নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ বলেছিলেন, “Macroeconomic Policy can never be devoid of politices” (সমষ্টিগত অর্থনীতির নীতি কখনও রাজনীতি বহির্ভূত হতে পারে না)। স্টিগলিজের উক্তি অস্বীকার করার উপায় নেই। সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও উপস্থাপকেরা তাঁদের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সমস্ত তথ্যের পরিবর্তে বা প্রাসঙ্গিক তথ্যের পরিবর্তে আংশিক তথ্যের ভিত্তিতে এমনভাবে সমষ্টিগত অর্থনীতির তথ্য বিশ্লেষণ করেন যাতে পাঠকদের মধ্যে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হতে পারে যে উপস্থাপদের বিষয়টা সর্বাংশে সত্য। অতি সম্প্রতি রাজ্যের একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের (West Bengal Government) রাজস্ব কাঠামোকে এমনভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটি কার্যত বেঁচে আছে রাজ্যের নগণ্য নিজস্ব রাজস্ব আয়ের চেয়ে বিপুল কেন্দ্রের দেওয়া তহবিলের আনুকূল্যে এবং এই তহবিলের তাগিদ ক্রমশ বাড়ছে। রাজ্যের প্রাপ্য জিএসটির আয়ও কার্যত তলানিতে এবং কেন্দ্রের হস্তান্তর হতে অর্থ রাজ্যের মুখ্য আয়। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটির অর্থনৈতিক কাঠামো যেভাবেই হোক যতটা নিচে নামানো যায়, হয়ত সেই উদ্দেশ্য নিয়েই পরিসংখ্যানগুলোকে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রবন্ধটির প্রথমে ২০২২-’২৩ আর্থিক বছরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জিএসটির অবদান এবং কেন্দ্রীয় করের যে ভাগ ডেভলিউশন বা হস্তান্তরের মাধ্যমে এ রাজ্য ২০২৩-’২৪ সালে পাচ্ছে তা সবিস্তারে একটি সারণিতে তুলে ধরা হয়েছে। দুঃখ এখানে যে, এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের পরিসংখ্যানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ৪টি শিল্পোন্নত রাজ্যগুলির (মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, গুজরাত ও তামিলনাড়ু) সঙ্গে। এটা সর্বজনবিদিত যে ভারতের এই শিল্পোন্নত রাজ্যে জিএসটির অবদান অন্যান্য সমস্ত রাজ্য থেকে বেশি এবং এই তুলনায় পশ্চিমবঙ্গ যে সর্বদা নিচে থাকবেই এটা সর্বজনবিদিত। প্রশ্ন হল, কেন তুলনামূলকভাবে ভারতের কম শিল্পোন্নত রাজ্যগুলির সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা হল না? আসলে উপস্থাপকের উদ্দেশ্যটা হল হয়ত পশ্চিমবঙ্গ সবচেয়ে নিচে নামল। বর্তমান নিবন্ধে তাই প্রাসঙ্গিক বিষয়টিকে সামঞ্জস্যবিধানের জন্য তুলনামূলকভাবে কম শিল্পোন্নত দুটি রাজ্য, উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা উপস্থাপিত করা হল (সারণি ১)
এবারে সতট্য স্পষ্ট। পশ্চিমবঙ্গের জিএসটির অবদান যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রীয় করের ভাগ পাচ্ছে সবচেয়ে কম। মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের জিএসটির অবদান ২.৬৯ শতাংশ (পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ৪০ শতাংশের বেশি কম হওয়া সত্ত্বেও) কেন্দ্রীয় করের হস্তান্তর ঘটেছেো ৭.৮৫% (পশ্চিমবঙ্গের চেয়েও প্রায় ৪.৫ শতাংশ বেশি)। অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশে জিএসটির অবদান ৬.৬৭% (পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় জিএসটির অবদান মাত্র ৫১ শতংশ বেশি) হওয়া সত্ত্বেও এই রাজ্যে করের হস্তান্তরের অবদান ১৭.৯৪% (পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় ২৩৯ শতাংশ বেশি)। অর্থাৎ, উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে পশ্চিমঙ্গের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি জনসংখ্যা থাকা সত্ত্বেও এই রাজ্যে জিএসটির অবদান পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় মাত্র ৫১ শতাংশ বেশি অথচ পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে কেন্দ্রীয় করের অর্থ পাচ্ছে প্রায় আড়াইশো শতাংশ। তাই উপস্থাপকদের কাছ থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ তুলনা অবশ্যই আকাঙ্ক্ষিত। সমালোচকদের পরবর্তী বিষয়টিতে এবার আসা যাক, ‘রাজ্যের (পশ্চিমবঙ্গ) নিজস্ব বাজেট তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ আর্থিক বছর থেকে ২০২২-২৩ পর্যন্ত রাজ্যের নিজস্ব আয়ের তুলনায় কেন্দ্রীয় তহবিলের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরে যা ছিল ১২৭%। তাই ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে পৌঁছেছে ১৩৯%-এ।’ এই তথ্যের ক্ষেত্রে কতগুলি সীমাবদ্ধতা লক্ষণীয় : (ক) অন্য কোনও রাজ্যের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের তুলনা করা হয়নি এবং এক্ষেত্রে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ সরকারের (West Bengal Government) বাজেটের তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে। (খ) ২০২২-২৩ অর্থ বছরের তথ্য রাজ্যের সংশোধিত (revised) হিসাবের তথ্য, প্রকৃত (actual) হিসাবের তথ্য নয়। (গ) রাজ্যের মোট রাজস্বের ৪টি অংশ : রাজ্যের নিজস্ব কর রাজস্ব, কেন্দ্রীয় কর ও শুল্কে রাজ্যের অংশ, রাজ্যের নিজস্ব কর নিরপেক্ষ রাজস্ব এবং কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অনুদান। উপস্থাপক ‘কেন্দ্রীয় কর ও শুল্কে রাজ্যের অংশ’-কেও কেন্দ্রীয় তহবিল হিসাবে ধরেছেন, যদিও এটা যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ, এটি হল রাজ্যগুলি থেকে সংগৃহীত প্রত্যক্ষ করের (যেমন আয় কর, কর্পোরেশন কর, সম্পদ কর ইত্যাদি) অংশ ছাড়াও পরোক্ষ করের (কেন্দ্রীয় জিএসটি, বাণিজ্য শুল্ক, কেন্দ্রীয় আন্তঃশুল্ক, সেবাকর ইত্যাদি) অংশ, যে কেন্দ্র আর্থিক কমিশনের নির্দেশমতো রাজ্যগুলিকে দিতে বাধ্য থাকে। তবে এটা অনস্বীকার্য যে কেন্দ্রীয় তহবিল হল, কার্যত, মাছের তেলে মাছ ভাজা (কেন্দ্র কর্তৃক রাজ্যের থেকে সংগৃহীত কর ও শুল্কের অংশ রাজ্য ফেরত পায়।) বর্তমান প্রবন্ধে প্রাসঙ্গিক বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের তুলনায় করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য (জানুয়ারি ১৬, ২০২৩, State Finance : A study of Budgets) তুলে ধরা হয়েছে। তবে এই তথ্যের সীমাবদ্ধতা হল ২০২০-২১ সালের পরে রাজ্যভিত্তিক বাজেটের প্রকৃত (Actual) হিসাবের তথ্য প্রকাশিত হয়নি। তাই তিনটি রাজ্যের মধ্যে তুলনা করা হয়েছে অতীতের (২০১৫-২০২১) সময়কালের ভিত্তিতে (সারণি ২)।
সারণিতে স্পষ্ট, ২০১৫-২০ সময়কালের তুলনায় ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্রের দেয় রাজস্বের (রাজ্যের প্রাপ্য কেন্দ্রীয় করের অংশ-সহ কেন্দ্রীয় অনুদান) অনুপাত রাজ্য কর্তৃক আদায়কৃত অনুপাতের তুলনায় বেশ কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এটি শুধু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ঘটেনি। উত্তরপ্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। অথচ এর উল্টোটাই তুলে ধরা হয়েছিল সমালোচকের প্রাসঙ্গিক নিবন্ধটিতে (কেন্দ্রীয় তহবিলের অনুপাত বেড়েছে রাজ্যের নিজস্ব আয়ের তুলনায়)। অথচ অন্য রাজ্যগুলির তুলনা সেখানে করা হয়নি। এমনভাবে প্রসঙ্গিক বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল যে, রাজ্যের নিজস্ব আয়ের ক্ষেত্রগুলির সম্মিলিত অঙ্কের তুলনায় কেন্দ্রের থেকে আসা অর্থের পরিমাণ একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই বেশি। কিন্তু বাস্তবে ভারতের অধিকাংশ রাজ্যের ক্ষেত্রে এটাই বাস্তব। প্রবন্ধের সমালোচক বেমালুম বিষয়টি চেপে গেছেন বা উল্লেখ করেননি।
আর অনুদানের বাড়তি খরচ নিয়ে সমালোচনা শুধু পশ্চিমবঙ্গকে (West Bengal Government) কেন, সারা ভারতের অনেক রাজ্য এমনকী কেন্দ্রর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা ঘটছে। তার সমালোচনা কোথায়? তবে পশ্চিমবঙ্গে ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ সালে রাজ্যের নিজস্ব রাজস্ব যথাক্রমে ১১% (৭২৮৬ কোটি টাকা) এবং ১২% (৮৬১০ কোটি টাকা) বেড়েছে যা রাজ্যের রাজস্ব কাঠামোর ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রশংসার যোগ্য। তাই সমষ্টিগত অর্থনীতির সমালোচনায় বর্তমানে, কার্যত, রাজনীতিই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।