শারদসম্প্রীতি

আপনারা কেউ নিজামকে চিনবেন না। চেনার কথাও নয়। এই নিজাম তো আর হায়দরাবাদের বিখ্যাত নিজাম নয়! এ নিজাম আমার সহপাঠী।

Must read

আপনারা কেউ নিজামকে চিনবেন না। চেনার কথাও নয়। এই নিজাম তো আর হায়দরাবাদের বিখ্যাত নিজাম নয়! এ নিজাম আমার সহপাঠী। আমরা একসঙ্গে পড়লেও খুব যে বন্ধু ছিলাম এমন নয়। আসলে তখন সহপাঠী আর বন্ধুর পার্থক্য বুঝতে শিখিনি। দিনের অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটানো সহপাঠীই ছিল বন্ধু আর বন্ধুদের প্রায় প্রত্যেকেই ছিল সহপাঠী। পরে যত বড় হয়েছি ততই প্রকৃত বন্ধু এবং সহপাঠী বা সহকর্মীর প্রভেদ উপলব্ধি করেছি।

আরও পড়ুন-নতুন বইয়ের গন্ধ

তা যা-ই হোক, সেসময় নিজাম হয়তো প্রাণের বন্ধু ছিলও না। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এখন প্রত্যেক বছর দুর্গাপুজো এলেই আমার নিজামের কথা মনে পড়ে। মনে পড়াটা স্বাভাবিকও বটে।
আজ থেকে তিরিশ বছর আগের ঘটনা। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিক। অযোধ্যায় প্রবাদের ‘সেই রাম’ না থাকলেও বাবরি মসজিদ ছিল মোটামুটি অক্ষত। আমাদের আজকের মফসসলও তখনও প্রকৃতিগতভাবে গ্রামের দিকেই ঝুঁকে। মাঠের আলে— জলাজমিতে— রেললাইনের ধারে ফুটত কাশ। জলাজমির জমা জলে অথবা জল-থইথই পুকুর-দিঘির টলটলে দর্পণে মুখ দেখাতে ভুলত না শরতের নীল আকাশ। নীলাভ সলিল-মুকুরে ভেসে উঠত তিরতিরে হাওয়ায় কম্পমান সাদাকাশ। পেঁজা তুলোর মতো ভাসমান সাদা মেঘের ওড়াউড়ির ছবি সেখানে এসে মেলাত রং। মেঠো রাস্তার ধারে ‘অরুণ আলোর অঞ্জলি’ হয়ে ঝরে পড়ত শিউলি। শরৎ-প্রকৃতিতে কেমন একটা পুজোর গন্ধ ভেসে বেড়াত। আমাদের মতো হা-দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েদের নাকেও এসে লাগত সেই গন্ধ। আমাদের সাজসজ্জার বালাই না থাক, প্রকৃতি ঠিক সেজে উঠে জানিয়ে দিত শারদোৎসব আসন্নপ্রায়।

আরও পড়ুন-চড়িভাতি থেকে পিকনিক মাঝে ভগ্ন সেতু

আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির কারণেই হোক অথবা সীমিত চাহিদার কারণেই হোক, সেই সময় আমাদের গ্রামে দুর্গাপুজোতে ছেলেমেয়েদের জন্য পোশাকের ঢল নামত না। তবে পুজোতে একটাও নতুন জামা-কাপড় হবে না এমন দুর্ভাগার সংখ্যা কম-ই ছিল। আমি ছিলাম শেষোক্তদের দলভুক্ত তেমনই এক বেচারা, যার দু’একবার পুজোতে পরিধানের জন্য সত্যিই নতুন কিছু জোটেনি। অবশ্য তা নিয়ে আমার খুব যে মনখারাপ করত এমনও নয়।
আমার তখন দশম শ্রেণি। পুজোর ঠিক আগে-আগে ক্লাসে একদিন আমরা ছেলেরা বসে গল্প করছিলাম পুজোয় কার ক’টা নতুন পোশাক হল তা-ই নিয়ে। আমি মজা করে বললাম, যার য’টা ড্রেসই হোক, আমার সমকক্ষ যে কেউ হতে পারবে না, সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আসলে সেই বছরে আমার পুজোয় নতুন কোনও কিছু হয়নি, আর হওয়ার সম্ভাবনাও ছিল না। আমাদের আর্থিক অবস্থা জানা থাকায় আমার কথা শুনে প্রায় সকলেই হেসে উঠল। দু’একজন পরে মনে হয় সহানুভূতিও জানিয়েছিল।

