ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে পদদলিত করে, ভারতীয় সংবিধানের আত্মাকে অবমানিত করে যে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক বিভাজনমূলক বিজেপির কিছু নেতা-নেত্রীর অসচেতন বক্তব্য এবং নাগরিকত্ব আইন বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার রূপায়িত করতে চাইছে তার প্রতিবাদে মানুষ বিক্ষোভে শামিল। অখণ্ড স্বাধীন ভারতকে রক্ষা করতে হবে। এটাই হোক আমাদের বাঁচার অগ্নিপথ।
তবে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (TMC Supremo Mamata Banerjee) আবেদন এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার। ‘‘গণতান্ত্রিক পথে আন্দোলন করুন, কিন্তু আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। পথ অবরোধ, রেল অবরোধ করবেন না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বরদাস্ত করা হবে না। সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করলে, আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে ভারতের কোটি কোটি মানুষ শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশে রুখে দাঁড়াচ্ছেন। বিভেদকামী সরকারের পতন সুনিশ্চিত করতে জনতার একতা জরুরি। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল। মহম্মদ আলি জিন্নাহ বলেছিলেন, হিন্দু আর মুসলমান দুটি পৃথক জাতি, তাই দুটি আলাদা দেশ হওয়া দরকার। হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকরও একই নীতিতে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু ভারতের সংবিধান প্রণেতারা জিন্নাহ বা সাভারকরের পথ নেননি। তাঁরা ভারতবাসীকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ, সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সংবিধানকে অস্বীকার করে মহাত্মা গান্ধী থেকে বাবাসাহেব আম্বেদকর, সবার আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইল নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের সরকার। নাগরিকত্ব আইন সিএএ পাশ করেছে ঠিকই, কিন্তু বিভাজনের রাজনীতির ঘৃণ্য পুনরুজ্জীবন ঘটিয়ে বিজেপি সরকার কতটা সফল হবে তা কিন্তু সময় বলবে। কারণ, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে রক্ষা করতে দেশবাসী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা সবাই জানি স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আরএসএস তথা হিন্দু মহাসভার নেতারা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করেছিলেন, দেশ বিভাজনের মূলে ছিলেন তাঁরাই।
আরও পড়ুন: নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা, বুথে সিসিটিভি, কন্ট্রোলরুম, ভোট পরিচালনায় মন্ত্রী
ঠগ ব্যবসায়ীরা দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পালিয়েছে, তাদেরকে ধরে আনতে বিজেপির সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। কালো টাকা ফেরত আনতে পারেনি। সাধারণ মানুষের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ করে টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এই প্রতিশ্রুতিও পূরণ করতে পারেননি।
ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ফলে প্রতিদিন কত সাধারণ মানুষ নিঃশব্দে শেষ হয়েছেন এবং হচ্ছেন। নোটবন্দি থেকে জিএসটির মতো অবিমৃশ্যকারী পদক্ষেপে সারাদেশের অর্থনীতি আজ ধ্বংসের শেষ কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে। দেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চরমভাবে নরেন্দ্র মোদি সরকার ব্যর্থ। ৪৯ বছরের পরিসংখ্যানে বেকারত্ব সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। সাধারণ মানুষ দিন দিন দিশাহারা। সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে উপযুক্ত রোজগারের সুযোগ-সুবিধা থেকে অসংখ্য মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন। মোদির সরকার চুপ।
