আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে কালিদাসের দলা-পাকানো ঘন মেঘ আকাশ ছাইছে, তৈরি হচ্ছে বর্ষার পটভূমি। এর ক’দিন পর সূর্য তার বার্ষিক নক্ষত্র পরিক্রমায় মৃগশিরা থেকে আদ্রাতে গমন করবে, ধরিত্রী হবেন ঋতুমতী। তিনদিনের ঋতু শেষে পৃথিবী হবেন ফসল ধারণের উপযুক্ত। কর্ষণ ও বীজ বপন করে মাটির বুকে ফলবে সবুজ ফসল, ধরণী হবেন গর্ভবতী। মানবকন্যার মাসিক ঋতুচক্র হলেও পৃথিবীর কিন্তু বার্ষিক ঋতুচক্র এবং সেই নির্দিষ্ট দিনটি হল আষাঢ়ের সাত। ধরিত্রীর ঋতুমতী হওয়ার তিথি— জলের প্রাচুর্য সংস্কৃতে অম্বুবাচী।
পিরিয়ড, মাসিক বা ঋতুচক্র— নারী শরীরের সম্পূর্ণতা। এই পদ্ধতি নারী শরীরের জরায়ু নামক অঙ্গকে গর্ভ ধারণের উপযুক্ত করে তোলে। অথচ মাতৃতান্ত্রিক এই গর্বকে ঘিরে কত সংস্কার, ঘৃণা এমনকী প্রকাশ্য আলোচনাও নিষিদ্ধ। ক’জন মানুষ জানে মেয়েদের এই ঋতুচক্রের হিসেব দিয়েছিল প্রাচীন ক্যালেন্ডারের জন্ম। সিন্ধু সভ্যতার নারী মূর্তিতে ইউনিকর্নের শিংয়ের দাগগুলো পণ্ডিতদের এক মতে ঋতুচক্রের হিসেব।
ডিম্বাণু ধরে রাখতে না পারার ব্যর্থতায় জরায়ু ভেঙে পড়ে কান্নায়। একমাস ধরে জমানো দেওয়ালের এন্ড্রো মেট্রিয়াম-এর লাইনিং ভেঙে গিয়ে রক্তনদীর ধারা বেরিয়ে আসে যোনিপথ দিয়ে লাগাতার। চারদিন পর জরায়ু কান্না থামিয়ে আবার মন দেয় দেওয়াল গড়ার কাজে। মেনার্ক থেকে মেনোপোজ— অর্থাৎ প্রথম রজ থেকে রজনিবৃত্তি পর্যন্ত প্রতিটি মেয়ের শরীরে এভাবেই চলে ভাঙা-গড়ার খেলা শুধুমাত্র এক নিষিক্ত ডিম্বাণুকে ঠাঁই দেওয়ার তাগিদে, একটি প্রাণের জন্ম দেওয়ার লক্ষ্যে। এটাই প্রতি মাসে মেয়েদের মাসিক ঋতুচক্র— ফিসফিসে গোপন ভাষায় ‘মাসিক’ কিংবা ‘শরীর খারাপ’।
আরও পড়ুন-হজযাত্রীদের প্রথম উড়ান আজ নামছে কলকাতায়
প্রকৃতি নারী-শরীর গড়েছে বিশেষ যত্ন নিয়ে। সন্তান ধারণ করার জন্য একটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত হতে হয় শুক্রাণু দ্বারা। সেই নিষিক্ত ডিম্বাণু জরায়ুর গর্ভে প্রোথিত হবে থাকবে নয় মাস। তার লাগবে বিশেষ পুষ্টি তাই, জরায়ুর দেওয়াল তৈরি হবে প্রোটিনের আস্তরণ দিয়ে। মোটামুটি দশ থেকে পঞ্চাশ বছরের মহিলার শরীর উর্বর, ফসল ফলাতে পারবে, তাই প্রতি মাসে তার জরায়ু বা ইউটেরাসের গায়ে জমবে প্রোটিনের আস্তরণ। নিষিক্ত হলে প্রোথিত হবে জরায়ুর গায়ে— গর্ভাধানের প্রধান লক্ষণ হিসেবে ঋতুস্রাব থাকবে বন্ধ। ডিম্বাণু নিষিক্ত না হলে সেটা আস্তরণের সঙ্গে ঋতুস্রাব হয়ে বেরিয়ে আসবে।
