‘পর্বতের মূষিক প্রসব!’ এক কথায় গত কয়েকমাস যাবৎ বিরোধী দলনেতার (Suvendu Adhikari) তর্জন-গর্জন এবং অতঃপর গত ১১ ও ১২ তারিখ ধরে বাংলার পঞ্চায়েতের রায়ের পর বিরোধী দলনেতার সম্পর্কে এই একটিই বাক্য খরচ করা যায়। বাংলার গ্রামের মানুষের রায় এটা স্পষ্ট করে দিয়েছে, যে যতই কুৎসা-অপপ্রচার, কেন্দ্রীয় এজেন্সি দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে চক্রান্ত হোক, মানুষ দু’হাত ভরে আশীর্বাদ-দোয়া দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই। আর এই ফলাফল আবারও বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিরোধী দলনেতার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং তাঁর রাজনৈতিক দক্ষতাকে!
এমনিতেই শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari) একজন আত্মঅহংকারী এবং আত্মপ্রচারে মগ্ন ব্যক্তি। ‘পার্টিম্যান’ বা দল-অন্তপ্রাণ বলতে যা বোঝায় তা তিনি কোনওকালেই নন। দলের চেয়ে নিজের প্রচারকেই তিনি বরাবর গুরুত্ব দিয়েছেন বেশি। বিজেপিতে যোগ দেওয়া ইস্তক, তিনি বিজেপির বহু প্রবীণ নেতাকেই একপ্রকার কোণঠাসা করে দিয়েছেন। যা নিয়ে বঙ্গ-বিজেপির বহু প্রবীণ নেতাই তাঁর প্রতি বিরক্ত। এঁদের মধ্যে বিজেপির কয়েকজন প্রাক্তন রাজ্যসভাপতি যেমন আছেন, তেমনি আছেন আরএসএসের বহু নেতা। এঁদের অনেকেই বিজেপির দিল্লির নেতাদের কাছে শুভেন্দুর বিরুদ্ধে নানা সময় অভিযোগ জানালেও, দিল্লির নেতারা বিশ্বাস করেছিলেন শুভেন্দুর ওপর। এই পঞ্চায়েত নির্বাচন কার্যত শুভেন্দুর নিজের কাছেও ছিল ‘অ্যাসিড টেস্ট’। তিনি বারবার দাবি করেছিলেন, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদ তিনি জিতবেনই। এমনকী জেলার বেশিরভাগ পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রামসভাতেও পদ্ম ফোটানোর বিষয়ে প্রত্যয়ী সুর ছিল তাঁর গলায়৷ একই সঙ্গে বিরোধী দলনেতা হিসেবে রাজ্যের প্রতিটি জেলাতেই ‘ভাল’ ফলের স্বপ্ন তিনি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে বিজেপির সাধারণ বুথকর্মীদের দেখিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্বও প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি বা বর্তমান রাজ্য সভাপতির থেকে শুভেন্দুকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলা নিয়েও ভীষণ আশাবাদী ছিলেন তিনি। কিন্তু ফলাফল বলছে, গ্রামবাংলা কার্যত শূন্য হাতে ফিরিয়েছে শুভেন্দু অধিকারীকে! তাঁর, ‘নো ভোট টু মমতা’ স্লোগানকে কার্যত ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে গ্রামবাংলার মানুষ। বাংলার কুড়িটি জেলা পরিষদেই মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের ওপরেই আস্থা রেখেছেন। এখানেই বিরোধী দলনেতার রাজনৈতিক প্রজ্ঞার ওপরেই সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন উঠছে। কারণ, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহারে (যেখানে সাংসদ ও বিধায়ক সংখ্যার নিরিখে বিজেপি এগিয়ে) সেখানেও জেলাপরিষদ জিতে নিয়েছে তৃণমূল। বেশিরভাগ পঞ্চায়েত সমিতি, গ্রামপঞ্চায়েতও জয় হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের। আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনও অভিযোগ অবধি বিজেপি করতে পারেনি! জঙ্গলমহলেও গত কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে বিজেপির ফলাফল অত্যন্ত খারাপ। বিজেপিকে স্বীকার করতেই হবে, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতি বাংলার মানুষের আস্থা অটুট। ব্যতিক্রম হয়নি শুভেন্দু অধিকারীর নিজের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরেও। যে-জেলা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আশা ছিল বিরোধী দলনেতার। সেখানেও পর্যুদস্ত হয়েছে বিজেপি। