মিস্ট্রি অব দ্য মাস, বিনয়ী পদার্থবিদ পিটার ওয়্যার হিগস বা সংক্ষেপে পিটার হিগস। পরিচয় দিতে হবে না তাঁর। তিনি ‘হিগস বোসন’ বা ঈশ্বর কণার আবিষ্কর্তা। কণার ওপর পিটার হিগসের অবদান অপরিসীম। সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন তিনি। তাঁর এই চলে যাওয়া বিজ্ঞানের জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি। মৃত্যুকালে হিগসের বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। কে এই বিজ্ঞানী পিটার হিগস! তাঁর দিগন্তকারী আবিষ্কার ঈশ্বরকণা বা গডস পার্টিকলই বা কী!
আরও পড়ুন-আত্মপ্রকাশ ইউনাইটেডের
পিটার হিগস হলেন নোবেলজয়ী ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী এবং শিক্ষক। ঈশ্বরকণার উপস্থিতির ভবিষ্যদ্বাণী তিনি করেছিলেন ৬০-এর দশকে। ১৯৬৪ সালে হিগস বোসন তথা ‘ঈশ্বরকণা’র অস্তিত্বের কথা বলে বৈজ্ঞানিক মহলে রীতিমতো হইচই ফেলে দেন পিটার হিগস। এরপর পেরিয়েছে ৫০ বছর অর্থাৎ প্রায় পাঁচ দশক। ‘ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চে’ লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডার-যন্ত্রের পরীক্ষা ‘ঈশ্বরকণা’র উপস্থিতি প্রমাণিত করে। তখনও পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং দামি গবেষণার মেশিন ছিল এই লার্জ হ্যাড্রেন কোলাইডার। ২০১২ তে আবিষ্কৃত হল হিগস বোসন বা ঈশ্বরকণা।
পিটার হিগস
পিটার হিগসের বাবা ছিলেন বিবিসির সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার। ছোটবেলায় অ্যাজমা ছিল হিগসের। তাই প্রথমদিকে বেশ কিছু বছর তিনি বাড়িতে থেকেই পড়াশুনো করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সতেরো বছর বয়সে প্রথম গণিত আর পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো করতে লন্ডনে চলে যান। একজন আণবিক জীববিজ্ঞানী হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন হিগস। ম্যাথমেটিক্যাল ফিজিক্সের লেকচারার হিসেবে আজীবন যুক্ত ছিলেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। হিগস শান্ত, কোলাহল মুক্ত পরিবেশে নিজের গবেষণার কাজে মগ্ন থাকতেন। শিক্ষক এবং মেন্টর হিসেবে ছিলেন তরুণ বিজ্ঞানীদের অনুপ্রেরণা।
খুব লাজুক প্রকৃতির, সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত হিগস কখনও মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট ব্যবহার করেননি। হিগসকে পাওয়ার একমাত্র উপায় ছিল তাঁর বাড়ির ল্যান্ডলাইন। ২০১২ সালের জুলাইতে যখন ‘হিগস বোসন’ আবিষ্কারের ঘোষণা হল তখন মিডিয়াকে এড়াতে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। এমনকী নোবেল কমিটিও তাঁকে খুঁজে পাচ্ছিল না। শেষে এক পরিচিত তাঁকে রাস্তায় হাঁটতে দেখে গাড়ি থামান আর নোবেল পাওয়ার খবরটি দেন।
আরও পড়ুন-প্রধান বিচারপতিকে চিঠি ‘খেলাটা’ চালিয়েই যাচ্ছেন মোদি! এবার ২১ জন প্রাক্তনের চিঠি
ঈশ্বরকণা কী? কেন এমন নাম?
ঈশ্বরকণা বা গডস পার্টিকল বা হিগস বোসন হল সেই কণা যা অন্য প্রতিটি মৌলিক কণার ভরের জন্য দায়ী অর্থাৎ অন্য কণা বা অন্য পার্টিকলকে ভর জোগায় হিগস বোসন কণা। এই ব্রহ্মাণ্ড অণু-পরমাণু, গ্রহ নক্ষত্রে ভরা। এই সবকিছু ঠিকঠাক আছে, বস্তুর ভর আছে বলে। তাই তারা আলোর কণা ফোটনের (যার ভর নেই) মতো দিগ্বিদিকে সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার বেগে ছুটে বেড়াচ্ছে না। হিগস বোসন এইসব অন্য কণাদের ভর জোগায় বলে এই ব্রহ্মাণ্ড স্থির আছে না হলে কবেই সব ওলটপালট হয়ে যেত।
পরমাণুর স্থায়ী মূল কণিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে হালকা কণিকা হচ্ছে ইলেকট্রন, সবচেয়ে ভারী কণিকা হচ্ছে নিউট্রন। ইলেকট্রনকে তো আর ভাঙা যায় না, কিন্ত নিউট্রনকে ভাঙলে দুটি ডাউন কোয়ার্ক আর একটি আপ কোয়ার্ক পাওয়া যায়। এই ডাউন কোয়ার্ক আর আপ কোয়ার্কের ভরও আবার ভিন্ন ভিন্ন রকম।
আরও পড়ুন-ভরা মাঠে আগেও খেলেছি : রিয়ান
বিভিন্ন কণার মধ্যে ভরের যে পার্থক্য, কীভাবে সৃষ্টি হয়?
