বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়
সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মতো মানুষ গণতন্ত্রে বিরল। সুব্রত মুখোপাধ্যায় বিধানসভায় খুবই সিরিয়াস থাকতেন। তাঁর মতামত অনেক সময়ই নিয়েছি। তিনি যে দফতরের মন্ত্রী সে-বিষয়ে অনেক বলার ছিল, কিন্তু সময় কম দিয়েছিলাম বলে রেগে গিয়েছিলেন। সুব্রতদা মোবাইল ফোন বন্ধ করতে জানতেন না। কখনও একে ওকে ডেকে মোবাইল বন্ধ করতে বলতেন। মাঝেমধ্যেই এমন সব মন্তব্য করতেন না হেসে পারতাম না৷ বিধানসভায় অনেকেই বেশি বলে ফেলেন। তিনি কখনও এটা করতেন না। বিধানসভায় অনেক কিছু তাঁর কাছ থেকে শেখার ছিল।
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
সুব্রতদাকে নিয়ে আজ আমাকে কিছু বলতে হবে আর তাঁর সিট ফাঁকা থাকবে, ভাবা যায় না। কোনওদিন ভাবিনি রাজনীতি করব। নাকতলায় পাড়ায় আড্ডা দিচ্ছি। শোভনদেবদা টাক্সি থেকে নেমে এসে বলল ছাত্র পরিষদ করবি। সেই আমার পথচলা শুরু। একডালিয়ায় জীবনদার রেশন দোকানের উপরে থাকেন তখন৷ আমার দুটো জিনিস চোখের সামনে ভাসে, প্রিয়দা-সুব্রতদা দু’জনে বসুশ্রী সিনেমায় আসতেন আড্ডা দিতে মন্টুদার ওখানে। বসন্ত কেবিন থেকে খাবার আসত। আন্দোলন করতে গিয়ে মারও খেয়েছি। কল্যাণী সীমান্ত স্টেশনে গিয়েছিলাম। সেখানেও গন্ডগোল। আক্রান্ত হয়েছিল মানসের বাড়ি। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সুব্রতদা আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রিয়দা-সুব্রতদা কখন যে কী করবেন কেউ জানত না। কত কথা মনে পড়ছে। জীবনের প্রতি পদক্ষেপে ছাত্র আন্দোলনে সুব্রতদার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম। যা বলতেন তাই শুনতাম। অনেক কথা হয়ত সুব্রতদাকে বলতে পারিনি। বৌদিকে বলেছি। এমন বৌদি পাওয়া দুষ্কর। ঘাটাল যাওয়ার কথা ছিল। সুব্রতদা শুধু রাজনীতির গুরু ছিলেন না। বাড়ির বড়দা ছিলেন। মা মারা গেল। বাড়িতে এলেন। কতক্ষণ বসে থাকলেন। কথা বললেন। তখনও কি জানতাম চার মাসের মধ্যে তুমিও চলে যাবে! আমার মার সঙ্গে বৌদির খুব ভাব ছিল। সুব্রতদা সেই সময় স্বরাষ্ট্র দফতরের দায়িত্ব পাওয়ার পর বহু বন্দি নকশালের জেলমুক্তি ঘটিয়েছেন। আমায় বলতেন, মমতা গরিবের মেয়ে, ওকে উঠতে দে। সংগ্রামী নেতা না থাকলে সংগ্রামী নেত্রী তৈরি হয় না। সংগ্রাম তৈরি হয় না। আন্দোলন তৈরি হয় না। বৌদি ভাল থাকো।
শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়
৬০-এর দশকে ছাত্র পরিষদ কংগ্রেসের মুখ হয়ে দঁড়িয়েছিল। প্রিয়-সুব্রত করার একটা নেশা ছিল। মহাজাতি সদন তীর্থক্ষেত্র ছিল। বহু লড়াই একসঙ্গে করেছি। বালিগঞ্জের রেললাইনের ওপারে যাওয়ার উপায় ছিল না। আমরা যেতাম সুব্রতর হয়ে। সেই সময় বলা হত কংগ্রেসকে প্রিয়-সুব্রত ক্ষমতায় এনেছে। মনোমালিন্যও হয়েছে কতবার। মোহনবাগানঅন্ত প্রাণ ছিলেন। আমি ৩ মিনিট, সুব্রত ১০ মিনিট, বক্তৃতা করে দার্জিলিং চলে গেলাম খেলা দেখতে। আজ খারাপ লাগছে। যে কোনও বিষয়ে টানা বলতে পারত। মজা করত। এই বিধানসভায় কত ঘটনা মনে পড়ছে। রাত একটায় ফোন করে বলেছিল, শোভন ঘুমোচ্ছিস? আমি বললাম না ফুটবল খেলছি! বলল, একটা গল্প বলব বলে ফোন করেছি। ছন্দবাণী আমার প্রিয়। ভগবান ওকে শক্তি দিন।
ফিরহাদ হাকিম
আজ এমন একজনকে নিয়ে আলোচনা করছি যাকে খুব ছোট থেকে দেখেছি। সুব্রত দা-কে দেখতে বিধানসভায় আসতাম। সুব্রতদাকে দেখে হিরো মনে হত। উত্তমকুমারকে দেখিনি, কিন্তু সুব্রতদাকে দেখে আমার উত্তমকুমার মনে হত। মিনি বাসে করে যেতাম তাঁকে দেখতে। যখন আমি, অরূপ কাউন্সিলর হলাম তখন সুব্রতদা মেয়র। কিন্তু কোনওদিন বুঝতে দেননি তিনি কত বড় মাপের মানুষ। সুব্রতদা নেই ভাবতে পারছি না। বিধানসভায় সব জায়গায় সুব্রতদা রয়েছেন। যতদিন বাঁচব এই স্মৃতি নিয়েই বাঁচব।