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, শুভেন্দুকে নিয়ে বিজেপির লাভটা কী হল? তিনি কি দলের বোঝা? তৃণমূল কংগ্রেসে একপ্রকার ব্রাত্য হয়ে গিয়ে স্রেফ নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থেই কি তিনি বিজেপিতে? তিনি কি কেবলই এমন একজন নেতা, যিনি টিভি ক্যামেরা ফুটেজে এবং আদালতের দরজাতেই বেশি সাবলীল? কিন্তু নির্বাচনের রুক্ষ জমিতে চূড়ান্ত ব্যর্থ এক রাজনীতিক! একটু তথ্য দেখা নেওয়া যাক। ২০০৭-এ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নন্দীগ্রাম আন্দোলন এবং তার পরের বছর অর্থাৎ ২০০৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রথমবার বামেদের হারিয়ে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদ জয় তৃণমূলের। তারপর যথাক্রমে ২০১৩, ২০১৮ পরপর পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদে জয় তৃণমূলের। শুভেন্দু তখন তৃণমূলে ছিলেন। পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি ভালবাসা-সমর্থনকে নিজের রাজনৈতিক ‘দক্ষতা’ বলে চালিয়ে গেলেন শুভেন্দু৷ তাঁর আসল পরীক্ষা ছিল, ২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচন। যেখানে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদতল ছেড়ে সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকেই চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। আর বাস্তবের জমিতে আছাড় খেয়ে পড়লেন! ৭০ আসন বিশিষ্ট জেলাপরিষদের ৫৬টিতেই জিতল তৃণমূল। বিজেপি থেমে গেল ১৪-তে। পঞ্চায়েত সমিতির ২৫টি আসনের মধ্যে ২১টিই জিতল তৃণমূল। গ্রাম পঞ্চায়েতেও জয়জয়কার ঘাসফুলেরই। ২২৩টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৭৫টি-তেই জয় তৃণমূলের! পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষ বুঝিয়ে দিলেন, কোনও সুবিধাবাদী গদ্দারকে দেখে নয়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর উন্নয়নের ওপর ভরসা রেখেই তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসকে আগেও জিতিয়েছেন, আজও জেতালেন এবং ভবিষ্যতেও জেতাবেন। কোনও বিশেষ পরিবারের কাছে নিজেদের বন্ধক দেয়নি মাতঙ্গিনী হাজরা-বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের জেলার মানুষ। বিজেপিতে যাওয়ার পর, শুভেন্দু বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি একাই রাজ্যের ১৫০টি আসন জিতিয়ে দেবেন৷ সেখানেও ডাহা ফেল। গত বিধানসভা নির্বাচনের গণনার দিনে, প্রথমে গণমাধ্যমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ের খবর এবং পরে তা বদলে কীভাবে শুভেন্দু জিতে গিয়েছিলেন, সেটা বাংলার প্রতিটি রাজনৈতিক সচেতন ব্যক্তিই জানেন। কীভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান নির্বাচনী এজেন্টদের গণনাকক্ষ থেকে বের হওয়া, গণনাকেন্দ্রে লোডশেডিং এবং আচমকাই শুভেন্দু অধিকারীর জয়! এই সবটাই যে বিজেপির একটা সুপরিকল্পিত চক্রান্ত ছিল তা যেন, আরও একবার প্রমাণ হয়ে গেল এই পঞ্চায়েতের ফলে!
আরও পড়ুন- ৩৫৫-র পরিস্থিতি তৈরি করতে যা-যা করতে হয়, আমি করব, চক্রান্ত ফাঁস গদ্দারের
এখন, এহেন এক ব্যক্তি নিজেও হয়তো নিজের ভবিষ্যৎ বুঝতে পারছেন। দিল্লির নেতাদের হয়তো আর বেশিদিন মিথ্যে স্বপ্ন দেখিয়ে পদ আগলে থাকা যাবে না! শুধু আদালত আর এজেন্সির ভরসায় ভোট হয় না। সামনের ২০২৪-এ পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি-তমলুক দুটি লোকসভা আসনই তৃণমূলের জয় প্রায় নিশ্চিত। তাই কি বিকৃত সুরে গান, ভোট বাতিলের আর্জি নিয়ে আদালতের কাছে আবদার, বিরোধী দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে পরিবার নিয়ে ব্যক্তিগত আক্রমণ, মাতৃসমা মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ ভাষার প্রয়োগ, নির্বাচন কমিশনের দরজায় লাথি, অদ্ভুত ইংরেজি শব্দের প্রয়োগ করে কোনোক্রমে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চাইছেন শুভেন্দু? তিনি কি ক্রমশ বুঝতে পারছেন তাঁর নিজের রাজনৈতিক ক্যারিশমা প্রায় শূন্য! এইরূপ অদ্ভুত আচরণ তো সে দিকেই ইঙ্গিত করছে। শুভেন্দু অধিকারী কি বুঝতে পারছেন, কিছু বিক্রি হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যম যতই তাঁকে ‘কাগুজে বাঘ’ বানাবার চেষ্টা করুক, আদতে তিনি একটি ব্লকেও হেরে যাচ্ছেন আজকাল। নিজের বিধানসভার নন্দীগ্রাম ব্লক ১-এর পঞ্চায়েত সমিতিতেও হেরে গিয়েছেন বিজেপি প্রার্থীরা! রাজ্যের যে-যে জায়গায় প্রচারে গেছিলেন প্রায় সব ক’টি জায়গায় হেরে গিয়েছে তাঁর দল! মিডিয়া-ভাষণে বলেছিলেন, হলদি নদীর দু’ধারে তিনি পদ্ম ফোটাবেন। হলদি নদী তো অনেক দূরঅস্ত্, বিরোধী দলনেতা কি একটি ব্লকের নেতা হওয়ার যোগ্যতাও ক্রমে হারাচ্ছেন?
‘১০,৪৫৭’ । লোডশেডিং অধিকারীর রাতের ঘুমে কি বারবার ফিরে-ফিরে আসবে সংখ্যাটা?