আজকের অতিযান্ত্রিক সভ্যতায় যন্ত্র যদি মানুষ হয়ে ওঠে তাহলে উন্নয়নের সংজ্ঞাটিও এক নতুন মাত্রা পায়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৌলতে ঠিক তাই হয়েছে— ভারতীয় সৈন্যদের হাতে এসেছে এক উন্নততর সামরিক মানবহীন স্থলবাহন (Unmanned Ground Vehicle/ আনম্যান্ড গ্রাউন্ড ভেহিকল)। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ন্ত্রিত এই যন্ত্র ভারতীয় সেনার মনোবল ও বাহুবল দুটোই দারুণভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হল সেই বিজ্ঞান যা একটি যন্ত্রকে মানুষের মতো ভাবতে, শিখতে, ধারণা ও জ্ঞানের আত্তীকরণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে শেখায়। বর্তমানে সারা বিশ্বে তথা ভারতবর্ষে এই বিজ্ঞানের ব্যাপকতর গবেষণা চলছে— সামাজিক, শৈল্পিক তথা সামরিক উন্নয়নের সংজ্ঞাটাই বদলে দিতে। সম্প্রতি ভারতবর্ষের চেন্নাইয়ে অবস্থিত ‘কমব্যাট ভেহিকল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এস্টাব্লিশমেন্ট’ নামে একটি উদ্যোক্তা কোম্পানি ও ভারতবর্ষের সামরিক গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা ‘ডিআরডিও’ যৌথভাবে এমনই একটি সামরিক মানবহীন স্থলবাহন আবিষ্কার করেছে।
আরও পড়ুন: সব ম্যাচই শেষ ম্যাচ ভেবে খেলছি, জকো-দ্বৈরথের আগে নাদাল
আবিষ্কৃত যন্ত্রটি একটি যুদ্ধ ট্যাঙ্ক। এই যন্ত্রটি সমতল, পাহাড়, মালভূমি, মরুভূমি এবং উচ্চ উচ্চতা (হাই অ্যালটিটিউড) বিশিষ্ট পরিবেশেও যন্ত্রের মধ্যে কোনও মানুষের উপস্থিতি ছাড়াই কাজ করতে সক্ষম। এই যন্ত্রটির মধ্যে রয়েছে একটি ১২এমএম-এর বন্দুক, একটি চাতাল, উন্নত ভৌগোলিক তথ্য সংগ্রহ ইন্দ্রিয়,স্ব-নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, নির্দেশিকা আন্তঃফলক, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পুরো সামরিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য আরও প্রয়োজনীয় সহকারী পরিকাঠামো। বহুদিন থেকেই ভারতবর্ষের সৈন্যদল এমনই একটি যন্ত্রের সন্ধান করছিল যার সাহায্যে পশ্চিমের পার্বত্য অঞ্চলের সীমানায় মজবুত করে নিজেদের পা রাখতে পারে। এই যন্ত্রটি একইসঙ্গে দুশমনের উপর নজরদারি, পুনরুদ্ধার, শত্রুপক্ষের অবস্থান নির্ণয়, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও দ্রব্যের সরবরাহ এবং দ্রুত অপসারণে সক্ষম। এ-ছাড়াও যন্ত্রটি দিকনির্দেশনা ও পরিবেশগত সঠিক ধারণা দিতে সমর্থ। কোনও বিস্ফোরক পদার্থ শনাক্তকরণ ও তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষ্ক্রিয় করার কাজও অত্যন্ত নিপুণভাবে করে এই যন্ত্রটি। সামরিক ক্রিয়াকলাপের সময় এই যন্ত্রটিকে কখনও রিমোটের সাহায্যে, কখনও স্বয়ংক্রিয়ভাবে বা চলন্ত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে পরিচালনা করা হয়। সামরিক ক্ষেত্রে এই উন্নত যন্ত্রটি কখনও কখনও নিজেও সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। সত্যিই এটি ভারতীয় সামরিক ক্ষেত্রে এটি একটি অনন্য প্রাপ্তি।
