পরিচালনায় প্রায় দু-দশক কাটিয়েও কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় সবার আগে নিজেকে ‘শখের গল্পকার’ বলতে ভালবাসেন! স্পষ্টই বলেন, ‘সিনেমাওয়ালার মুখোশ পরে প্রায় ২৯টা ছবি বানানো হয়ে গেল…চিমটি কেটে দেখার মতো, সত্যি কিনা!’ সত্যি এবং ভীষণ সত্যি! গল্পকার, অভিনেতা, পরিচালক— তিন সত্তা সম্মিলিত হয়েই তিনি সিনেমাওয়ালা। এমন এক সিনেমাওয়ালা, টেলিফিল্মের দুনিয়া থেকে টলিউডে এসেও স্বমহিমায় বিরাজমান, স্বকীয়তায় ভাস্বর এবং আস্তিনে যাঁর ব্যতিক্রমী কাহিনির সমাহার। ‘অর্ধাঙ্গিনী’ (Ardhangini) আর-এক মনকাড়া ব্যতিক্রম। ভীষণ চেনা, ছোঁয়া যায় এমন দূরত্বের সব চরিত্র, মাপা যায় এমন সব সংকট, ভাবিয়ে ছাড়ে এমন সব প্রশ্ন— কিন্তু অনন্য তার বুনোট। তবে কৌশিক এর পুরো ক্রেডিট নিজে নিতে চাননি, জানিয়েছেন দুই তুখোড় প্রতিভাধর অভিনেত্রী তাঁর কাজ ভীষণই সহজ করে দিয়েছেন, দর্শকও সে-কথায় সহমত। চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায় ও জয়া এহসান দুই বাংলার দুই অভিনেত্রীর অভিনয় বুঝতে দেয়নি তাঁরা আদৌ অভিনয় করেছেন কিনা! চরিত্র অনুযায়ী শুধু বিহেভ করে গেছেন। সঙ্গে যাঁর কথা না বললেই নয়, তিনি, অম্বরীশ ভট্টাচার্য। দুই অভিনেত্রীর সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করে গেছেন পুরো ছবি জুড়ে।
আদ্যন্ত একটি পারিবারিক গল্প, কৌশিকের মুনশিয়ানায় যা সার্বিক হয়ে উঠেছে। ভবানীপুরের বনেদি চট্টোপাধ্যায় বাড়ির মেজো ছেলে সুমনের (কৌশিক সেন) ব্যক্তিগত কাহিনি। শুভ্রা চট্টোপাধ্যায় (চূর্ণী) তার প্রথম স্ত্রী যাকে কোনওদিন প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা সুমন দেয়নি শুধু নয়, মানসিক ও শারীরিক পীড়ন চালিয়ে গেছে প্রতিনিয়ত। শুভ্রা নিঃসন্তান। আর এই সন্তানহীনতার দায় শুভ্রার ওপরেই চাপিয়ে দিয়ে সুমন লাগাতার তাকে কোণঠাসাও করেছে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে। শুভ্রা জানে এ-দায় তার নয় কিন্তু বিশ্বাস করানো কিংবা মানা কোনও তরফেই পায়নি। যদিও স্বামীর পরিবারটির অন্য সদস্যদের সঙ্গে তার সখ্য যথেষ্টই ছিল। শুভ্রার প্রতি সহমর্মীও তারা ছিল কিন্তু যতখানি সংবেদনশীলতা থাকলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায়, তার ঘাটতি থেকেই গিয়েছিল। শুভ্রা তাই দীর্ঘ বছর যাবৎ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও হাল ছেড়েছিল এবং ছেড়েছিল সংসার, ভেঙে ছিল বিয়ে।
