কৃষ্ণের রাজধানী দ্বারকা শহরটি নির্মাণ করেছিলেন লৌহদেব বিশ্বকর্মা। স্বর্গ, লঙ্কাপুরী তিনিই নির্মাণ করেছিলেন। হিন্দুদের স্থাপত্যের দেবতা তিনিই। তাঁকেই বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বেদে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বকর্মা বলা হয়েছে। তাঁর পুজো মানেই ঘুড়ি-লাটাই আর দুপুরে জমিয়ে খাসির মাংস খাওয়াদাওয়া।
হিন্দুদের পৌরাণিক কাহিনিমতে বিশ্বকর্মা ছিলেন দেবশিল্পী। বিষ্ণুপুরাণের মতে প্রভাসের ঔরসে বৃহস্পতির ভগিনীর গর্ভে দেবতা বিশ্বকর্মার জন্ম।
আরও পড়ুন-গণপতি বাপ্পা
ভগবান বিশ্বকর্মা বাচস্পতি, মনোজব, বদান্য, কল্যাণকর্মা, বিধাতা। সৃষ্টিশক্তির রূপক নাম হল বিশ্বকর্মা। সর্বজ্ঞ দেবতাদের নামদাতা তিনিই। কথিত আছে, বিশ্বকর্মা সর্বমেধ-যজ্ঞে নিজেকে নিজের কাছে বলি দেন। ঋগ্বেদের মতে, তিনি সর্বদর্শী ভগবান। তাঁর চক্ষু, মুখমণ্ডল, বাহু ও পা সর্বদিক বিদ্যমান। বাহু আর পায়ের সাহায্যে বিশ্বকর্মা স্বর্গ, মর্ত্য নির্মাণ করেন।
বিশ্বচরাচরে শিল্পসমূহের প্রকাশক বিশ্বকর্মা। তিনি অলঙ্কারের স্রষ্টা, দেবতাদের বিমান-নির্মাতাও তিনিই। তাঁর কৃপায় মানুষ শিল্পকলায় পারদর্শিতা অর্জন করে। উপবেদ, স্থাপত্য-বেদের প্রকাশক এবং চতুঃষষ্টি কলার অধিষ্ঠাতা দেবতা তিনিই। প্রাসাদ, ভবন ইত্যাদির শিল্পী বিশ্বকর্মা। তিনিই দেবতাদের জন্য অস্ত্র তৈরি করেন। মহাভারতের মতে–– বিশ্বকর্মা ছিলেন শিল্পের শ্রেষ্ঠ কর্তা, সহস্র শিল্পের আবিষ্কারক, সর্বপ্রকার কারুকার্য-নির্মাতা। রামের জন্য সেতুবন্ধ নির্মাণকালে বিশ্বকর্মাই নরবানরকে সৃষ্টি করেছিলেন। কোনও কোনও পুরাণমতে, বিশ্বকর্মা বৈদিক আচারের দেবতার কর্মশক্তিও আত্মসাৎ করেছিলেন। এই কারণের জন্য তিনি ত্বষ্টা নামেও অভিহিত হন।
আরও পড়ুন-শরৎ কুটির
বিশ্বকর্মার কন্যার নাম ছিল সংজ্ঞা। তিনি তাঁর কন্যার সঙ্গে সূর্যের বিবাহ দেন। সংজ্ঞা সূর্যের প্রখর তাপ সহ্য করতে না পারায়, তিনি সূর্যকে শানচক্রে স্থাপন করে তাঁর উজ্জ্বলতার অষ্টমাংশ কেটে ফেলেন। এই কর্তিত অংশ পৃথিবীর উপর পতিত হলে, সেই অংশের থেকে বিশ্বকর্মা বিষ্ণুর সুদর্শনচক্র, শিবের ত্রিশূল, কুবেরের অস্ত্র, কার্তিকেয়র শক্তি এবং অন্য দেবতাদের অস্ত্রশস্ত্রাদি নির্মাণ করেন। অতীতে শ্রীক্ষেত্রের প্রসিদ্ধ জগন্নাথমূর্তি বিশ্বকর্মা প্রস্তুত করেন। বাঙালি হিন্দুগণ যে বিশ্বকর্মার মূর্তি পুজো করেন তিনি চতুর্ভুজ। এক হাতে দাঁড়িপাল্লা, অন্য হাতে হাতুড়ি, ছেনি, কুঠার থাকে। এইগুলি শিল্পের প্রয়োজনীয় জিনিস। তাই শিল্প-দেবতা বিশ্বকর্মা এইগুলি ধারণ করে থাকেন। দাঁড়িপাল্লার একটি কারণ আছে। তার মধ্যরেখা বা সূচককে স্থির রাখতে হবে। আমাদের জীবনের কাঁটাটিকেও আত্মিক বিন্দুতে স্থির রাখতে হবে। দুই পাল্লার একদিকে থাকবে জ্ঞান আর অন্যদিকে থাকবে কর্ম। জ্ঞানের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়লে