আজ মহাষ্টমী। বীরষ্টমীও বটে। অকালবোধনের মহোৎসবে এই তিথির ভিন্ন তাৎপর্য। অঞ্জলি থেকে অস্ত্রপূজা, সন্ধিপূজা থেকে বলিদান, নানা আচারের আয়োজন আজ। লিখছেন
দেবাশিস পাঠক
বর্ষা চলে গেছে। এসেছে আশ্বিন মাস। এসেছে মহিষাসুরমর্দিনীর মহাপূজার মহাক্ষণ। জলদান্তে আশ্বিন মাসি মহিষারিনিবর্হিনীম। এসময়ে মহা অষ্টমী তিথির মাঝরাতে ভক্তি সহকারে বিবিধ বলিপ্রদানই বিধেয়। যে তা করবে, সে মহাবলের অধিকারী হবে। দেবীং সম্পূজয়িত্বা তু অষ্টমী হ্যর্ধরাত্রিষু। যে ঘাতয়ন্তি সদাভক্ত্যা তে ভবন্তি মহাবলা।
মহা অষ্টমীর মহানিশায় এভাবে দেবী পূজার বিধান রয়েছে দেবীভাবতের ২১তম অধ্যায়ের নবম শ্লোকে। ৫৯তম অধ্যায়ের ২০তম শ্লোকে এর সঙ্গে জুড়েছে উপবাসী থাকার বিধান এবং মহাসমারোহে পূজনের নিদান। সোপবাসনিশার্ধে তু মহাবিভববিস্তরৈঃ।
‘বলি’ শুনলেই যাঁরা নাক সিঁটকান, বহু মানুষের, কর্মচারী ও গ্রাহকের রক্ত চুষে সম্পত্তি বৃদ্ধি করেও বলিতে লগ্ন রক্তপাত নিয়ে যাঁদের অজস্র আদিখ্যেতা, তাঁদের এই সুযোগে একটা কথা জানিয়ে রাখা আবশ্যক। বলি মানে স্রেফ ছাগল কিংবা মহিষ বলি নয়। ‘অন্নদাকল্প’ বলছে, ‘কামক্রোধছাগ বাহৌ বলিং দত্বা প্রপূজয়েৎ’। ছাগল হল কামের প্রতীক। নর বা মানুষ লোভের। মহিষ ক্রোধের। মেষ মোহের। উট মদ বা অহংকারের। আর মার্জার বা বেড়াল মাৎসর্য বা পরশ্রীকাতরতার। এসবের মাধ্যমে, প্রতীকের যোগে তাই আত্মলোকের পরিমার্জনাই বলির আসল কথা। লোকাচারে লুকিয়ে আছে আন্তর প্রদীপের সলতে উসকে দেওয়ার ব্যবস্থা।
মহাষ্টমী যেহেতু বলি প্রদানের তিথি, সেজন্য বলিদানের অন্যতম উপচার অস্ত্রেরও বিশেষ পূজা আজ। আজই। ‘ওঁ ত্রিশূলায় নমঃ’, ‘ততঃ ওঁ খড়গায় নমঃ’, ‘ওঁ চক্র ত্বং বিষ্ণুরূপোহসি বিষ্ণুপাণৌ সদাস্থিতঃ। দেবী হস্তস্থিতো নিত্যং সুদর্শন নমো’স্তু তে।।’ এইভাবে এক এক করে মন্ত্র উচ্চারণ করে পুরোহিত দেবীর সবকটি অস্ত্রের পূজা সারেন।
এই শক্তিতে, শস্ত্রে, রক্তক্ষয়ে, ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গানে, ভারতবর্ষের সংগ্রাম চিনে নিয়েছিল স্বাধীনতা অর্জনের নির্দিষ্ট পথ। অকালবোধন যে ভূমির প্রাণোৎসব, সেই বঙ্গে জাগ্রত যৌবনের দীপ্র ইশারায় শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে নেওয়ার সশস্ত্র সংগ্রাম। তারই সূত্রে ইতিউতি সর্বজনীন দুর্গোৎসবের আয়োজন। বাংলায় তাই স্রেফ পুরাণে নয়, পরানেও দুর্গা পূজা। বাংলায় তাই স্রেফ শাস্ত্রবিধানে অর্চিত হন না দেবী, পূজিতা হন শস্ত্রের বিস্তারেও।
তাই, তাই-ই অনুশীলন সমিতির সর্বাধিনায়ক পুলিনবিহারী দাসের উৎসাহে মহাষ্টমীর সকালে বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গোৎসবের প্রাঙ্গণে বীরাষ্টমীর আয়োজন। লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, কুচকাওয়াজ, এক কথায় সামরিক শক্তির প্রদর্শন। ১৯৩০- এ এসব উদ্যোগ আয়োজন দেখে উদ্দীপ্ত কলকাতার তদানীন্তন মেয়র সুভাষচন্দ্র বসু। পূজার জন্য তিনি দিলেন ৫০০ টাকা। আর, তার আট-নয় বছর পর, ওই পূজা আয়োজনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়লেন বাগবাজার পূজা কমিটির সভাপতি হিসেবে।