দেবতার মানবায়নের ইতিহাস বহু প্রাচীন। যেহেতু মানুষ প্রকৃতির অঙ্গ তাই প্রকৃতি ছিল মানুষের প্রধান উপাস্য। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ প্রকৃতিকে পুজো করেছে, দিয়েছে মায়ের মর্যাদা। গরমের শুকনো মাটি প্রথম বর্ষায় ক’টা দিন ভিজুক, উপযুক্ত হোক কর্ষণের। এর পর মাটি হবে উর্বর, ফসল ফলবে প্রচুর। তাই মানবকন্যার উদাহরণ সামনে রেখে করা হল সমীকরণ। ঋতুমতী কন্যার সাথে সহবাস করা হয় না, ঋতুচক্র মিটে গেলে তারপর শরীর হয় বেশি ফলপ্রদ বা ফার্টাইল। ঠিক সেইরকম, বৃষ্টির প্রথম দিনগুলোতে মাটি যখন ভিজছে তখন হবে না কোনও কর্ষণ। পৃথিবীকে ঋতুমতী ভাবা হল কন্যার সঙ্গে তুলনা করে।
প্রতি বছর আষাঢ়ের সাত তারিখে শুরু হবে অম্বুবাচী। যেহেতু কামাখ্যায় সতীদেহের যোনি পতিত হয়েছিল ভাবা হয় তাই অম্বুবাচীর সময় কামাখ্যা বিশেষ গুরুত্ব পাবে, এটাই স্বাভাবিক। তিনদিনের জন্য মন্দির বন্ধ থাকবে। চতুর্থ দিন স্নানের পর মন্দির খুলবে। বিরাট সমারোহ বাইরে। ঋতুস্রাব-তুল্য ক্ষরণ নাকি এখানে সাদা কাপড়কে লাল করে তোলে। সেই লাল বস্ত্রখণ্ড সেবাইতরা বিতরণ করেন ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে ঝামেলা। কে বলতে পরে প্রকৃতির অপার রহস্যের কথা! কে বলতে পারে কোনও খনিজ এমন আছে হয়তো বছরের এই বিশেষ সময়ে এই বিশেষ জায়গার মাটি চুঁইয়ে বেরিয়ে আসে যাকে প্রকৃতির ঋতুস্রাব ভেবেছিল প্রাচীন কালের লোকেরা!
আরও পড়ুন-হজযাত্রীদের প্রথম উড়ান আজ নামছে কলকাতায়
অম্বুবাচীতে পৃথিবী হয়েছেন ঋতুমতী তাই কর্ষণ চলবে না এখন। মাটি খুঁড়ে কোনও কাজ চলবে না। মাটিকে সম্মান করে মাটি খুঁড়ে উনুন বানানো বন্ধ। তাই তিনদিন রান্না বন্ধ। গাছের ফলপাকুড় খেয়ে বা সঞ্চিত খাদ্যে ঠিক কেটে যাবে ক’টা দিন। মাটি ভাল করে ভিজুক তারপর আবার শুরু হবে চাষবাস— জীবন ফিরবে স্বাভাবিক ছন্দে। মাটিরূপ মাকে এইটুকু মাত্র সম্মান কিংবা ভালবাসা যুগে যুগে বিকৃত হতে হতে তার ইতিহাসটাকেই পাল্টে ফেলেছে। ঋতুমতী হওয়া যে একটা উৎসব সেটাই মানুষ করেছে বিকৃত, ধরণী অশুচি তাই নির্বাচিত কিছু মানুষ তার শুচিতা বজায় রাখবে অশুচি ধরণীতে খাবার না বানিয়ে। ধর্মের পঙ্কিলতা এতটাই যে সে মাকেও ভাবতে পারে অশুচি, আর সেই ধর্ম আমাদের ধারণ করে রাখে এক নির্ভেজাল কুসংস্কারের ঘেরাটোপে। আর অশুচি ধরণীতে রান্না করা খাবার খেলেই দোষ, রান্না না-করা খাবার, ফল, মূল এগুলো কি পৃথিবীর বাইরে কোনও মঙ্গল গ্রহ উৎপাদন করেছে?