আরও পড়ুন-পারলে দশ পয়সার লেনদেন প্রমাণ করুক

পরদিন স্কুলের শেষে গুটিগুটি পায়ে নিজাম এসে হাজির আমার কাছে। ক্লাসের সকলের সঙ্গে ছিল আমার সহজ সম্পর্ক। তা-ই ব্যাক-বেঞ্চার বলে নিজামের এমন সংকোচ থাকার কথা নয়। আমি বললাম, কী হয়েছে নিজাম, কিছু বলবি? ও একটু ইতস্তত করে বলল, জানি না তুই কিছু মনে করবি কি না! তোকে একটা জিনিস দিতে চাই… তোকে নিতেই হবে! আমি বললাম, জিনিস! তুই দিবি! নিতেই হবে! কী ব্যাপার বল তো, আমার মাথায় তো ছাই কিছুই ঢুকছে না! নিজাম মুখে কিছু না বলে ওর ব্যাগ থেকে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট বের করে ধরিয়ে দিল আমার হাতে। বলল, নে, এটা ধর। আমি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে খুলতে খুলতে বললাম, কী আছে এতে? নিজাম আমার হাতটা চেপে ধরল। বলল, খুলিস না। এটা গিয়ে তোর মায়ের হাতে দিস, আর মাকে বলিস এটা নিজামের মা পাঠিয়েছে তোর জন্য।

আরও পড়ুন-একাধিক দাবিতে বিজেপি সাংসদ-বিধায়কের বাড়ির সামনে ধরনা-বিক্ষোভ

ফিরে প্যাকেটটা মায়ের হাতে তুলে দিতে মা বলল, প্যাকেটে কী আছে রে, খোকা?
আমি বললাম, আমি জানি না। তুমি খুলে দেখ কী আছে?
প্যাকেটটা খুলে মা বলল, এটা তো দেখছি একটা জামার ছিট। তা এটা তোর কাছে এল কী করে?
আমি তখন মাকে সব কথা খুলে বললাম। শুনতে শুনতে মায়ের মুখে কেমন একটা দুঃখের ভাব ফুটে উঠল।
আমি বললাম, মা, তুমি এতে এত কষ্ট পাচ্ছ কেন? তাহলে কি আগামিকাল আমি এটা নিজামকে ফিরিয়ে দেব?
মা বলল, না খোকা, ফেরত দিতে হবে না। কিন্তু কেন জানি না আমার সত্যিই মনখারাপ করছে। কেন মনখারাপ করছে আমি নিজেই বুঝতে পারছি না। প্রকৃত ভালবাসার উপহার হয়তো এমন করেই মনখারাপ করে দেয়!… মা হয়ে নিজের সন্তানকে যা দিতে পারিনি, সেই জিনিস যখন অন্য আরেক মা তার হাতে তুলে দেয় তখন কেমন লাগে নিজে অসমর্থ মা না হলে বোধহয় বোঝা যায় না!… খোকা, তুই নিজামকে বলিস ও যেন ওর মাকে বলে যে আমি এই উপহার পেয়ে খুব খুশি হয়েছি।