আরও পড়ুন : সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মূর্তি বসছে একডালিয়ায়
মানস ভুঁইয়া
সুব্রত মুখোপাধ্যায় শুধু একটা নাম নয়। একটা সময়। নকশাল আন্দোলনের উত্তাল সময়ে মেডিক্যাল কলেজে কী সব কাণ্ড ঘটেছে। মহাজাতি সদনে যেতাম মাঝেমধ্যে। দেখতাম প্রিয়দা-সুব্রতদা চা বানাচ্ছেন। বললাম ছাত্র পরিষদ করব। সুব্রতদা বললেন সত্যি করবি? ৮০ ভাগ জুড়ে আমার ভিতর সুব্রতদা রয়েছেন। বাবা মারা গেলেন আমার। খবর দিতে পারিনি। কোথা থেকে খবর পেয়ে বাড়িতে বৌদিকে নিয়ে হাজির। মা মারা যাওয়ার সময়েও তাই। বুকে আগলে রাখতেন। জড়িয়ে রাখতেন। রাজনীতির ঊর্ধ্বে সম্পর্ক ছিল। দাদা-ভাই। বিরোধী দলের ভূমিকা কী হবে তা সুব্রতদা শিখিয়েছেন। বাংলার রাজনীতিতে সুব্রতদাকে বাদ দিয়ে কোনও রিসার্চ, আলোচনা, ইতিহাস, কোনও কিছুই লেখা যাবে না। স্পিকার মহোদয়কে বলব স্পেশ্যাল অনুষ্ঠান বা কিছু করা যায় কিনা, দেখবেন।
চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য
যে কাজের জন্য এখানে বলতে হচ্ছে, সেটা কোনওদিন করতে হবে ভাবিনি। বিধানসভায় এসে সুব্রতদার আসন খালি, এটা দেখতে হবে তা কল্পনাও করিনি। সুব্রতদা অনেক কাজের মধ্যে দিয়ে মানুষের পাশে থেকেছেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গেই তাঁর সখ্যতা ছিল। আমি যে দুর্গা পুজোর সঙ্গে জড়িত, তা সুব্রতদার বিধানসভা এলাকার মধ্যে পড়ে। যে সাহায্য তিনি করেছেন, ভুলি কী করে! ছাত্র রাজনীতি থেকে সুব্রতদাকে অনুসরণ করেছি। জীবন তার মতো চলবে, শুধু এই আসনটা শূন্য হয়ে গেল।
সুব্রত সাহা
যে মানুষটা দু’দিন আগেও ছিলেন, আজ নেই, ভাবতে পারছি না। যেদিন হাসপাতালে দেখতে গেলাম, জিজ্ঞাসা করলেন মা কেমন আছেন। সুব্রতদাকে নিয়ে গিয়ে মুর্শিদাবাদের গ্রামে গ্রামে মিটিং করেছি। জিপ জোগাড় করেছি। তেলের পয়সা নেই। সুব্রতদা বুঝতে পেরে নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে দিলেন। এই হচ্ছে সুব্রতদা। আন্দোলন করতে গিয়ে কতবার লালবাজারের সেন্ট্রাল লক-আপে কাটিয়েছি। সুব্রতদা ছিলেন আমাদের প্রাণের স্পন্দন। সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে বাংলার ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস লেখা যাবে না। ছাত্র আন্দোলনকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছেন তিনি। সফল মন্ত্রী। যেখানেই তিনি কাজ করেছেন সফল হয়েছেন।
অশোক দেব
সুব্রত এই নামটা মানেই আন্দোলন। খুব একগুঁয়ে মানুষ ছিলেন। একসঙ্গে বহু আন্দোলন করেছি। একজন অভিভাবককে হারালাম।
দেবাশিস কুমার
যেদিন প্রথম বিধানসভায় আসছি, সেদিন সুব্রতদা আমায় নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর ঘরে বসে বোঝালেন বিধানসভাটা কী। খুব সুন্দর গল্প করতেন। তুলে ধরতেন অনেক অজানা ঘটনা। ৭২ সালে মন্ত্রী হয়েছিলেন সুব্রতদা। অনেক সময় দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কারা দেখা করবেন, তার আপয়েন্টমেন্টও তিনিই করতেন। এবং সেটা তাঁর খুব পছন্দের কাজ ছিল। মন্ত্রিত্বের থেকেও নাকি বেশি ভাল লাগত। এ কথা শুনেছিলাম তাঁর মুখ থেকেই। এইরকম অনেক কথা, যা বলে শেষ করা যাবে না।
মানিক ভট্টাচার্য
বিধানসভায় সুব্রতদাকে নিয়ে এভাবে বলতে হবে তা কোনওদিন কল্পনাও করতে পারিনি। ছাত্র আন্দোলনে প্রিয়-সুব্রত ছিল পথপ্রদর্শক। পুরদস্তুর রাজনীতিতে যখন আসব বলে মনস্থির করলাম, সুব্রতদার পরামর্শ পেয়েছি। অনেকবার আমাদের জেলায় সুব্রতদাকে নিয়ে গিয়েছি। সুব্রতদার গড়িয়াহাটের বাড়িতেও আমাদের জন্য দরজা সবসময় খোলা থাকত। সেই জমানায় যখনই কোনও সমস্যায় পড়েছি সুব্রতদার কাছে ছুটে গিয়েছি। বিধানসভাতেও সুব্রতদার ঘরে সময় পেলেই আড্ডায় বসে যেতাম।