আরও পড়ুন-ঋতুচক্রে লজ্জা নয়
পঞ্জিকার বিধান অম্বুবাচীর সময় যতী, ব্রতী বিধবা এবং সন্ন্যাসীরা রান্না করা খাবার খাবেন না। পৃথিবী এখন অশুচি তাই ওঁদের সাদা কাপড়ে অশুচিতার কাদা লাগবে। যুগে যুগে পুরুষের গায়ের জোরে, ক্রমাগত অজ্ঞান এবং অশিক্ষার ফলে, সঠিকভাবে দিশা দেখানোর কোনও ধর্ম সংস্কারক না থাকায় মাতৃধর্ম হয়েছে দূষিত, কলুষিত। আগ্রাসনের ফাঁদে পড়ে ইতিহাস হয়েছে বিকৃত। কত বড় ধৃষ্টতা মানুষের— যে ঘটনা নারীকে করবে মা হওয়ার উপযুক্ত সেই ঘটনাকে আখ্যা দেওয়া হবে অশুচি! উর্বরা হওয়ার ধাপের নাম হবে অমাবতী! প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়— সবই যদি কুসংস্কার তাহলে বর্তমানের এই সমাজেও পঞ্জিকাগুলো কোন গঞ্জিকার টানে অম্বুবাচী বিধবাদের পালনীয় বলে অপপ্রচার করে! পাশাপাশি এটাও ভাববার বিষয় শিক্ষা, সংরক্ষণ, আন্দোলন সব কিছুতেই মেয়েদের মনে শিক্ষার আলো পুরোপুরি ছড়াচ্ছে না। একপেশে ধ্যান-ধারণাগুলো সরছে না কিছুতেই।
নিতান্তই ভাগ্য খারাপ আমাদের। প্রাচীন কিছু প্রথা সনাতন ধর্মের কিছু সুন্দর আচরণ যুগে যুগে বিকৃত হয়েছে আমাদের হাতে। ধর্মপ্রচারক বা সংস্কারক না থাকায় সময়ের শ্যাওলা পরিষ্কার তো হয়ইনি জমেছে সাতপুরু স্তর হয়ে। স্বামী-নির্ভর স্ত্রীকে যদি সহমরণের নামে উপরে পাঠানোর সুযোগ এল তো ভাল, যদি ফসকে গেল তো বাকি জীবনটা উৎপাতে করে তোলো ব্যতিব্যস্ত। মানুষ যখন সেচব্যবস্থার সুযোগে মাটিকে যখন খুশি সিক্ত করে ফসল ফলাচ্ছে তখন আষাঢ়ের সাতের আলাদা গুরুত্ব কি আর থাকে? আর যদি-বা প্রাচীন প্রথাকে সম্মান জানাতে চাই তাহলে সকলেই করি অরন্ধন— বিধবাদের কীসের আলাদা ভূমিকা? শুচিতা রক্ষার দায় কি বিধবাদের একার? অম্বুবাচী কেন অমাবতী আর কীসের অশুচিতা?
দায় কিন্তু একা পুরুষতন্ত্রের নয়, রীতিমতো শিক্ষিত বিধবা মহিলারাও অম্বুবাচী, একাদশী পালন করে ধন্য হন, পরকালের পথ পিচ দিয়ে বাঁধিয়ে রাখছেন ভেবে আনন্দ পান। শিক্ষা আনে চেতনা, চেতনা ঘটায় বিপ্লব কিন্তু মাঝে তারটা কেটে দিয়ে যায় কু-সংস্কারের নেংটি ইঁদুরে। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সেইসব মহিলাদের যাঁরা দিনে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াচ্ছেন ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সেমিনার করে ফিরছেন, দুপুরে বেদান্তের ক্লাস করে সন্ধেবেলা বাড়ির অশান্তির ভয়ে অম্বুবাচী পড়ার আগেই মা কিংবা শাশুড়ির জন্য রান্না সেরে রাখতে বাধ্য হন!
