বছরটা শুরু হয়েছিল ‘পুষ্পা : দ্য রাইজ’ ক্রেজ দিয়ে। গত বছর ডিসেম্বরে মুক্তি পেলেও এ বছরের শুরু থেকে ‘পুষ্পা’-জ্বরে আক্রান্ত ছিল দেশের আট থেকে আশি। এরপর এল, রাজামৌলির ‘আর আর আর’। ব্যবসা ও বিনোদনের যুগ্ম ভেঞ্চারের সেই ঢেউ স্তিমিত হওয়ার আগেই ‘কেজিএফ-২’-এর ঢেউ আছড়ে পড়ল সিনেমা হলে। আর সুনামির মতো ভেসে গেলেন দর্শক। এর আগে ‘বাহুবলী ২’ বেঞ্চমার্ক ছিল। বিনোদন ও ব্যবসা উভয় নিরিখেই। ছিল বলা ভুল, আজও আছে। আমির খানের ‘দঙ্গল’কে টেক্কা দিয়ে দেশব্যাপী বক্স অফিস কালেকশনে এগিয়ে গিয়েছিল রাজামৌলিরই ‘বাহুবলী ২’। যদিও বিশ্বব্যাপী কালেকশন-এ আজও ‘দঙ্গল’ রেকর্ড আঁকড়ে বসে। কিন্তু দক্ষিণী ছবি (South Indian Film) তার পর থেকেই একের পর এক মাত দিচ্ছে বলিউড ব্লকব্লাস্টারদের। ক্রমশ কোণঠাসা বলিউড। প্রতিযোগিতা সীমাবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ ভারতে। অন্তর্দেশীয় ব্যবসায় এই মুহূর্তে প্রথম তিনটি ছবি হল, বাহুবলী ২ (হিন্দি), কেজিএফ ২ (হিন্দি), দঙ্গল। বলিউডের ট্রেন্ড অ্যানালিস্টরা আশা করছেন খুব শীঘ্রই প্রশান্ত নীল পরিচালিত ‘কেজিএফ ২’ এক নম্বর আসনটি দখল করবে। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী ব্যবসাতেও খুব দ্রুত ‘আর আর আর’ ও ‘বাহুবলী ২’কে টেক্কা দেবে ‘কেজিএফ ২’। অবশ্য কোভিডের কারণে বারবার মুক্তি পিছলেও অগ্রিম বুকিংয়েই ‘কেজিএফ ২’ বুঝিয়ে দিয়েছিল এমন কিছুই ঘটতে চলেছে। কারণ অগ্রিম বুকিংয়েই ‘আর আর আর’-কে ছাপিয়ে দৌড় শুরু করেছিল ‘কেজিএফ ২’।
এ তো গেল ব্যবসার হিসেব-নিকেশ! ঘটনা হল, এরকম নিখুঁত সিক্যুয়েল খুব কমই তৈরি হয়েছে। তাই শুধু অন্য ছবি নয়, ‘কেজিএফ ২’ ছাপিয়ে গেছে ‘কেজিএফ ১’-কেও। যারা প্রথমভাগ হলে দ্যাখেননি, তাঁরা অনেকেই কোভিড-কালের অবসরে ছবিটি দেখে ফেলেছিলেন ‘ওটিটি’ প্ল্যাটফর্মে। ফলে ঘটনা পরম্পরা বুঝতে খুব অসুবিধে হয়নি। বাণিজ্যিক ছবির দর্শকদের কাছে ‘গ্যাংস্টার’ মুভির কদর আজ নয়, বরাবরই বেশি। আর সেটা যদি বানানো হয় অঢেল টাকা ঢেলে, নিখুঁত সেট বানিয়ে, অন্ধকার জগৎকে হুবহু তুলে এনে, দুরন্ত গতির সঙ্গে কাহিনিকে পর্দায় উপস্থাপিত করে এবং ‘হিরো’কে কোণঠাসা মানুষের প্রতিনিধি করে তবে যুক্তি-বুদ্ধি-ভুলচুক এ-সব নিয়ে খুব মাথা ঘামায় না দর্শক। তারা একাত্ম হয়ে যায় ছবির সঙ্গে আর সেটাই এখন অধিকাংশ দক্ষিণী পরিচালকের তুরুপের তাস। যাদের জন্য বিনোদন, যাদের দ্বারা ব্যবসা তাদের মোহগ্রস্ত করা, পয়সা-উসুল বিনোদন প্রোভাইড করা, যেখানে পিছিয়ে যাচ্ছে বলিউড। টলিউডের কথা ছেড়েই রাখা ভাল।