কর্মকে অবহেলা করা হবে! পরিণামে আসবে দুঃখ, অভাব। কাঁটাটি কর্মের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়লে তবে আসবে আধ্যাত্মিক অকল্যাণ। কাঁটাটি দুয়ের মাঝে সমন্বয় করে রাখতে হবে। কোনও দিকেই যেন বেশি না ঝুঁকে পড়ে। এই নিয়ম না মেনে চললে বিশ্বপ্রেম, বিশ্বভ্রাতৃত্ব সচেতনতা কোনওেটাই সম্ভব না। বিশ্বকর্মার মূর্তি যদি দেখি, তাহলে দেখা যায় তাঁর বাহন হস্তী। রাজহাঁসের বদলে এখন তাঁর বাহন হয়েছে হাতি বা হস্তী। কলকাতার কর্মকার সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নেতা শিক্ষাব্রতী স্বর্গত হরষিত কেশরী রায় প্রথম বিশ্বকর্মার হস্তী-বাহন বিগ্রহের পুজো করেন।
আরও পড়ুন-অনন্তনাগে গুলির লড়াই, বারামুলায় নতুন সংঘর্ষে নিকেশ ২ জঙ্গি
তবে হাতি কেন বিশ্বকর্মার বাহন! পুরাণের প্রণাম মন্ত্রে বিশ্বকর্মাকে মহাবীর বলা হয়েছে। হাতির কতটা শক্তি, তা আন্দাজ করা কঠিন। প্রাচীন কালে রাজারা যুদ্ধে হস্তী-বাহিনী ব্যবহার করতেন। এই মহাশক্তিমান প্রাণী, এইদিক থেকে মহাযোদ্ধা বিশ্বকর্মার বাহন হবার যোগ্যতা রাখে। হস্তীর হাত নেই। একটি কর বা শুঁড় আছে। কর আছে বলেই হাতির আর এক নাম করী। কৃ ধাতু থেকেই কর শব্দটির উৎপত্তি।
আবার দেখি শিল্পের মাধ্যমেই কর্মসংস্থান। তাই বিশ্বকর্মা কর্মের দেবতা। শূণ্ড দ্বারা কর্ম করা— তাই এই দিক থেকে হাতি বিশ্বকর্মার বাহন হিসেবে মানানসই।
হাতিকে দিয়ে অনেক কাজ করানো হয়। বন দফতর হতিকে দিয়ে কাঠ সরানোতে কাজে লাগায়। মোটা গাছের গুঁড়ি, কাণ্ড মাহুতের নির্দেশে হাতি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যায়। বন্যহাতিদের তাড়াতে বন দফতর পোষা হাতিগুলিকে কাজে লাগায়। শিল্পের সঙ্গে কর্মের সংস্থান জল আর ঠান্ডার মতো। জলে যেমন ঠান্ডা ভাব থাকে তেমনই কর্মের মাধ্যমেই শিল্পের বিকাশ আর প্রকাশ। তাই বিশ্বকর্মা হলেন কর্মেরও দেবতা। এই দিক থেকে শ্রমিক হাতি বিশ্বকর্মার বাহন হিসেবে একেবারেই মানানসই।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের আটকে রাখা একশো দিনের কাজের টাকা আদায়ে অভিষেকের দিল্লিযাত্রায় সঙ্গী পুরুলিয়াও
বিশ্বকর্মা পুজো মানেই আকাশে নানারকম ঘুড়ির মেলা। পেটকাটি, চাঁদিয়াল, মোমবাতি, বগ্গা— ছোটবেলার নস্টালজিক। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন সকাল থেকেই কত রকমের ঘুড়ির শোভা আকাশে-আকাশে। এই পুজো যেন বাঙালির শারদীয়া উত্সবের আগমনি বার্তা বয়ে আনে।
পুরাণ মতে, বিশ্বকর্মা হলেন দেবলোকের কারিগর। দেবতাদের ইঞ্জিনিয়ার অথবা প্রকৌশলী তিনি। ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্মাদেব এই ধরাধামকে নিজের হাতে তৈরি করেন। কৃষ্ণের বাসস্থান দ্বারকানগরী গড়ে ওঠার পিছনেও রয়েছে এই দেবতার হাত।
