসি, মুসলিম— সকলকে। হিন্দু রাষ্ট্রের লক্ষ্যকে সামনে রেখে, ভারতবাসী মানেই হিন্দু— এরকম এক ভাবধারা গড়ে তুলে সকলকে ভয় দেখিয়ে নির্বাক করে দেওয়ার এই ভয়ঙ্কর কৌশলের মুখোশ খুলে দিতে না পারলে, এদেশে এক নয়া ফ্যাসিবাদী শাসন গড়ে উঠবে। ওদের নতুন ধারণা সমাজের তৃণমূলস্তর পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে তৃণমূলস্তর পর্যন্ত পৌঁছতে হবে। দেখা যাবে ‘নতুন আরএসএস’ পুরনো আরএসএসকে ধারণ করেই এগোচ্ছে। আরএসএস এখন আধুনিক রাজনীতির শব্দ ব্যবহার করছে। গণতন্ত্রের কথা বলছে। নারী স্বাধীনতার কথা বলছে। শুধু প্রাচীন বৃদ্ধদের গোষ্ঠীবদ্ধ পশ্চাৎ-পদতার মধ্যে আবদ্ধ নেই। তবুও তার শিকড় প্রোথিত আছে হিন্দুত্ববাদের মূল ধারায়।
আজকের আরএসএস-বিজেপি স্বাধীনতা ও জাতীয় পতাকা নিয়ে গর্ব প্রকাশ করছে। আবার ৩৭০ ধারা বাতিল-সহ মুসলিম-বিরোধী নাগরিক আইন পাশ করছে। সরকার ও রাষ্ট্রকে এক করে দিচ্ছে। সরকার বিরোধীদের ‘দেশদ্রোহী’ বলে দেগে দিচ্ছে।
সব থেকে বড় কথা, আরএসএস সম্পর্কে এমন-এমন বই লেখা হচ্ছে, যেখানে আরএসএস-বিজেপি সম্পর্কে বিদ্বান ব্যক্তিদের গবেষণা থেকে ওদেরই পক্ষে অনেক গভীরতায় লেখা হচ্ছে। সহজ কথায় বুদ্ধিজীবীরা ওদের পক্ষে লিখছেন। এটা একটা নতুন বিষয়। তবে যা-ই হোক, নতুন বোতলে এসবই পুরনো মদ। কিন্তু নতুন বোতলটাকে ভাল করে চিনতে হবে। বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। পুরনো সমালোচনার গতানুগতিক ধারায় আবদ্ধ থাকলে হবে না। সমালোচনার নতুন ধারা গড়ে তুলতে হবে।