‘কেজিএফ ১’-এ রকিভাইয়ের ক্ষমতা দখলের উচ্চাকাঙ্ক্ষা কতটা তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কন্নড় সুপারস্টার নবীনকুমার গৌড়া ওরফে যশ ওরফে রকি ভাই চ্যাপ্টার ২-তে কেজিএফ-এর মানুষদের ওপর সফল রাজত্ব চালাচ্ছে। কিন্তু এবার তার স্বপ্ন আরও বড়। নতুন সোনার খনির সন্ধান পায় সে। দখল করতে চায় স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু এবার তার শত্রুরা আরও বড়। কারণ তার সবচেয়ে বড় শত্রু ও প্রতিদ্বন্দ্বী অধীরা হাত মিলিয়েছে প্রধানমন্ত্রী রামিকা সেনের সঙ্গে, রকির ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি সহ্য হচ্ছিল না যার। একই সঙ্গে গরুড়াকে মারার পর কেজিএফ অর্থাৎ কোলার গোল্ড ফিল্ডের ওপর রকির দখলদারি সহ্য হচ্ছিল না তার পার্টনারদেরও। কাহিনি চেনা ছন্দে গড়ালেও, বিশেষত দ্বিতীয়ার্ধে দুরন্ত গতি ও মুহুর্মুহু টুইস্ট এবং উপস্থাপনা ‘কেজিএফ ২’-কে এক অনবদ্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর চরিত্রে রবিনা ট্যান্ডন যথাযথ হলেও অধীরা চরিত্রে এন্ট্রি থেকে এন্ড সঞ্জয় দত্ত তাঁর মতো করেই তাক লাগিয়ে দেন। এ ছবি যতটা রকিভাইয়ের ততটাই অধীরার। ভুবন গৌড়ার সিনেমাটোগ্রাফি দাগ কাটার মতো। সূত্রধর হিসেবে প্রকাশ রাজের কণ্ঠও। অ্যাকশন-প্যাকড এই ‘চ্যাপ্টার ২’-এর আরও নতুন পাওনা রকি ভাইয়ের প্রেম-কাহিনি, যদিও তা চরিত্রটিকে ‘হিউম্যান’ করার উদ্দেশ্যেই। কারণ রকি ভাই প্রেমে ভেসে যাওয়ার চরিত্র নয়। সব মিলিয়ে যুক্তি-বুদ্ধির হিসেব না কষে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ মুভির যে ট্রেন্ড চালু হয়েছে তার পরিমাপে ‘কেজিএফ ২’ যথার্থ অর্থেই সফল।
আরও পড়ুন: একে মেসি, প্রথম একশোয় বিরাট ফোর্বস তালিকায়
কল্পকাহিনিটি এমন অনবদ্য হলেও এর একটা বাস্তবও রয়েছে , যদিও সেখানে রকিভাই বা অধীরার অস্তিত্ব নেই কিন্তু বাকি অনেককিছুই আছে। কারণ এই কোলার গোল্ড ফিল্ডের ইতিহাস ইংরেজ আমল থেকে শুরু। সেখানে স্থানীয় মানুষদের দুর্দশা ও নিপীড়নের ইতিহাসও তাই দীর্ঘ। বাস্তবের এই ঘটনাবলিকেই ‘লার্জার সাইজ’ প্লেটে পরিবেশন করা হয়েছে। এটুকু করতেই হয় বিনোদন ব্যবসায়। ‘কেজিএফ ২’-এর অধীরা অন্তত তাই মনে করেন! ছবির দুর্দান্ত সাফল্য নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে, সঞ্জয় দত্ত জানিয়েছেন, ‘হিরোইজমের গুরুত্ব ভুলেছে বলিউড। সিলভার স্ক্রিনে বাস্তবের ঝলক বা রোম্যান্টিক কমেডির প্রয়োজনীয়তা থাকতেই পারে কিন্তু দেশের বড় অংশের দর্শক এখনও লার্জার দ্যান লাইফ হিরোকে দেখতেই পছন্দ করে। দক্ষিণী ইন্ডাস্ট্রি (South Indian Film Industry) সেটা বুঝছে কিন্তু বলিউড বুঝতে চাইছে না বলেই দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছে।’
সুখবর, দর্শক এতদিনে জেনে গিয়েছেন— প্রশান্ত নীল ‘কেজিএফ ৩’ বানানোর পরিকল্পনায় এগিয়ে গিয়েছেন!