শোনা যায়, বিশ্বকর্মা দেবতাদের জন্য উড়ন্ত রথ তৈরি করেছিলেন। তা স্মরণ করতেই পুজোর দিন ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন শুরু হয়। শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ার, বিল্ডার, কারিগরদের কাছে এটি এক বিশেষ দিন। কথিত রয়েছে, রাজ আমলে বর্ধমান রাজবাড়িতেও ঘুড়ি ওড়ানোর চল ছিল। কোচবিহারের রাজাও ঘুড়ি ওড়াতেন। তবে বর্ধমানের রাজা মহতাবচাঁদ নাকি নিজেই ঘুড়ি ওড়াতেন। বর্ধমানের রাজারা এসেছিলেন পাঞ্জাব থেকে।
আরও পড়ুন-পুলিশের সাফল্য: চুঁচুড়ায় নাবালিকা অপহরণে ধৃত ৫
সেখানে ঘুড়ির উৎসব বেশ জনপ্রিয় ছিল। বর্ধমানের রাজাদের হাত ধরেই বর্ধমানে ঘুড়ি উৎসবের শুরু হয়, এবং জনপ্রিয়তা বাড়ে বলে জানা যায়।
বাংলাদেশ, ভারতের অসম, উত্তরপ্রদেশ, কর্নাটক, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা এবং ত্রিপুরা রাজ্যে সৌর বর্ষপঞ্জি অনুসারে বিশ্বকর্মা পুজোর দিনটি পালিত হয়। প্রতিবেশী দেশ নেপালেও এই উৎসব উদযাপিত হয়। কোনও কোনও অঞ্চলে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে দীপাবলির একদিন পরও গোবর্ধন পুজোর সঙ্গে, বিশ্বকর্মা পুজো পালন করা হয়। বাঙালির বিশ্বকর্মা স্বতন্ত্র একটি পুজো।
আরও পড়ুন-অনন্তনাগের কোকারনাগ এনকাউন্টার সাইটে সার্চ অপারেশন, নজরদারির জন্য ব্যবহৃত ড্রোন
দক্ষিণ ভারতে দেবশিল্পীর পুজো হয় তিথি মেনে, মহানবমীর দিন। উত্তর, পশ্চিম ভারতে দিওয়ালির পরের দিন বিশ্বকর্মা পুজো হয়। তবে বাংলায় এই পুজো সৌর ক্যালেন্ডার মেনে হয়। সূর্যের কন্যা রাশিতে প্রবেশ করার দিন বঙ্গে পুজো পান বিশ্বকর্মা। ভারতের থেকে আলাদা হয়ে বাংলায় তাঁর পুজো মানে ঘুড়ির উৎসবও! এক সময়ে তিনি ছিলেন প্রথম সারির দেবতাদের একজন। এখন হয়ে গিয়েছেন দেবশিল্পী! বেদের চৌহদ্দি ছেড়ে বিশ্বকর্মার ঠিকানা কারখানা, দোকান, অটো স্ট্যান্ড, সিন্ডিকেটের অফিসও! বাঙালির বিশ্বকর্মা স্বতন্ত্র পুজো এবং রীতিতেও এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসবিদরা বলছেন, ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে বিশ্বকর্মার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে তিনি বিশ্বের স্রষ্টা। তাঁর যে রূপের কথা জানা যায়, তাতে বৃদ্ধ, এক মুখ সাদা গোঁফ-দাড়িতে ঢাকা। একদা বাহন ছিল রাজহাঁস। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সমার্থক। অথর্ববেদেও তাঁর উল্লেখ রয়েছে। বেদ-পরবর্তী যুগে তিনি হয়ে উঠলেন দেবশিল্পী, কারিগর-শ্রেষ্ঠ। দেবতাদের আয়ুধ-নির্মাতা তিনিই। শোনা যায় সত্যযুগে তিনি স্বর্গ তৈরি করলেন। ত্রেতায় তৈরি করলেন রাবণের স্বর্ণলঙ্কা। দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা আর পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থের রূপকারও তিনিই। তাঁর ধ্যানমন্ত্র থাকলেও মহিমা-কীর্তন শোনা যায় না। স্থায়ী কোনও ইতিহাসখ্যাত মন্দিরের কথাও শোনা যায় না।