দেশের নাগরিকদের হাজার সমস্যার সমাধান করতে না পেরে অন্যদিকে দৃষ্টি ঘোরাতে গোটা বিশ্বের মানুষের সামনে সংবিধান বিরোধী নতুন নাগরিকত্ব আইন হাজির করে নরেন্দ্র মোদি সরকার কী বার্তা দিতে চাইছিলেন তা দেশবাসী ধরে ফেলেছেন। দেশের জনতা নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। সে লড়াই এখনও শেষ হয়নি। গণতন্ত্র ও সংবিধান আজ বহু বিভেদকামী রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। গণতন্ত্র ও সংবিধান বাঁচাতে দেশের সাধারণ নাগরিকদের আরও সচেতন হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে, বিভেদকামী শক্তির অবসান ঘটাতে।
অনেক বছর পেরিয়ে গেল, দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজও আমরা সাম্প্রদায়িকতামুক্ত ভারত গড়ে তুলতে পারিনি। দেশ জুড়ে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, সম্প্রীতির বন্ধন অগ্রাহ্য করে বেড়ে চলেছে হানাহানি। বিজেপি শাসিত রাজ্যেগুলিতে বেশি ঘটছে।
বিভেদকামী শক্তি বিভাজন, আর জাতিবিদ্বেষ ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের প্রতি যে ঘৃণা, অবজ্ঞা পোষণ করছে তার বিরুদ্ধে জোটবদ্ধভাবে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করে একসঙ্গে লড়াই করতে সর্বদাই সাধারণ মানুষের সঙ্গে আছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুসলমানদের শত্রু বানানোর ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে জনতার একতা হওয়া জরুরি। হিন্দু সম্প্রদায়ের উদার মানুষজন সর্বদা ভারতের কল্যাণে এবং সংবিধান রক্ষা করতে মুসলমানদের আগলে রেখেছেন। আগামী দিনেও ভারতকে পথ দেখাবে উভয় সম্প্রদায়ের উদার মানুষজন। আমরা যেন ভুলে না যাই, মিশ্র সংস্কৃতিকে রক্ষা করতেই হবে। মানবিক চিন্তাচর্চায় যথার্থ আগ্রহী সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মেধাজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পী, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, সমাজ-রাষ্ট্রচিন্তক, সর্বোপরি আমজনতার সচেতন অংশটি গেরুয়া শাসনের প্রশাসনিক বদমায়েশি সম্পর্কে নিরন্তর প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজের একটি অংশ, যারা আজও উটপাখির মতো মরুবালিতে মুখ গুঁজে উপেক্ষিত অংশের জাগরণকে স্বীকার করতে দ্বিধান্বিত, তাদের বোধোদয় হবে এমন প্রত্যাশা করা যায়। ভারতের ঐতিহ্যের, পরম্পরার এবং সংহতির ঘোর বিরোধী গেরুয়া শাসনের অবসান ঘটাতে এগিয়ে আসছেন সচেতন দেশবাসী। সীমাহীন রাজকীয় ক্ষমতানির্ভর সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে ঘাড়ে-গর্দানে এক-হয়ে-যাওয়া কেন্দ্রীয় সরকারের রাজাবাবুরা এতদিন যে সংখ্যালঘিষ্ঠ ও দলিত সম্প্রদায়ের উপস্থিতিকেই স্বীকার করত না, আজ তাঁরাই বেমক্কা নির্লজ্জভাবে ছুটে যাচ্ছেন প্রান্তিকের কাছে ভোট ভিক্ষা চাইতে।
ইতিহাস বলে, বিজেপি’র মূল চালিকা শক্তি আরএসএস ও হিন্দু মহাসভা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি। বরং ইংরেজদের পক্ষেই ছিল তারা। শুধু তাই নয়, দেশভাগের মূলে প্রকৃতপক্ষে ওই দুই সংগঠনের নেতাদের ভূমিকাই ছিল আসল। অথচ, সেই আরএসএস-জাত বিজেপি’র অধুনা নেতারা দেশভক্তির পরাকাষ্ঠা দেখাতে কী না করছেন! বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ’র শাসনে ভারতের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে, তীব্র বেকারত্ব ও ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির জোড়া ধাক্কায় দেশবাসীর নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হয়েছে। সাধারণ মানুষকে দেওয়া প্রায় কোনও প্রতিশ্রুতিই পালন করতে পারছেন না মোদি ও তাঁর দোসররা।
এই ব্যর্থতা থেকে নজর ঘুরিয়ে দিতে ধর্মকে হাতিয়ার করছেন গেরুয়া নেতারা। ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবাসীকে বিভক্ত করে নিজেদের আসন নির্বিঘ্ন রাখতে মরিয়া তাঁরা। সেই পরিকল্পনার আরও একটি অংশ হল বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে গ্রাস করে নেওয়া। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের স্বপ্নে বিভোর তাঁরা। এমতাবস্থায় ভারতের অশুভ শক্তিকে পরাজিত করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (TMC Supremo Mamata Banerjee) হাত শক্ত করতেই হবে সচেতন দেশবাসীকে।