খাঁটি বাঙালি। বাংলা সাহিত্যের বিবিধ শাখায় ছিল অবাধ বিচরণ। তবে তাঁর সাহিত্য-চর্চার সূচনা হয়েছিল ওড়িয়া ভাষায়। ২০ বছর বয়সে। তিনি অন্নদাশঙ্কর রায়। আদি বাড়ি হুগলির কোতরংয়ে। ১৯০৪ সালের ১৫ মার্চ জন্মেছিলেন ওড়িশার ঢেঙ্কানলে। জমিদার পরিবারে। সেখানেই কেটেছে জীবনের শুরুর দিনগুলো। জমিদার হিসেবে পূর্বপুরুষেরা ছিলেন প্রজাহিতৈষী, মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী। ঠাকুরদা শ্রীনাথ রায়, বাবা নিমাইচরণ রায় এবং কাকা হরিশচন্দ্র রায় ছিলেন সাহিত্যরসিক এবং শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক। এক বন্ধুর সঙ্গে মিলে ওড়িয়া ভাষায় নিমাইচরণ অনুবাদ করেন ‘শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত’। মা হেমনলিনী ছিলেন কটকের বিখ্যাত পালিত পরিবারের কন্যা, বৈষ্ণব ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মিশ্র পরিবেশে কেটেছে অন্নদাশঙ্করের শৈশব, যৌবন।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
মহাত্মা গান্ধী ছিলেন তাঁর আদর্শ। আরও এক আদর্শ রবীন্দ্রনাথ। কবিগুরু বিশেষ স্নেহ করতেন অন্নদাশঙ্করকে। বহুবার মুখোমুখি হয়েছিলেন তাঁরা। বাংলা তথা বঙ্গদেশ ছিল অন্নদাশঙ্করের রক্তে, ধমনীতে। আইসিএস হয়ে বিলেত থেকে ফিরে অনায়াসে ভারতের অন্য কোনও রাজ্যে শাসনকাজে যেতে পারতেন। কিন্তু অন্নদাশঙ্কর বেছে নিয়েছিলেন বাংলা। বাংলার মাটিতেই কাটিয়েছেন কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘ভারতের অন্য রাজ্যের বদলে বাংলা কেন?’ উত্তরে অন্নদাশঙ্কর বলেছিলেন, ‘বাংলাই আমার আরাধ্য’। রবীন্দ্রনাথের পরামর্শেই ছড়া লেখেন অন্নদাশঙ্কর। ‘রক্তকরবী’ নাটকের উপর একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেটা পড়ে বিস্মিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। টলস্টয়কেও গ্রহণ করেছিলেন আদর্শ হিসেবে। বাংলা ভাষায় তাঁর প্রথম প্রকাশিত মৌলিক রচনার বিষয় ছিল নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা। ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন-যোগী পুলিশকে ডোন্ট কেয়ার! রাজার হালে জেলে দিন কাটাচ্ছে দাগি অপরাধী
প্রমথ চৌধুরীর ‘সবুজপত্র’ ছিল অন্নদাশঙ্করের লেখক হয়ে ওঠার মূল প্রেরণা। তাঁর কাছে সাহিত্যচর্চা ছিল সাধনার মতো। হাজার ব্যস্ততার মধ্যেও বসতেন কাগজ-কলম নিয়ে। যা মাথায় এল লিখলাম পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। আগে পয়েন্টস নোট করতেন। তারপর নোট সাজিয়ে, যোগবিয়োগ করে লিখতেন। গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, ছড়া, সবকিছুর ক্ষেত্রেই। লেখা শুরুর আগে ঠিক করতেন লেখার শিরোনাম। তাতেই বুঝিয়ে দিতেন বক্তব্যের সারমর্ম।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর কলম থেকেই বেরিয়েছিল প্রথম এপিক উপন্যাস, ‘সত্যাসত্য’। যৌবনে, ছয় খণ্ডে লেখা। প্রতিটি খণ্ডের নাম আলাদা। পরিণত বয়সে লিখেছিলেন ‘ক্রান্তদর্শী’। চার খণ্ডে। বিষয় ভারত ভাগ, বাংলা ভাগ। রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়েছিলেন প্রেম, সামাজিকতা, সাম্প্রদায়িকতা, মানবতা, দেশভাগের পূর্বাপর ইতিহাস ইত্যাদি।
বেড়াতে পছন্দ করতেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গেছেন। ভ্রমণের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁর সাহিত্যে।
আরও পড়ুন-নারী-প্রগতির জয়ধ্বজার বাহক তৃণমূল কংগ্রেস