‘পঞ্চভূতের ফাঁদে পড়ে ব্রহ্ম কাঁদে’— এক্কেরে খাঁটি কথা। নেহাত কথা বলতে পারে না ঠাকুরগুলো নাহলে ডাক ছেড়ে কাঁদত মানুষের অত্যাচারে। কামাখ্যা না হলে যোনিস্থল, রজস্বলা হলে যোনিস্থল বন্ধ থাকবে এটা স্বাভাবিক চিন্তা কিন্তু যেখানে যত দেবীমন্দির আছে সব জায়গায় দেখি লাল কাপড় দিয়ে দেবী প্রতিমার মুখ বা মন্দির আষ্টেপৃষ্ঠে বন্ধ। এই গরমে ঠাকুরের দম আটকে মরে যাওয়ার মতো অবস্থা। এই বাড়াবাড়িটা কয়েক বছর হল বেশি নজরে পড়ছে। সঠিক শিক্ষার অভাবে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি না তো? আর খুব ছোটবেলায় শুনতাম এসময় জোরে জোরে মাটিতে পা ফেলতে নেই, ছেলেরা মন্দিরে উঠবে না। নিয়মের আড়ালে কারণটা স্পষ্ট, ভাবনাটা অবশ্যই মানবিক। তাই বলে দেবীর মুখ ঢেকে রাখা!! আক্ষেপের বিষয় যে ধর্ম আমাদের ধারণ করে রাখে আমরা সেই ধর্মের কোনও ইতিহাস, তত্ত্ব বা দর্শন শিখি না। আমাদের কাছে ধর্ম মানে খানিক আচার আর প্রথা।
অম্বুবাচী উপলক্ষে তিনদিন বিধবাদের যে পালনের রীতি চলে তার অন্যতম রান্না করা খাবার না খাওয়া, পানীয় জলটাও সংগ্রহ করে রাখা। রান্না করে রাখা খাবার মানে কিন্তু আমিষ বা চালের দ্রব্য নয়। একদিন আবার শুধু ফল আর কাঁচা দুধ। আরও হাজার রীতি বাছবিচার যা লেখা থাকে না কোনও বইয়ে। তিনদিনের পর পঞ্জিকায় সময় দেখে স্নান করে মাজা বাসনে রান্না করে তবে খাওয়া। ছাড় দেওয়া হয়েছে জগন্নাথধাম অর্থাৎ পুরীকে। এখানে কোনওদিন কোনও উপবাস নেই, এখানে জগন্নাথের প্রসাদ অন্নগ্রহণ অবশ্য কর্তব্য। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার বোঁয়াইচণ্ডীতলা অম্বুবাচী-ফ্রি জোন। অনেক বিধবা মহিলাকে দেখা যায় অম্বুবাচীর দিনগুলো বোঁয়াইচণ্ডী তলায় থেকে প্রসাদ গ্রহণ করতে। অর্থাৎ আইনে সামান্য ফাঁক রইল, সুযোগ বুঝে ব্যবহার করার জন্য।
সমাজ ও ধর্মের ইতিকথা ঘেঁটে যা পাওয়া যায় তা হল চিরকালীন বঞ্চনার ইতিহাস। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায় দায় কার আর দায়িত্বই বা কার? অসহায়তার দিনগুলো তো হাত ধরে আগুন পাহাড় পার করে দিয়েছেন রামমোহন। অশিক্ষার নদী পার করে দিয়েছেন বিদ্যাসাগর। এখনও কেন মেয়েদের পরগাছা জীবন আর বিবিধ পালন? এখন তো সেই অর্থে আর বিধবারা অসহায় নন তাহলে তাঁরাই বা কেন প্রথা ভাঙার মতো সাহস দেখাতে পারছেন না? পরকালের রাস্তায় পালনের টাইলস বসিয়ে সুগম করার চিন্তা ছেড়ে সঠিক শিক্ষা আর নীতিবোধ সবার মনে ছড়িয়ে পড়ুক। এতে দেশের ও দশের মঙ্গল।
অম্বুবাচী পালন হলে হোক ঘরে ঘরে, সবার মধ্যে। পৃথিবী মাকে সম্মান দেখানোর দায় আমাদের সবার। চারদিনের রজচক্রের শেষে পৃথিবী যখন ঊর্বর হচ্ছে নববর্ষায় তখন সবাই যদি গাছ লাগায় তাহলে পৃথিবী-মাকে অনেক নির্মল আর বিষমুক্ত করে তোলা যাবে। বিষমুক্ত পৃথিবীতে শিক্ষা আনুক মুক্ত চেতনা, ভাবনার স্বচ্ছতা। ধর্ম ছাড়া সমাজ হয় না তাই সব অজ্ঞানতা ঢাকুক জ্ঞানের আলোতে। সব কিছু ছাপিয়ে ধর্ম ধরে রাখুক সবাইকে কোনও বিভাজন ছাড়াই।