আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষকেই আমরা পিতৃপক্ষ বলি। অমাবস্যাতে এই পিতৃপক্ষের অবসান হয়ে মহালয়ার ভোরের ব্রাহ্ম মুহূর্তে শুরু হল মাতৃপক্ষ বা দেবীপক্ষ। এই পক্ষের ষষ্ঠীতেই মায়ের বোধন এবং দশমীতে বিসর্জন। কোজাগরী লক্ষ্মীপূর্ণিমাতে শেষ হয় বাঙালির পরম আকাঙ্ক্ষিত এই দেবীপক্ষ। সারাটা বছর কেউ ঠিকভাবে বলতে পারে না কোনটা প্রথমা, কোনটা দ্বিতীয়া, কবেই বা সপ্তমী অথবা অষ্টমী! অথচ পুজোর এই দিনগুলোতে কিছুতেই মনে থাকে না তারিখ বা বার। তখন দিনগুলো শুধুই ষষ্ঠী, সপ্তমী বা অষ্টমী…। নতুন জামাকাপড়, আড্ডা, খাওয়াদাওয়ার প্ল্যানিংয়ের পাশাপাশি আরেকটি জিনিসও তখন বহুমূল্যবান, পুজোর সময় নির্ঘণ্ট। যা হাতে পেলেই মনে হয় এইবার পুজো শুরু।
আরও পড়ুন-আজ চেতলায় ভার্চুয়াল চক্ষুদান করবেন মুখ্যমন্ত্রী
কথিত আছে রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের আগে শক্তি ও সৌভাগ্য প্রার্থনা করে রামচন্দ্র দেবী দুর্গার বোধন করেছিলেন। বোধন কথার অর্থ জাগিয়ে তোলা। তাই শরৎকালের এই দুর্গাপুজোকে অকালবোধন বলা হয়ে থাকে।
সাধারণত আশ্বিনের মাঝামাঝি বা শেষদিকেই দুর্গাপুজো হয়। কিন্তু মাস দুয়েক আগে মলমাসের প্রভাবে সবকিছুই পিছিয়েছে। তাই দুর্গাপুজো এবার আশ্বিন পার করে কার্তিক মাসে শুরু হচ্ছে।
আরও পড়ুন-তোতাপাড়ার ঘন জঙ্গলে হয় দেবীর আরাধনা
দেবীর আগমন ও গমন
হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী কোন বাহনে দেবী দুর্গা মর্ত্যে আসছেন এবং কোন বাহনে আবার কৈলাসে ফিরবেন, তার ওপরে অনেকাটাই নির্ভর করে গোটা বছরটা কেমন কাটবে। সপ্তমীতে দেবীর আগমন এবং দশমীতে গমন ধরা হয়। সপ্তমী এবং দশমী যে বারে পড়ছে, সেই বার অনুযায়ী বাহন নির্ধারিত হয়। মঙ্গল ও শনিবারে বাহন ঘোটক। এই বছর সপ্তমী শনিবারে ও দশমী মঙ্গলবারে। তাই মা দুর্গার আগমন এবং গমন দুই-ই ঘোটকে। যার ফল ছত্রভঙ্গ। আবার আগমন ও গমন একই বাহনে হলে তার ফল অত্যন্ত অশুভ বলে মনে করা হয়। এ-ছাড়া দোলা, গজ এবং নৌকাতেও দেবীর আগমন ও গমন হয়।
আরও পড়ুন-শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্য জানতে সমীক্ষা করবে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ
মহাষষ্ঠী
মহাষষ্ঠীর সকালে কল্পারম্ভ দিয়ে শুরু হয় মা দুর্গার বোধন। প্রার্থনা করা হয় ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত এই পুজোপর্বে যেন কোনও বাধাবিপত্তি না ঘটে। এরপর ঘট ও জলে পূর্ণ একটি তামার পাত্র মণ্ডপের এক কোণে স্থাপন করা হয়। সেইখানেই দেবী দুর্গা ও চণ্ডীর পুজো করা হয়। এরপর শুরু হয় দুর্গার বোধন। হয় অধিবাস এবং আমন্ত্রণপর্ব। বোধনের পর বিল্বশাখায় দেবীকে আহ্বান জানানো হয়। অশুভ শক্তি দূর করার জন্য ঘটের চারপাশে তিরকাঠিতে সুতো জড়িয়ে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন-মহালয়াকে বাঁচিয়ে রেখেছেন রেডিও-ডাক্তাররা