কর্মজীবনে ছিলেন দক্ষ প্রশাসক। কখনো মাথা নত করেননি। ১৯২৯ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার রাজশাহি, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, ত্রিপুরা, মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, নদীয়া, মেদিনীপুর, হুগলি এবং হাওড়ায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন। কখনো শাসন বিভাগে, কখনো বিচার বিভাগে। যথাক্রমে ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ হিসেবে। তবে তাঁর দৃষ্টি ছিল মাটির দিকে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের মেয়াদ শেষ হলে তিনি উচ্চতর পর্যায়ের ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসের সদস্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন ও বিচার বিভাগে কাজ করেন। রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বিষয়কে কেন্দ্র করে উপর মহলের সঙ্গে মতবিরোধ হয়। ১৯৫০ সালে পদত্যাগপত্র দেন। ১৯৫১ সালে বিচার বিভাগের সচিব পদ থেকে অব্যাহতি পান। চাকরি ছাড়ার পর বসবাস শুরু করেন শান্তিনিকেতনে।
চোখের সামনে দেশভাগ মেনে নিতে পারেননি অন্নদাশঙ্কর। নিজের ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন ছড়ায়। ১৯৪৭ সালে লিখেছিলেন ‘খোকা ও খুকু’। প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে/ খুকুর ’পরে রাগ করো,/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ করো। তার বেলা?’ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনও তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। ১৯৫৩ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে এক ঐতিহাসিক সাহিত্য মেলার আয়োজন করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনের কথা মনে রেখে কবিতাও লিখেছিলেন। তাঁর শান্তিনিকেতনের বাড়িতে নিয়মিত বসত সাহিত্য সভা। সেখানে সমাবেশ ঘটত আশ্রমের সাহিত্য রসিকদের। এছাড়া দেশি-বিদেশি বহু পণ্ডিত অতিথি হয়ে আসতেন। শান্তিনিকেতনে থাকাকালে অন্নদাশঙ্কর ছিলেন বিশ্বভারতীর কর্মসমিতির সদস্য। ষাট দশকের শেষ দিকে পারিবারিক কারণে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন।
আরও পড়ুন-ঘুম ঘুম
লাভ করেছিলেন দীর্ঘজীবন। বিচিত্র অভিজ্ঞতা উজাড় করে দিয়ে প্রায় সত্তর বছর ধরে প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, ছড়া, কবিতা, নাটক, পত্রসাহিত্য, আত্মজীবনীমূলক রচনা প্রভৃতি লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা বাংলায় ১২৩টি, ইংরেজিতে ৯টি, ওড়িয়া ভাষায় ৩টি। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি বৈচিত্র্যপূর্ণ। কেবল আঙ্গিকে নয়, ভাববৈচিত্র্যেও তাঁর রচনা কালোত্তীর্ণ। একদা উপেক্ষিত বাংলা ছড়াকে উন্নীত করেছিলেন অভিজাত সাহিত্যের শৈল্পিক স্তরে।
অন্নদাশঙ্কর ছিলেন সাহিত্য অকাদেমির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ফেলো। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির প্রথম সভাপতি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে জগত্তারিণী পুরস্কারে ভূষিত করে। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করে দেশিকোত্তম সম্মান। বর্ধমান, রবীন্দ্রভারতী ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রদান করে সম্মানসূচক ডিলিট। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, বিদ্যাসাগর পুরস্কার, শিরোমণি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, নজরুল পুরস্কার, বাংলাদেশের জেবুন্নিসা পুরস্কার। ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর তিনি প্রয়াত হন। উনিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁস ঐতিহ্যের শেষ প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। ধর্মের দাপাদাপির যুগে আজ তাঁকে বড় বেশি জানা প্রয়োজন, পড়া প্রয়োজন।