একই প্রণোদনায় তৈরি হয়েছিল সিমলা ব্যায়াম সমিতি। উদ্যোক্তা বিপ্লবী সংগঠন ‘যুগান্তর’-এর নেতা অতীন্দ্রনাথ বসু। নিজে কুস্তিগীর ছিলেন। ব্যায়াম সমিতিতে যুবকদের শরীরচর্চায় উৎসাহিত করতেন। ধনী-দরিদ্র, জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে শক্তি আরাধনার আয়োজন করবেন বলে ১৯২৫-এ শুরু করলেন দুর্গোৎসব। পূজা প্রাঙ্গণে বসত স্বদেশি মেলা। এই পুজোর সঙ্গেও জড়িত ছিলেন বাংলার শক্তিপুরুষ সুভাষ। এই পুজো প্রাঙ্গণেও পালিত হত বীরাষ্টমী। ১৯৩৯-এ এসবের জন্যই এ পুজো নিষিদ্ধ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার।
শক্তি উপাসক সুভাষচন্দ্র কুমারটুলি সার্বজনীনেরও সভাপতি ছিলেন। সে সময়েই এই পুজোয় এক চালার দুর্গা প্রতিমা পাঁচ চালায় রূপান্তরিত হয়। শক্তি পুজোর প্রতিমায় ঘটে বিবর্তন।
প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, বাংলায় দুর্গা পূজার অষ্টমীতে মহাশক্তির আরাধনা লগ্নে বীরাষ্টমী উৎসব ব্রত পালনের সূত্রপাত একজন নারীর হাত ধরে। তিনি রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী, স্বামী বিবেকানন্দের আশীর্বাদধন্যা, মহাত্মা গান্ধির কর্মকাণ্ডে সহযোগিনী, সরলা দেবী চৌধুরানী। জাতীয়তাবোধের প্রসার ঘটাতে ১৯০৩ সালে তিনিই প্রথম চালু করেন এই উৎসব পালনের প্রথা।
যখন বাংলার বুকে দুর্গাপূজা ও বীরাষ্টমী পালনের সূত্রে ছাত্র-যুবরা বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে অগ্নিহোত্রী ঋত্বিক হয়ে উঠছিল, তখন, তখনই, সেই উদ্দীপনের বিপ্রতীপে সংকেতিত হচ্ছিল ভিন্ন চলন, ভারতবর্ষের অন্য প্রান্তে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে ইংরেজের পদলেহনকারীর ভূমিকাগ্রহণে ব্যস্ত ছিল ডক্টরজি কেশব বলিরাম হেগড়েওয়ার, গুরুজি মাধবরাও সদাশিবরাও গোলওয়াকার প্রমুখের গেরুয়া বাহিনী।
তাই, মহাষ্টমীর পূজন-অর্চনে ওদের কোনও অধিকার নেই।
তাই, অষ্টমীর অঞ্জলির সঙ্গে নিজেদের অন্বিত করতে পারে না ওরা।
তাই, দেবী শক্তিকে ভয় পায় ওরা। বন্দিত নন্দিত নারীশক্তি ওদের নিত্য নিন্দাবাদের বিষয়বস্তু।
মহাষ্টমী বীরাষ্টমী তাই ওদের জন্য নয়। শাক্তপীঠ বঙ্গভূম তাই ওদের জন্য নয়। এ ওদের ব্রাত্য তিথি। এ ওদের থেকে মুখ-ফেরানো মাটি।
তাই-ই, গত বিধানভা নির্বাচনে গেরুয়া অসুর বধ হয়েছে বাংলার দুর্গার হাতে। ত্রিশূলে, খড়গে, সুদর্শন চক্রে নয়, জনাদেশের দিব্যাস্ত্রে।
বাংলার বুকে তাই প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে বীরাষ্টমীর প্রণাম মন্ত্র।
ওঁ দুর্গাং শিবাং শান্তিকরীং ব্রহ্মাণীং ব্রহ্মণং প্রিয়ং। সর্বলোকপ্রণেত্রীঞ্চ প্রণমামি সদা শিবাং।।