সুমনের জীবনের প্রথম অর্ধ যদি এরকমটা হয় তবে দ্বিতীয় অর্ধ ছিল অন্য নারী-সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের উঠতি গায়িকা মেঘনা মুস্তাফিকে (জয়া) বিয়ে করে সুমন এরপর নতুন সংসার শুরু করে। কিন্তু নতুন এই চাকা গড়াতে না গড়াতেই অ্যাক্সিডেন্ট। এক মারাত্মক সেরিব্রাল অ্যাটাকে সুমন কোমায় চলে যায়। তখনও না মানুষটাকে না তার অতীত ও পারিপার্শ্বিককে ভাল চিনেছে মেঘনা। ফলত সে আতান্তরে আর এই আতান্তর থেকে তাকে একমাত্র উদ্ধার করতে পারে সুমনের প্রাক্তন শুভ্রাই! বর্তমান মুখোমুখি হয় অতীতের। সাহায্য চায়। প্রতিশোধের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত সুযোগ পেয়েও ঠিক কী কী করল শুভ্রা, কী করতে পারল না, আসলে চেয়েও কেন পারল না, কেন করল, গল্পের বিস্তারে এগুলিই বাস্তবিক ও মানবিক সুতোর বুনোটে নিপুণভাবে নকশা কেটেছে ছবির গালিচায়।
আরও পড়ুন- প্রয়াত লবনহ্রদ সংবাদের সম্পাদক সুধীর দে
দুই নারীর আত্মিক যুদ্ধকে অভিনয়ের মুনশিয়ানায় পাল্লা দিয়ে পর্দায় মেলে ধরেছেন চূর্ণী ও জয়া। অবশ্যই গল্পের কারণেই চূর্ণীর চরিত্রটি অধিক জোরালো। পাল্লা তাঁর দিকেই ঝুঁকে। অভিনয়ের দাপটে তা আরও জোরালো হয়ে ফুটেছে। জয়ার চরিত্রটি তুলনায় নরম, পরিস্থিতি তাকে সহনশীলতার আবরণ ধারণে বাধ্য করেছে। কিন্তু অসহায়তা কিংবা উপায়হীনতা দ্বিতীয়াকে প্রথমার দ্বারস্থ করলেও স্বাধিকারে কিংবা মর্যাদায় ঘা লাগলে সেও জ্বলে ওঠে। দুই অর্ধাঙ্গিনী (Ardhangini) কখনও প্রতিপক্ষ, কখনও সমব্যথী, কখনও সহযোগী। অতীত স্মরণ করে যখন শুভ্রা তিক্ততার হুল ফোটাচ্ছে সামনে, আড়ালে সে-ই আবার মেঘনার বিপন্নতায় বিষণ্ণ ছটফটানিতে অস্থির হচ্ছে। এই টানাপোড়েনকে যে দক্ষতায় চূর্ণী ফুটিয়ে তুলেছেন তাতে অভিনেতা হিসেবে তাঁকে কুর্নিশ। সেই শুরুর দিনগুলো থেকেই কৌশিকের কাজের সঙ্গে চূর্ণী নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। কিন্তু ‘অর্ধাঙ্গিনী’ (Ardhangini) তর্কাতীতভাবে সেরার শিরোপা পাবে। পিছিয়ে নেই পরিচালকের সবচেয়ে পছন্দের বাংলাদেশি অভিনেত্রী জয়াও। এই নিয়ে কৌশিকের পরিচালনায় তিনটি ছবিতে অভিনয় করলেন জয়া। এবং আগামীতেও কোনও বাংলাদেশি নারীচরিত্র বুনতে পারলে জয়াকেই কাস্ট করবেন, কৌশিকের আগাম ঘোষণা! সংলাপের কারণে দুই অভিনেত্রীর সবাক মুহূর্তগুলো যতটা আকর্ষণীয়, নির্বাক মুহূর্তগুলোও ততটাই সংবেদনশীল, হৃদয়-ছোঁয়া।
আরও কিছু চরিত্র আছে, দৈর্ঘ দিয়ে যাদের মাপতে গেলে ভুল হবে। এই কাস্টিং বিষয়টাও যে কাহিনির ক্ষেত্রে কতটা জরুরি, কৌশিক তা একাধিবার প্রমাণ করেছেন। আছেন বর্ষীয়ান লিলি চক্রবর্তী, দামিনী বেণী বসু। কৌশিক সেনের চরিত্রটিকে কেন্দ্র করেই কাহিনি গড়ে উঠেছে। টক্সিক হাজব্যান্ডের চরিত্রে যথাযথ অভিনয় করেছেন কৌশিক। গোপী ভগতের ক্যামেরা, অনুপম রায়ের সুর, রবীন্দ্রসংগীতের সুন্দর ব্যবহার ‘অর্ধাঙ্গিনী’কে আরও মনোগ্রাহী করে তুলেছে। কৌশিক ও সুরিন্দর ফিল্মস-এর জুটিতে সাফল্যের নতুন পালক এই ছবি।