ভারতবর্ষের বহু প্রান্তে অত্যন্ত বরফ পড়ার কারণে ও ভূমিধ্বসের জন্য বহু সাধারণ মানুষ ও পর্যটকের প্রাণনাশ হয়ে থাকে। এই সমস্যার নিরাপদ মোকাবিলা করতে ভারতীয় সামরিক বাহিনী একটি মানবহীন স্থলবাহনের (Unmanned Ground Vehicle) প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল অনেকদিন ধরেই। এ-কথা মাথায় রেখে ২০১৭ সালে চেন্নাইয়ের ওই উদ্যোক্তা কোম্পানি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে মজুদ ‘বিডি ফিফটি বুলডোজার’-এর মডেলে ‘বিডি ফিফটি ডোজার’ নামে একটি দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন যন্ত্র আবিষ্কার করতে শুরু করে। ঠিক তার পরেই সামরিক ক্ষেত্রে ব্যবহার করার জন্য একটি উন্নততর মানবহীন স্থলবাহনের ধারণা মাথায় আসে। ডিআরডি-সহ বহু কোম্পানি ওই কাজে লেগে পড়ে।
এরপর ২০২০ সালে উত্তরপ্রদেশের লক্ষ্ণৌ শহরে হওয়া ‘ডিফেন্স এক্সপো’ নামে একটি সামরিক প্রর্দশনীতে চেন্নাইয়ের একটি উদ্যোক্তা কোম্পানি ‘ডিফেন্স মাস্টার’এর কর্মকর্তা ডেনিস এবেনেজার ভারতবর্ষের প্রথম মানবহীন স্থলবাহন ‘সুরান’কে প্রকাশ করেন। এটিও বন্দুকধারী সশস্ত্র রিমোট-নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধবাহন ছিল। এ-ছাড়াও ওই প্রর্দশনীতে চেন্নাইয়ের আরও একটি উদ্যোক্তা কোম্পানি ‘টোরাস রোবোটিক্স’ একটি চলন্ত স্বয়ংক্রিয় রোবট যন্ত্রের প্রকাশ করেছিল যা খুব সহজেই প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে আইইডি-র মতো মারাত্মক বিস্ফোরককে শনাক্ত করে নিষ্ক্রিয় করতে পারে।
পরবর্তীতে ২০২১ সালের ৯-১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘স্ট্রাইক’ (সারভেইল্যান্স, ট্যাকটিক্যাল রেসে, ইন্টেলিজেন্স, কাইনেটিক ইফেক্টস, অ্যান্ড ইভালুয়েশন) নামে একটি সামরিক পরীক্ষামূলক প্রর্দশনীতে ভারতের ১২টি কোম্পানি তিনটে এই ধরনের যন্ত্রের নমুনা দেখায়। তারপরেই প্রকাশ্যে আসে ‘কমব্যাট ভেহিকল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এস্টাব্লিশমেন্ট’-এর উন্নততর মানবহীন স্থলবাহন। এই কোম্পানি পূর্বে ‘অর্জুন’ নামে একটি যুদ্ধ ট্যাঙ্ক তৈরি করেছিল যা বর্তমানে ভারতীয় স্থলসেনার সঙ্গে আছে। ওই ট্যাঙ্কের উন্নততর ও আধুনিক সংস্করণও বলা যায় এই মানবহীন স্থলবাহনকে। ভারতীয় সৈন্যদল এই যন্ত্রটিকে পশ্চিম রাজস্থানের মরুভূমি অঞ্চলের নিকট ভারত-পাকিস্তান সীমানায় বহাল রাখবে বলে জানা গেছে। নিঃসন্দেহে এই যন্ত্রটির প্রাপ্তি ভারতীয় সামরিক ক্ষমতাকে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।
তবে এই মানবহীন যন্ত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এমন এক আশীর্বাদপুষ্ট দান যা শুধু সামরিক ক্ষেত্রকেই সমৃদ্ধ করেছে তা নয়; এই যন্ত্র মহাকাশ, নাগরিক, বাণিজ্যিক, চাষাবাদ, উৎপাদন, খনন, জোগান ও জরুরি পরিষেবার মতো নিবেশেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ভারতবর্ষে এভাবেই দেশজ প্রযুক্তির বিকাশ ঘটলে আমাদের দেশ খুব তাড়াতাড়ি আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠবে— আশা করা যায়।