এই ভর সৃষ্টির রহস্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগস বললেন, এই মহাবিশ্বের প্রতিটি স্থানে একটি অদৃশ্য শক্তি ক্ষেত্র (এনার্জি ফিল্ড) রয়েছে। বিভিন্ন কণা সৃষ্টি হওয়ার ঠিক পর থেকেই এরা এই এনার্জি ফিল্ডের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটায়।
প্রত্যেক ক্ষেত্রেরই আবার বহনকারী কণা আছে। যেমন, তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্রের বাহক কণা হল ফোটন। ঠিক তেমনই এই এনার্জি ফিল্ডেরও একটি বাহক কণা আছে যেটিকে বলা হয় হিগস বোসন।
হিগসের তত্ত্ব অনুযায়ী, সদ্য উৎপন্ন কণাগুলো হিগস ফিল্ড (এই এনার্জি ফিল্ডটাকেই হিগস ফিল্ড বলা হয়) এর বাহক কণাদের সঙ্গে অর্থাৎ হিগস বোসনদের সঙ্গে যত বেশি সংঘর্ষ করবে, এর ভরও তত বেশি হবে। অর্থাৎ যত বেশি সংঘর্ষ, তত বেশি ভর এবং যত কম সংঘর্ষ, তত কম ভর।
আরও পড়ুন-তৃণমূল নেত্রীকে টার্গেট করতেই সন্দেশখালি নিয়ে প্রচার বিজেপির! ক্ষোভ প্রকাশ কৃষক নেতার
এ হল হিগস বোসন, তবে ঈশ্বরকণার অস্তিত্ব কোথায়
মজার কথা হল, পিটার হিগস এই হিগস বোসন কণার অস্তিত্ব তত্ত্বগতভাবে প্রমাণ করলেও বিজ্ঞানীরা ব্যবহারিকভাবে এর কোনও অস্তিত্বই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী লিওন লিডারম্যান ১৯৯০ সালে তাঁর এক বইয়ে এই হিগস বোসন কণাকে ‘দ্য গডড্যাম পার্টিকল’ বলে নামকরণ করেন। বইটি ছাপা হওয়ার আগে প্রকাশক এই ‘গডড্যাম’ শব্দটি থেকে শুধু গড রেখে ড্যাম শব্দটি কেটে দেন। ফলে হিগস বোসন কণা হয়ে যায় দ্য গড পার্টিকল। সেই থেকে আমরা হিগস বোসনকে তার আসল নাম থেকেও গড পার্টিকল বা ঈশ্বরকণা বলে পরিচিত হয়ে যায় সবার কাছে।
পিটার হিগস এবং সত্যেন বসু
২০১২ সালে সার্নের এলএইচসিতে আবিষ্কার হয় হিগস বোসন কণা আর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী পিটার হিগসের নাম রাতারাতি ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে ভারত তথা এই বঙ্গে রব উঠল উপেক্ষিত হয়েছেন ‘হিগস বোসন কণার আদি প্রবক্তা’ সত্যেন বোস। বলা হল বাঙালি বলেই তিনি নাকি আদর পেলেন না বিশ্ব দরবারে। এরপর পরেই ২০১৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে বেলজিয়ামের ফ্রাঁসোয়া এংলার্টের সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার পেলেন পিটার হিগস। সত্যেন বোস পেলেন না কোনও স্বীকৃতি। কিন্তু প্রশ্ন হল, হিগস বোসনের সঙ্গে আদৌ কোনও সম্পর্ক রয়েছে কি সত্যেন বোসের?
আরও পড়ুন-অভিষেকের কপ্টারে তল্লাশি নিয়ে বিজেপিকে আক্রমণ শানালেন তৃণমূল সুপ্রিমো
একটু সহজ ভাষায় বললে সত্যেন বোস একটা তত্ত্ব দিয়েছিলেন, যেটা বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান। এই তত্ত্ব যে কণা মেনে চলে তারা জায়গা বোসন শ্রেণিতে। পিটার হিগসের ভবিষ্যদ্বাণী করা কণাগুলোর কেমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তার হিসাব কষেছিলেন পিটার হিগস এবং তাঁর দলই। যেহেতু কণাগুলো আসলে বোস-আইনস্টাইন পরিসংখ্যান মেনে চলে। তাই এই কণার নামকরণ করা হয়েছিল হিগস বোসন। সত্যেন বোসের সঙ্গে হিগস বোসনের সম্পর্ক আসলে এতটুকুই। কাজেই সত্যেন বসু উপেক্ষিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
বিজ্ঞানের ভাষায়— পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের প্রস্তাবিত মৌলিক কণাই হিগসের সেই যুগান্তকারী আবিষ্কার। এই আবিষ্কার, ইলেকট্রন এবং প্রোটনের মতো সমস্ত মৌলিক কণা এবং ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম, মাধ্যাকর্ষণ বা পারমাণবিক শক্তির মতো শক্তিগুলোকে বর্ণনায় সাহায্য করেছে। পাশাপাশি, পদার্থের উপাদানের গঠনকে আরও স্পষ্ট করেছে। যদিও এখনও অনেক গবেষণাই বাকি।