আরও পড়ুন-আটকে রাখতেই তৈরি অসমে ট্রানজিট ক্যাম্প

সে-বছর সেই ছিট দিয়ে তৈরি জামা-ই ছিল পুজোয় আমার একমাত্র নতুন পোশাক। কাপড়টার রং অথবা মান নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা মনেতে এতটুকু স্থান পায়নি। জামাটা পছন্দসই হয়েছিল কি না— সেসব নিয়ে ভাবার কোনও অবকাশও ছিল না। আর সেটা হবেই বা কেন? পুজোর দিনগুলোতে পরার মতো সবেধন নীলমণি একমাত্র জামা বলে কথা! তবে নবমীর বিকেলে একটা সুন্দর জামা পরা পাপিয়ার কথা শুনে মনটা যে একটু খারাপ হয়নি তা নয়। ডানাকাটা পরীর মতো দেখতে পড়াশোনায় চৌকস ডাক্তারবাড়ির মেয়ে পাপিয়া আমাদের ক্লাসেই পড়ত। হ্যাঁ রে, এটা কী জামা পরেছিস! এই তোর পুজোর নতুন জামা! পাঁচ-সাতজন বন্ধু পরিবৃত পাপিয়া পুজোমণ্ডপে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখে চিৎকার করে এমনভাবে কথাগুলো বলেছিল যে, শুনে খারাপ না লাগাটাই অস্বাভাবিক। পরে অবশ্য মনখারাপটা বদলে গিয়েছিল চাপা রাগে। মনে মনে বলেছিলাম, তোরা তো শুধু বলেই খালাস, আর কিছু তো তোদের ইচ্ছে অথবা সাধ্যে কুলোয় না! রাতে বাড়ি ফিরে অবশ্য এক চরম সত্য উপলব্ধি করে মাথা ঠান্ডা হয়েছিল— ধর্ম আলাদা হলেও পাশাপাশি বসবাস করার সুবাদে উৎসবের পরিবেশ সামাজিকভাবে কেমন আমাদের সকলকেই ছুঁয়ে যায় আর তৈরি করে দিয়ে যায় প্রকৃত সম্প্রীতি, যা মুখে বলে বা বই পড়ে কখনও গড়ে ওঠে না।

আরও পড়ুন-কন্যাশ্রী কাপে এবার চ্যাম্পিয়ন ইস্টবেঙ্গল

দশমীর ভাসানেও সেই একই জামা পরে বেরিয়েছিলাম। তার আগে বিকেলে মুসলিমপাড়ার রাস্তায় একটু ঘোরাঘুরি করছিলাম, যদি নিজামের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় এই আশায়! দেখা হয়নি নিজামের সঙ্গে। ব্যর্থমনোরথে ফিরে যোগ দিয়েছিলাম বিষাদের নিরঞ্জনে।
পরের তিন-চার বছর পুজোয় নতুন জামা হলেও নবমীর বিকেলে এবং দশমীর সন্ধ্যা-রাতে নিজামের দেওয়া ছিটে তৈরি সেই পুরনো জামাই পরেছি। তারপর গায়ে আর না হওয়ায় জামাটা পরতে পারিনি। কিন্তু হলে কী হবে, জামাটা আজও আমার আলমারিতে শোভা পাচ্ছে। মজার বিষয় অন্য। চার-পাঁচ বছর পুজোর সময় জামাটা পরলেও নিজামের সঙ্গে সেই জামা-পরা অবস্থায় আমার কিন্তু একবারও সাক্ষাৎ হয়নি!

আরও পড়ুন-আটকে রাখতেই তৈরি অসমে ট্রানজিট ক্যাম্প

জানি না পুজোয় আমার নতুন জামা না হওয়ার খবর নিজামের কানে কীভাবে পৌঁছেছিল এবং সেটা ওকে কেনই বা এভাবে আলোড়িত করেছিল। এটাও কোনও দিন ওর কাছে জানতে চাইনি— সত্যিই ওর মা ওর হাত দিয়ে আমার জন্য আমার মায়ের হাতে এই সওগাত তুলে দিয়েছিল কি না! শুধু এটুকু মনে আছে শারদোৎসব তো দূরের কথা, এমনিও কখনও নিজাম আমাদের বাড়িতে আসেনি; আমিও কখনও ওদের বাড়ি যাইনি। কিন্তু মা চলে যাওয়ার পর আজও যখন শারদোৎসবের সময়ে মুসলিমপাড়া ধরে ওর বাড়ির পাশ দিয়ে যাতায়াত করি মনে হয় ওর বাড়ি ঘুরে আসি, আর ওর মা যদি এখনও বেঁচে থাকেন তাহলে তাঁর কাছে গিয়ে মাথা হেঁট করে বলি, আপনি হয়তো জানেন না, আপনার দেওয়া শারদ উপহার শুধু আমার জীবনেই নয়, আমার মায়ের জীবনেও পাওয়া সবচেয়ে বড় উপহার।

দিলীপকুমার ঘোষ

Latest article