মহাসপ্তমী
মহাসপ্তমীতে নানা রীতিনীতির মধ্যে অন্যতম হল নবপত্রিকা স্নান। একে কলাবউ স্নানও বলা হয়ে থাকে। নবপত্রিকার অর্থ হল ন’টি গাছের পাতা। কলা, বেল, কচু, হলুদ, জয়ন্তী, দাড়িম, অশোক, ধান ও মান— এই ন’টি উদ্ভিদকে দুর্গার ন’টি রূপের প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা হয়। নবপত্রিকা স্নানের মধ্যে দিয়ে দুর্গার ওই ন’টি রূপ একত্রে ‘নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা’ নামে পূজিতা হন।
একটি পাতাওয়ালা কলাগাছের সঙ্গে বাকি আটটা গাছ একসঙ্গে শ্বেত অপরাজিতার লতা দিয়ে বেঁধে একজোড়া বেল-সহ লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা-পরা বউয়ের আকারে গণেশের পাশে রেখে সিঁদুর পরিয়ে নবপত্রিকা পুজো হয়।
আরও পড়ুন-সুখবর! রাজ্য পুলিশের সিভিক ও আশা কর্মীদের বোনাসের ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর
মহাষ্টমী
দুর্গাপুজোর পাঁচদিনের মধ্যে অন্যতম প্রধান একটি দিন মহাষ্টমী। প্রতিটা দিনের পুজোতেই অঞ্জলি দেওয়া হয়, কিন্তু অষ্টমীর অঞ্জলির মাহাত্ম্যই আলাদা।
মহাষ্টমীর অপর তাৎপর্যপূর্ণ রীতি হল সন্ধিপুজো। অষ্টমী এবং নবমীর সন্ধিক্ষণে এই পুজো হয় বলে একে সন্ধিপুজো বলে। অষ্টমী তিথির শেষ চব্বিশ মিনিট ও নবমী তিথির শুরুর চব্বিশ মিনিট, মোট আটচল্লিশ মিনিটের সময়সীমাতে সন্ধিপুজো হয়। ১০৮টি পদ্ম অর্পণ করে এবং ১০৮টি প্রদীপে আরতি করে সন্ধিপুজো হয়। কথিত আছে অষ্টমী তিথি ও নবমী তিথির এই সন্ধিক্ষণে দেবী দুর্গা আবির্ভূতা হন চামুণ্ডা রূপে। এই সময়েই ‘চণ্ড’ ও ‘মুণ্ড’ নামে দুই ভয়ঙ্কর শক্তিশালী অসুরকে বধ করেছিলেন।
আরও পড়ুন-দিনের কবিতা
মহানবমী
সন্ধিপুজো শেষ হলেই শুরু হয় মহানবমীর পুজো। এটাই মা দুর্গার শেষলগ্নের পুজো। এই দিনেও বলিদান ও নবমী হোমের রীতি রয়েছে। এইদিন মায়ের মহা-আরতি অবশ্যই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
আরও পড়ুন-নিরাপত্তা বাড়ল বিদেশমন্ত্রীর
বিজয়াদশমী
দশমীর সকালবেলায় শেষ পুজোর মধ্যে দিয়ে দুর্গার ঘট বিসর্জন দেওয়া হয়। ষষ্ঠীতে চারটি তিরকাঠিকে ঘিরে বাঁধা সুতোর বাঁধন কেটে দিয়ে দেবীর প্রাণবিসর্জনের মুহূর্তটা বড্ড ভারাক্রান্ত। এদিনের পুজোর একটি বিশেষ প্রসাদ হল দধিকর্মা।
পুজো শেষে ঠাকুর বরণের পালা। দুর্গাকে সিঁদুরে রাঙিয়ে, মিষ্টি খাইয়ে পান, ধান, দূর্বা দিয়ে বরণ করা হয়। মাকে বরণের পরে তাঁর ছেলেমেয়ে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ এমনকী অসুরমশাইকেও বরণ করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। বরণের পর সকলের সৌভাগ্য কামনায় সধবা মহিলারা মেতে ওঠেন সিঁদুরখেলায়। মা দুর্গার আঙিনায় বিষাদ মুহূর্ত আরও একবার আনন্দে ভরে ওঠে। মন-প্রাণ, হৃদয় জুড়ে তখন একটাই ধ্বনি, ‘আসছে বছর আবার হবে…।’