‘শান্ত নদীর মত হয় কিছু কিছু মানুষ…’, সদ্যপ্রয়াতা অভিনেত্রী সোনালি চক্রবর্তীকে (Actress Sonali Chakraborty) এক ঝলক দেখলে এমনই মনে হত। অফুরন্ত প্রাণশক্তি লুকিয়ে রাখতেন নিজের আস্তিনে। আর তা দিয়েই সারতেন জীবনের উৎসব। আদ্যন্ত শিল্পী মন নিয়ে উদযাপন করতেন উৎসবের প্রতিটি ধাপ। অভিনয় নয়, সবটা ছিল সত্যি! আর এই সত্যি-গল্পটা যিনি আড়ালে বসে আমাদের জন্য লেখেন তিনি কখন যে ‘কাহানি মে ট্যুইস্ট’ আনবেন তা তিনিই জানেন। আমরা জানি না তাই আমরা বেবাক হই। ধস্ত হই। কেঁদে ভাসাই। সময় সময় ভীষণ রেগেও যাই। কিন্তু তিনি, কোনও টিআরপি’র প্রত্যাশা করেন না! ধার ধারেন না আমাদের আবেগের গ্রাফের। তাই তিন সত্যি হজম করে পড়ে থাকে শুধু অসম্ভব শূন্যতা!
সোনালি চক্রবর্তী-শঙ্কর চক্রবর্তী, নাম দুটো টলিপাড়ায় একসময় একসঙ্গে উচ্চারিত হত। আক্ষরিক অর্থেই রিল ও রিয়েল লাইফ জুটি। মঞ্চ-সিনেমা-টেলিভিশন সর্বত্র যুগলে কামাল করেছেন। দর্শক মুগ্ধ হতেন ওঁদের অন ক্যামেরা রসায়নে আর সহকর্মী-বন্ধু-কাছের জনেরা অফ-ক্যামেরা বোঝা-পড়ায়। শুরুটা ছিল বহু আগের। গল্পের মতোই ‘সত্যি’! নাচ-গান-অভিনয় ছিল অস্তিত্ব। তাই পড়াশোনাও করেছিলেন এগুলো আঁকড়েই। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নৃত্য’ বিভাগের সোনালি নিয়তি-নির্দিষ্ট ভাবেই যেন প্রেমে পড়েছিলেন ‘নাট্য’ বিভাগের শঙ্করের! সেই শুরু হাত-ধরা। মাত্রই ৫৯ বছরে বিচ্ছিন্ন হল যাত্রাপথ।
দীর্ঘদিন ধরেই যকৃতের অসুখে ভুগছিলেন। বারবার অসুস্থ হতেন, বারবার হাসপাতালে যেতেন কিন্তু ফিরে আসতেন অদম্য জীবনীশক্তি দিয়ে লড়াই করে। হার মানলেন এবার। কিন্তু হারতে চাইতেন না। চাইতেন ‘সোনালি আলো’ হয়েই বাঁচতে। তাই সামান্য সুস্থ হয়েও দীপাবলি উদযাপন করেছিলেন পরিবারের সঙ্গে। সে ছবি শঙ্কর সোশ্যাল মাধ্যমে পোস্টও করেছিলেন। তখনও কি জানতেন ‘অন্তিম পর্ব’-এর সূচনা শুরু করে দিয়েছেন ওপরওয়ালা! তখনও কি জানতেন মাত্রই ক’টাদিনের ব্যবধানে সেই সোশ্যাল মাধ্যমেই লিখতে হবে, “ভরা থাক স্মৃতিসুধায়”। জীবন সুন্দর তো বটেই, জীবন এমন অনিশ্চিতও!
