কৃত্রিম মানবভ্রূণ

কোনওরকম শুক্রাণু অথবা ডিম্বাণুর সহায়তা ছাড়াই শুধুমাত্র স্টেমকোষ ব্যবহার করে কৃত্রিম ভ্রূণ তৈরি করলেন বিজ্ঞানীরা। এ এক যুগান্তকারী আবিষ্কার। তাঁদের আশা, এই পথ অনুসরণ করেই পাওয়া যেতে পারে জটিল থেকে জটিলতম সমস্যার সহজ উত্তর। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

শুক্রাণু বা ডিম্বাণুর প্রয়োজনকে স্রেফ পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র স্টেম কোষ ব্যবহার করে মানবভ্রূণ তৈরি করা যুগান্তকারী আবিষ্কার এর থেকে কিছু কম না। আর এই অসম্ভবকেই সম্ভব করে তুলেছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও ক্যালটেকের বিজ্ঞানীরা। গবেষণাগারে তৈরি এই ভ্রূণ আধুনিক ভ্রূণের মতো উন্নত না হলেও বিজ্ঞানীদের আশা, এই পথ অনুসরণ করেই পাওয়া যেতে পারে জটিল থেকে জটিলতম সমস্যার সহজ উত্তর। জিনগত অসুখ, সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে গর্ভপাত— এ-ধরনের সব সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধান খুঁজতে সাহায্য করবে এই কৃত্রিম ভ্রূণ। তবে এই আবিষ্কারের পেছনে উঠছে প্রচুর নৈতিকতার প্রশ্ন, অনেক বাধানিষেধ, তাও বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, এর পরীক্ষণের দ্বারা আগামী দিনে জিনগতভাবে ত্রুটিমুক্ত সন্তানের জন্ম দিতে।

আরও পড়ুন-গণতন্ত্রের হত্যা, তীব্র ভর্ৎসনা সুপ্রিম কোর্টের, চণ্ডীগড় মেয়র নির্বাচন

কোথায় ও কীভাবে আবিষ্কার
আগেই বলেছি স্টেম কোষের কথা, এটি এমন একটি কোষ যেটি থেকে প্রায় সমস্ত ধরনের কোষ তৈরি করা যেতে পারে বা বলা ভাল গোটা একটা মানুষ তৈরি করা যেতে পারে, আর এই সুযোগকেই কাজে লাগিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে এই মডেল ভ্রূণগুলি মানব বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়গুলির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ, মানব বিবর্তনের গোড়ার সময়ের সঙ্গে এর মিল রয়েছে। ভ্রূণ সৃষ্টি তথা বিকাশের সমস্ত পর্যায়গুলিই ঘটে মাতৃগর্ভে, তাই বিকাশের কোন পর্যায়ে কী সমস্যা রয়েছে সেটি খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে, তাই যদি কোনও কারণে জিনগত কোনও অসুখের শিকার হয় তা তাকে সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়, সেটি থেকে সে মুক্তি পেতে পারে না, এমনকী এর কোনও সঠিক কারণও কারও জানা থাকে না। বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায় যে কোনও সুস্থ দম্পতির কোনও বিকলাঙ্গ শিশু জন্মেছে। আর এর সংখ্যা কিন্তু দিনে দিনে বাড়ছে যার কারণ অজানা। কারণ ভ্রূণ নিয়ে গবেষণা করা অনৈতিক এবং তাতে বিভিন্ন আইনি জটিলতাও রয়েছে। এটি তখনই সম্ভব যদি কোনও মৃত ভ্রূণ পাওয়া যায়, কিন্তু তাতে গবেষণা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। এর একমাত্র সহজ সমাধান হল যদি কোনও জীবিত ভ্রূণ পাওয়া যায়, আর সেটি পেতেই এইরূপ চেষ্টা। এখানে একটি কথা জানিয়ে রাখা ভাল যে, গবেষণাগারে উৎপন্ন এই কৃত্রিম ভ্রূণে কোনও স্পন্দিত হৃৎপিণ্ড বা মস্তিষ্কের সূচনা থাকে না, তবে কোষগুলি থেকে একটু একটু করে সাধারণত প্লাসেন্টা, কুসুমথলি এবং ভ্রূণ গঠিত হয়। আর এখানেই বিজ্ঞানীরা আশার আলো দেখতে পান আসলে, বৃদ্ধি-বিকাশ অব্যাহত থাকায় গবেষকরা আশা করেন, দেরিতে হলেও ভ্রূণটিতে হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কের গঠন শুরু হবে।

আরও পড়ুন-পাঁচ বছরে ১২ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে ৩ লক্ষ কোটির জালিয়াতি, অভিষেকের প্রশ্নে স্বীকার কেন্দ্রের

কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির অধ্যাপক ম্যাগডালেনা জারনিকা-গোয়েটজ বোস্টনে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর স্টেম সেল রিসার্চের বার্ষিক সভায় একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষণে এই কাজটি তুলে ধরে বলেন— আমরা স্টেম কোষের পুনঃপ্রোগ্রামিং করে মানবভ্রূণের মতো মডেল তৈরি করতে পেরেছি। যদিও এই সিন্থেটিক ভ্রূণগুলি ক্লিনিকালভাবে ব্যবহার করার কোনও নিকট-মেয়াদি সম্ভাবনা নেই। এগুলিকে গর্ভে রোপণ করাও বেআইনি হবে এবং এটি এখনও স্পষ্ট নয় যে এই ভ্রূণগুলি বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ের সব ক’টি ধাপ পার করলেও তা যথাযথভাবে পরিণতি পাবে কি না।
আগেই বলেছি যে ভ্রূণ নিয়ে গবেষণায় রয়েছে প্রচুর বিপত্তি, বিজ্ঞানীদের শুধুমাত্র ১৪ দিনের আইনি সীমা পর্যন্ত ল্যাবে ভ্রূণ চাষ করার অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর ভ্রূণের বিকাশ সম্পর্কে জানতে হলে গর্ভাবস্থার স্ক্যান রিপোর্ট কিংবা কারও দান করা ভ্রূণ পরীক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। তাই এইসব বাধানিষেধের কারণেই এখনও মানব জীবনের এই অধ্যায় এক প্রকার ‘ব্ল্যাক বক্স’ হয়ে রয়ে গিয়েছে। আর এই অন্ধকারে আলো ফেলতেই বিজ্ঞানীদের এত প্রচেষ্টা।