আরও পড়ুন-বিশ্বকাপ নিয়ে বৈঠক হল দূতাবাসের সঙ্গেও, জোর প্রস্তুতি ইডেনে
দেবশিল্পী হিসেবেই তিনি ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছেন পশ্চিম থেকে দক্ষিণ ভারত জুড়ে। বহু গবেষক বলেন, ভারত নয়, তাইল্যান্ড, কম্বোডিয়ার মতো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশেও দেবশিল্পী হিসেবে বিশ্বকর্মার উল্লেখ রয়েছে। দক্ষিণ ভারতে বিশ্বকর্মার সঙ্গে বাহন হিসেবে বাঘ আর গরুকে দেখা যায়। সেই রূপের সঙ্গে কোনও ভাবেই বাংলার হতি বাহন বিশ্বকর্মাকে মেলানো যায় না।
পূর্ব ভারতে সম্ভবত প্রথম বিশ্বকর্মার উল্লেখ মেলে ওড়িশায়। ইতিহাস বলছে, জগন্নাথের মূর্তি তৈরির কারিগর ছিলেন বিশ্বকর্মা। পরবর্তীকালে মনসামঙ্গল কাব্যে লখিন্দরের লোহার বাসরঘরের কারিগরও তিনিই। তাঁর রূপের বর্ণনা কোথাও করা হয়নি। বাংলার কারখানা আর দোকানে তিনি ঢুকলেন উত্তর-ঔপনিবেশিক ধারাতে। শিল্পভিত্তিক সমাজ কারিগরি উৎকর্ষের প্রতীক হিসেবে হিন্দুধর্ম থেকে বিশ্বকর্মাকেই বেছে নিয়েছিল। ইংরেজি ক্যালেন্ডার মেনে বিশ্বকর্মার পুজো হয়। দেবতারা সব সময়েই নিম্নবর্গের হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন আমাদের সমাজে। নিম্নবর্গীয় বাঙালি তাই নিজের কল্পনা মেনেই বিশ্বকর্মাকে যুবক হিসেবে বরণ করেছে, এককালে। তরুণ কারিগর বা মৃৎশিল্পীর হাত ধরেই, এমন সুদর্শন যুবক রূপ পেয়েছি আমরা বিশ্বকর্মাকে। কেউ কেউ বলেন, পশ্চিম ভারতে মকর সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। এ-রাজ্যেও মকর সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ রয়েছে, প্রাচীনকাল থেকেই। সেই সঙ্গে বাংলায় বর্ষা বিদায়ের অঙ্গ হিসেবে ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ, ভাদ্র শেষে শরতের আগমনের হেতু হতে পারে। অনেকের মত, কাকতালীয় ভাবেই তা বিশ্বকর্মার সঙ্গে মিশে গিয়েছে। যেভাবে খাওয়াদাওয়া মিশেছে এই পুজোকে ঘিরে।
আরও পড়ুন-বিশ্বকাপ নিয়ে বৈঠক হল দূতাবাসের সঙ্গেও, জোর প্রস্তুতি ইডেনে
ঔপনিবেশিক আমল থেকেই বাংলার গঙ্গার দু’পারে চটকল, শিল্পতালুকগুলিতে বিশ্বকর্মা পুজোর রমরমা শুরু হয়েছিল। ধর্মীয় আঙিনা ছেড়ে সামাজিক উৎসবে মিশে গিয়েছিল বিশ্বকর্মার পুজো। ব্যারাকপুর, নৈহাটি, দুর্গাপুর, আসানসোল শিল্পতালুকে অতীতে বহু অহিন্দু শ্রমিক, তার নববধূকে সাইকেলে চাপিয়ে কারখানায় ভোগ খেতে যেতেন। তবে দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে ইতিহাসও। বাংলায় এসে আর তেমন রূপ বদলাননি বিশ্বকর্মা। আধুনিকতার দাপটে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে ঠাঁই পাননি বিশ্বকর্মা। তাই বিশ্বকর্মা এখন রিকশা স্ট্যান্ড, অটো স্ট্যান্ড, প্রোমোটিং শিল্পেই থিতু হয়েছেন। বিশ্বের স্রষ্টার স্থান এখন নিম্নগোত্রের শিল্পের স্রষ্টাদের হাতেই।