অগ্নিবীর (Agniveer) নিয়ে কথার চাপান-উতোর চলছে; চলারই কথা। যাঁরা এক বছর সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে মূলত কাশ্মীর, দ্রাস, কার্গিল এবং সিকিমের মতো উঁচু পাহাড়ি এলাকায় নানান প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়ে দেশের মাটি পাহারা দেবেন, সেই অগ্নিবীরদের (Agniveer) চার বছর কাজের পর বাধ্যতামূলক অবসর নিতে হবে। এমনই প্রকল্প নিয়েছে নরেন্দ্র মোদির সরকার।
দেশের প্রথম চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত প্রস্তাব করেছিলেন জওয়ানদের অবসরের বয়স ৫৮ করবার। তারই সম্পূর্ণ বিপরীতে এল এই অগ্নিপথ রাস্তা। সমস্ত চাকরি চুক্তিভিত্তিক করতে উদ্যোগী কেন্দ্রীয় সরকার জওয়ানদের পদগুলিকেও সাময়িক করে দিতে চাইছে। চার বছর পূর্ণ উদ্যমে কাজ করবার পর অবসর নিতে হবে তাঁদের। এরপরে কী? কেন বিজেপি তো বলে দিয়েছে, তাদের দফতরে দারোয়ান হিসাবে নিয়োগ করা হবে এইসব অবসরপ্রাপ্ত অগ্নিবীরদের (Agniveer)! তাদের সঙ্গে পোঁ ধরে কোনও কোনও শিল্পপতি ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, তাঁরাও নাকি দেশের জন্য এইসব জীবন-বিপন্ন-করা অগ্নিবীরদের ঠাঁই দেবেন তাঁদের কলকারখানা-অফিসে, নিশ্চয়ই পাহারাদার পদে। যাঁদের কাজ করবার কথা ছিল ৫৮ বছর বয়স অবধি, তাঁদের মধ্যযৌবনেই থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোথায় দ্রাস-কার্গিলের দেশরক্ষা আর কোথায় মুম্বইয়ের কোনও শিল্পপতির গেট-পাহারা! এ-যেন রক্তচাটা এক পূর্ণ যৌবনের বাঘকে বলা, ভাই তুমি আজ থেকে ঘাস খাও। মুশকিল হল, দেশের মানুষের মনের সবটা বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদির নিয়ন্ত্রণে নয়। আর ওরা যতই চেষ্টা করুক ইতিহাসকে দখলে রাখবার, তা যে সম্ভব নয়, পাড়ার হাবলাদাও বোঝে।
ফলে, এই অগ্নিপথ প্রকল্পের প্রতিক্রিয়া আসতে বাধ্য। আসছেও। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন যে, এর মাধ্যমে গুন্ডার দল তৈরি করছে বিজেপি। সেই গুন্ডার দলের নিয়ন্ত্রণ, বিজেপি ভাবছে, তাদের হাতে রাখবে। কিন্তু ব্যাপারটা অত সহজ হবে না; সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ তো নয়ই।
আরও পড়ুন: বন্যায় ভাসছে অসম, মুখ্যমন্ত্রী ব্যস্ত ঘোড়া কেনাবেচায়, বিস্ফোরক অভিযোগ তৃণমূলের
বছর-বছর দেশ পাবে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এমন এক বাহিনী, যাদের কাজের শুরুতেই, পূর্ণ যৌবনে বাধ্যতামূলক ভাবে অবসর নিতে হয়েছে। এবং তাদের পেনসন নেই। সংসার প্রতিপালন করতে তারা তখন কী করবে? কে চাকরি দেবে তাদের? নাকি ওই বয়সে পৌঁছে, সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে তারা স্বনিযুক্তির পথে হাঁটবে?