আরও পড়ুন-ভারতের আপত্তি উড়িয়ে চিন-পাকিস্তান করিডরের কাজ দ্রুত সম্পন্নের পরিকল্পনা
অসুস্থতার জন্যই সরে যেতে হয়েছিল প্রিয় অভিনয় ছেড়ে। নিতে হয়েছিল বাধ্যতামূলক বিরতি। প্রতি মুহূর্তে পাশে থাকতেন স্বামী ও একমাত্র কন্যা। চেষ্টার ত্রুটি রাখেননি প্রিয় মানুষটাকে সুস্থতার পথে ফিরিয়ে আনার। কাজেও এসেছিল সে চেষ্টা। তাই দীর্ঘদিন পর ফিরেছিলেন, ‘লাইট-ক্যামেরা-সাউন্ড-অ্যাকশন’-এর জগতে। শুরু করেছিলেন ধারাবাহিকে অভিনয়। কষ্ট শরীরে হত কিন্তু মনটা ভাল থাকত। তেমনটাই বলতেন অনুজ সহকর্মীদের। লুকিয়ে রাখতেন রোগ-যন্ত্রণা আর দিতেন অফুরান স্নেহ। ছোট-বড় সকলেই তাই বড্ড ‘মিস’ করছেন সুন্দর মানুষটিকে।
শুরুতে কিন্তু ‘খলনায়িকা’ হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে বেশ দাপট দেখিয়ে গিয়েছেন সোনালি! নেগেটিভ চরিত্রে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। তবে একই সঙ্গে একাধিক বাংলা ছবিতে নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চোখের বালি’ যার অন্যতম। ঐশ্বর্য রাই বচ্চন, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন সোনালি। রবি কিনাগী পরিচালিত জিৎ ও কোয়েল অভিনীত সুপারহিট ‘বন্ধন’ ছবিতে তাঁর অভিনয় ছিল মনে রাখার মতো। অনুপ সেনগুপ্তের ‘হারজিত’ও ছিল অন্যতম। এই ছবিতে রচনা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ফেরদৌস ছিলেন নায়ক-নায়িকা। নায়িকার সৎ মায়ের চরিত্রে দাপুটে অভিনয় করেছিলেন তিনি (Actress Sonali Chakraborty)। মিলন ভৌমিকের ‘সত্যমেব জয়তে’ ছবিটির নায়ক ছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী। এই ছবিতে স্বামী শঙ্কর চক্রবর্তীর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন সোনালি। শুধু এটিই নয়, একাধিক ছবিতে স্বামী শঙ্করের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন তিনি। চিরঞ্জিত চক্রবর্তী পরিচালিত ‘সংসার সংগ্রাম’ ছবিটির নায়িকা ছিলেন ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। এই ছবিতে সোনালি চক্রবর্তীর অভিনয় টলিউড এখনও মনে করে। তরুণ মজুমদারের ‘দাদার কীর্তি’ ছবিতে মহুয়া রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পাল্লা দিয়ে নাচও মনে রেখেছে দর্শক। আর একাধিক প্রজন্মের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে তাঁর এই দীর্ঘ অভিনয় জীবনের দিকে ফিরে তাকালেই বোঝা যায়, একজন অভিনেত্রী হিসেবে তাঁর ব্যাপ্তি।
তবে দাপুটে অভিনয়ের সাক্ষী শুধু সিনেমায় নয়, ছোটপর্দায় ফিকশন- নন-ফিকশন সব ক্ষেত্রের দর্শকরাই। টেলিভিশনে এসেও দর্শক-মন জয় করেছিলেন নিমেষে। তৎকালীন নন-ফিকশন শো, ‘বরিশালের বর, কলকাতার কনে’ নামক এক রিয়্যালিটি শো’এ শঙ্কর-সোনালি ‘সঞ্চালিকা জুটি’ হিসেবে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিলেন আজও সকলে জুটিকে ওই নামেই ডাকেন। শো’টি টানা ছয় বছর চলেছিল। এছাড়াও আছে অগুনতি ধারাবাহিক। ‘নাচনী’, ‘বিবাহ অভিযান’, ‘জননী’ একের পর এক ‘হিট’ শো। শুধু যে পর্দায়, তা নয়, মঞ্চেও দাপটে অভিনয় করতেন। আর সেখানেও স্বামীর সঙ্গে একাধিক নাটকে অভিনয় করেছেন।
সব স্মৃতি হয়ে থাকল। আজীবন থাকবে। শুধু, তিনি, সোনালিদি এবার ভাল থাকুন, এক অন্য দেশে, অন্য মঞ্চে।
-প্রীতিকণা পালরায়