আরও পড়ুন-প্যান-আধার লিঙ্ক, ৭ মাসে জরিমানা বাবদ কেন্দ্র পেল ৬০১.৯৭ কোটি

লন্ডনের ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটের স্টেম সেল বায়োলজি এবং ডেভেলপমেন্টাল জেনেটিক্সের প্রধান রবিন লাভেল-ব্যাজ বলেন : স্টেম সেল ব্যবহার করে স্বাভাবিক মানবভ্রূণের বিকাশের মডেল তৈরি করার দ্বারা, অনেক তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এমনকী এই পদ্ধতিতে আমরা জীবনের প্রথম ধাপ সম্পর্কে চমকে যাওয়ার মতো বহু অজানা তথ্য জানতে পারি।
পূর্বে, ২০২২ সালে ইজরায়েলের ওয়েইজম্যান ইনস্টিটিউটের জারনিকা-গোয়েটজের দল এবং একটি প্রতিনিধি দল যৌথভাবে গবেষণা করে দেখিয়েছিল যে ইঁদুর থেকে স্টেম সেলগুলিকে অন্ত্র, মস্তিষ্ক এবং একটি স্পন্দিত হৃৎপিণ্ড-সহ প্রাথমিক ভ্রূণের মতো কাঠামোতে পরিণত হতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। এরপর থেকে, এই কাজটিকে মানব মডেলে অনুবাদ করার জন্য একটি দৌড় চলছে, এবং বেশ কয়েকটি দল মানবভ্রূণ বিকাশের প্রথম দিকের ধাপগুলিকে নকল করতে সক্ষমও হয়েছে৷ মডেল স্ট্রাকচারটির, প্রতিটি একটি একক ভ্রূণীয় স্টেম সেল থেকে উত্থিত এবং গ্যাস্ট্রুলেশন নামক বিকাশের একটি মাইলফলক পার করতে সক্ষম। এমনকী ভ্রূণ কোষের একটি অবিচ্ছিন্ন শিট থেকে স্বতন্ত্র কোষ রেখা গঠনে এবং শরীরের মৌলিক অক্ষ স্থাপনেও এরা সক্ষম তবে এই পর্যায়ে এসেও, ভ্রূণের স্পন্দিত হৃৎপিণ্ড, অন্ত্র বা মস্তিষ্কের সূচনা হয় না, যদিও মডেলটিতে থাকা আদি কোষের উপস্থিতি এটি প্রমাণ করে যে এগুলি ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুর পূর্বসূরি কোষ।

আরও পড়ুন-হাসপাতালে বসেই পরীক্ষা

কী কী বাধা রয়েছে
এই কাঠামোগুলি একটি জীবন্ত প্রাণীতে বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে কিনা তার উত্তর কিন্তু এখনও অজানা। ইঁদু্রের স্টেম কোষ থেকে জন্মানো কৃত্রিম ভ্রূণগুলি প্রাকৃতিক ভ্রূণের সাথে প্রায় অভিন্ন বলে জানা গেছে। কিন্তু যখন তা স্ত্রী ইঁদুরের গর্ভে রোপণ করা হয়, তখন তারা জীবিত প্রাণীতে বিকশিত হয়নি। আবার, চিনের গবেষকরা বানরের কোষ থেকে কৃত্রিম ভ্রূণ তৈরি করেন এবং প্রাপ্তবয়স্ক বানরের গর্ভে সেটি রোপণ করেন, যার মধ্যে কয়েকটিতে গর্ভাবস্থার প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিলেও তার সম্পূর্ণ বিকাশ ঘটেনি। যদিও বিজ্ঞানীদের কাছে এটি এখনও স্পষ্ট নয় যে এই বিকাশে বাধা নিছক প্রযুক্তিগত নাকি এর পেছনে আরও মৌলিক বা জৈবিক কারণও রয়েছে।
ভবিষ্যৎ আশঙ্কা
বিজ্ঞানের অগ্রগতি যেমন মানুষের জীবনকে সহজ করে তোলে তেমনই জন্ম দেয় আশঙ্কার। যেমন এই আবিষ্কারের সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হল, ‘ডিজাইনার বেবি’ উৎপাদন। যাদের ক্ষমতা আছে, তারা অর্থ ব্যয় করে ‘সর্বগুণযুক্ত, নীরোগ, শক্তিশালী’ সন্তানের বাবা-মা হবে। আর সেসব সন্তানই ভবিষ্যৎ বিশ্বে চালকের আসনে বসবে এবং তাদের কাছেই ক্রমাগত পর্যুদস্ত হতে থাকবে স্বাভাবিক প্রজননে জন্ম নেওয়া শিশু এবং পরবর্তীকালের নাগরিক। তাই বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে নয়, রাশ টানতে হবে তার ব্যবহারকারীর ওপর।

Latest article