বিজেপি সুখস্বপ্ন দেখছে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অগ্নিবীরদের (Agniveer) দারোয়ান হিসাবে নিয়োগ করবার, তবে সেই খোয়াব ভাঙবে। কী গ্যারান্টি আছে যে, অবসরপ্রাপ্ত অগ্নিবীররা বিজেপি বা তার পেটোয়া শিল্পপতিদের দারোয়ান হবে? বেকার হওয়া অগ্নিবীরদের খুব সামান্য অংশকেই কাজে বহাল করা হবে, এমন কথা সরকারিভাবে জানানো হয়েছে (যদিও সবাই জানে সরকারের কাজে আর কথায় কোনও মিল নেই; মনে পড়ছে প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা জমা পড়বার কথা?)। একটি বাহিনী সমরক্ষেত্রে নামছে এটা জেনেই, তাদের অধিকাংশই অবসরের পর নিয়োগপত্র পাবে না, কেউ কেউ পাবে। সেই সম্ভাব্য ক্ষুদ্র অংশটি চিহ্নিত করে তাদের হেনস্থা করবার তীব্র ইচ্ছা অধিকাংশের মনে জাগবে না তো? এমনও তো হতে পারে, যারা চাকরি পেল না—
১. তাদের কেউ কেউ একত্রে মাওবাদী-সহ বিভিন্ন বিপ্লবপন্থী, বর্তমান রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠনকে গোপনে, অর্থের বিনিময়ে, সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করল?
২. কোনও আন্তর্জাতিক মাফিয়া বা গোষ্ঠীর প্রকাশ্য অথবা গোপন সামরিক বাহিনী হিসাবে কাজ শুরু করল?
৩. অতীতে আমাদের দেখা রণবীর সেনা, সালওয়া জুডুমের মতো (দ্বিতীয়টি নিষিদ্ধ করতে সুপ্রিম কোর্টকে রায় দিতে হয়েছিল) এই অগ্নিপথে এমন কোনও অগ্নিসেনা জন্ম নেবে, যারা আইনের ঊর্ধ্বে উঠে গ্রামে গ্রামে শান্তি-সম্প্রীতি নষ্ট করবে?
৪. দেশে কখনও গৃহযুদ্ধ শুরু হলে, এরাও নিশ্চয়ই নিশ্চিন্তে বিজেপির দারোয়ানগিরি করবে না, তারাও কোনও এক পক্ষ নেবে?
৫. এদের একটি অংশ কোনও রাজনৈতিক দলের বাহিনী হিসাবে কাজ শুরু করল এবং বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করবার কাজে বহাল হল; ফলত, বহু গৌরী লঙ্কেশ, সুজাত বুখারি হত্যার ঘটনা চলতে থাকবে?
যাঁরা ভাবছেন, অস্ত্র প্রশিক্ষণ পাওয়া জনগোষ্ঠী কেন, কী করে তাদের শিক্ষকের বিরুদ্ধে যাবে? এবং যারা অস্ত্র সাহায্য করেছে তাদের বিরুদ্ধেই বা যাবার কী যুক্তি? তাঁদের জন্য দৃষ্টান্ত তো সামনেই আছে।
সেই সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময়, মার্কিনিরা তো অস্ত্রশস্ত্র পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে, পূর্ণমাত্রায় সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিল আফগান যোদ্ধাদের। তারপর কী হল? মুজাহিদিনদের লড়াই চলতে চলতে জন্ম হল আল কায়দার, ওসামা বিন লাদেনের; খেলা ঘুরে গেল। লাদেনের অভিঘাতে থরহরি কেঁপে উঠেছিল তাদের সামরিক শিক্ষার গুরুঠাকুর, অস্ত্র সাহায্যের গৌরী সেন, আমেরিকা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে সাধারণ মানুষ তথা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে থাকা অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করতে সরকারকে বিশেষ যত্নবান হতে হয়েছিল, এ কথাও ওই দেশের গতিপথ যাঁরা লক্ষ করে থাকেন, তাঁরা জানেন।
অর্থাৎ দানব তৈরি করলে তাকে সামলাতেও জানতে হবে। আট ফুট উচ্চতার দানব যিনি বানিয়েছিলেন, সেই ভিক্টর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন স্বয়ং খতম হন দৈত্যটির হাতে; তিনি সামলাতে পারেননি। সেই থেকেই ওই আপ্তবাক্যের জন্ম— লেট্স নট ক্রিয়েট আ ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। তবু সেই দৈত্য-সৃষ্টির পথেই হাঁটছে মোদিবাবুর দল বিজেপি। জন্ম-দেওয়া ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে সামলানো হবে কী করে? সে প্রশ্নের কোনও উত্তর এখনও দেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার। আর দেবেন বলে মনেও হচ্ছে না। অতএব, অগ্নিপথের অন্তিমে বেশ অন্ধকার। আমরা সম্ভবত আর একটি বীভৎস রগড় দেখার অপেক্ষায়।