নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী: বাংলাদেশের ভৌগোলিক আকৃতিটাই এমন যে, সে চিরকালই ভারতবর্ষের এককোণে আপন সুখের নীড় বেঁধে নিয়েছিল। যাঁরা দূরে ছিলেন এবং যাঁরা দয়া করে এদেশে এসে আমাদের মাথার ওপর ইতিহাস তৈরি করেছেন, তাঁদের কেউই প্রায় আমাদের ভালবাসেননি, এমনকী যাঁদের আমরা একান্ত আপন বলে মনে করি, তাঁরাও ভালবাসেননি। ভাবুন তো সেই কোন কালে, যখন পূর্বভারতে আর্যরা মোটেই ছড়িয়ে পড়েননি, তখনই আর্যরা ঐতরেয় আরণ্যকে লিখে ফেলেছিলেন, বাংলাদেশের লোকেরা নাকি পাখির মতো, খেচরমাত্র। কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়, জৈন-বৌদ্ধ আর চিরকালের অনার্য সভ্যতার খড়কুটো দিয়ে যে বাসাখানি আমরা নিভৃতে তৈরি করছিলাম, সেখানে লাগল উত্তুরে হাওয়া। আর্যরা বিধান দিলেন— তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্য ছাড়া, অন্য যে-কোনও কারণে বঙ্গদেশের মাটিতে পা দিলেই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। অনার্যের স্পর্শকাতর আর্যরা প্রায়শ্চিত্তের পরিধি বাড়িয়ে দিলেন অঙ্গ, কলিঙ্গ এবং মগধ পর্যন্ত। সৌভাগ্যক্রমে নদী-নায়িকা জাহ্নবী সমুদ্রকে স্বয়ংই আলিঙ্গন করেছেন সাগরসঙ্গমে; কাজেই সেই তীর্থবারির স্পর্শলোভে যাও-বা পরদেশি এসেছিল, তাকে হয়তো আবার শুদ্ধ হতে হয়েছে জাহ্নবীর অপর প্রান্তে স্নান করে। বঙ্গের বিড়ম্বনা এমনই।
যাঁরা এককালে বাংলায় এলে প্রায়শ্চিত্ত করে শুদ্ধ হতেন, তাঁরাই যখন আর্যায়নের বা অন্নের তাগিদে ভিড় করে এলেন এদেশে, আমরা কিন্তু বাধা দিইনি। নিন্দা না প্রশংসা কে জানে, আকবর-পিতামহ বাবর বলেছিলেন— বাংলাদেশের লোকেরা নাকি কাউকে বাধা দেয় না, যে কোনও পরিবর্তিত সুলতানের রাজত্বেই তারা নাকি হাসিমুখে মেনে নেয়। একই কারণে আর্যদেরও আমরা বাধা দিইনি। শ্রদ্ধায়, অবনতিতে তাঁদের শাসন বঙ্গসন্তানেরা প্রসাদী পুষ্পের মতো মস্তকে ধারণ করেছে। পরিবর্তে, তাঁরা আমাদের বেদপাঠ শেখাননি, শেখাননি সামগানের আরোহণ-অবরোহণ। বাংলার আদিবাসী যাঁরা, যাঁরা ব্রাহ্মণদের সঙ্গে মেলামেশা না করায় মনুর কলমের খোঁচা খেয়ে ‘শূদ্র’ বনে গিয়েছিলেন, বৌদ্ধ এবং সম্ভবত বাঙালি পাল রাজারা যে চণ্ডাল, কৃষক, ক্ষেত্রকরদের সামাজিক অস্তিত্ব স্বীকার করে নিচ্ছিলেন তারা সবাই হারিয়ে গেল উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির চাপে। ভট্ট আর মিশ্র মহাশয়েরা সামাজিক বর্ণবিন্যাস করলেন একান্তই কাশী-কা়ঞ্চী আর কোশল-অবন্তীর অনুকরণে। নইলে আমাদের দেশে, হয় বাইরে থেকে আসা ব্রাহ্মণ, নয়তো শূদ্র— এই তো বিভাগ। যাদের দিয়ে সুবিধে হবে তাদের কখনও ক্ষত্রিয়, কখনও বৈশ্য কখনও বা সৎশূদ্র, সদগোপ এই সব জাতিবিভাগ তৈরি করে নিলেন। আর কতকাল আগে যে উত্তর ভারতীয় ‘শূদ্র’ নামটি আমাদের দিয়েছিলেন, কারণে অকারণে অনাদরে-অবহেলায় সেই উপাধি আমরা আজও বহন করে চলেছি; কাজেই কেন্দ্রের চক্রান্ত শুধু আজকের নয়, চক্রান্ত ছিল সেদিনও।
কুলজি গ্রন্থগুলিতে উত্তর ভারত থেকে ব্রাহ্মণ আমদানির গল্প বারবার শুনতে পাই। কখনও আদিশূরের যজ্ঞাগ্নি সমিন্ধনের জন্য কান্বকুজ্ব কিংবা বারাণসী থেকে ব্রাহ্মণ এসেছে, কখনও শশাঙ্কের ব্যাধিমুক্তির জন্য সরযূ নদীর তীর থেকে ব্রাহ্মণ আনতে হয়েছে, আবার কখনও বা শ্যামলবর্মা ব্রাহ্মণ নিয়ে এসেছেন ব্যক্তিগত প্রয়োজনে, কারণ একটাই— বাংলাদেশে ভাল দরের ব্রাহ্মণ ছিল না। ঐতিহাসিকেরা এই গল্পগুলিকে কাজে লাগান স্বমত প্রতিষ্ঠায় সুবিধে হলে। তবে সমস্যা শুধু ব্রাহ্মণ অথবা বেদ, অথবা ভাষা নিয়েও নয়, সমস্যা আছে আমাদের বঙ্গাব্দ এবং নববর্ষ নিয়েও। আমাদের বঙ্গাব্দও মহামহিম আকবরের দান।
আরও পড়ুন-পয়লা বাঙালি
রবীন্দ্রসংগীত, নলেন গুড় কিংবা বিয়ের ধুতির মধ্যেও যদি-বা বাঙালির বাঙালিত্ব প্রমাণ করার দায় থাকে কিছু, পয়লা বৈশাখের (Pahela Boisakh) নববর্ষে সেই দায় আছে বলে মনে হয় না। আমাদের এই বঙ্গদেশে বঙ্গাব্দের ইতিহাস জানেন, এমন মানুষের সংখ্যা পাঁচ শতাংশও নয়। অসংখ্য মানুষ এখনও আছেন, যাঁদের শেয়ালদা-স্টেশনে ট্রেনে ওঠার সময় বঙ্গাব্দের বর্তমান সংখ্যা জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারবেন না। এমনকী আমাকেও কারণান্তরবশত বঙ্গাব্দের সংখ্যা স্মরণ করতে হয় মাঝে মাঝে, কিন্তু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলে আমিও থতমত খাব। তার কারণ অনভ্যাস। নিত্যদিনের কাজে বাংলা-ক্যালেন্ডার কোনও কাজে লাগে না, এমনকী বর্ষশেষের আলোয় রাঙা এই চৈত্র মাসে কোনও আধুনিক প্রেমিক-প্রেমিকার চোখে সর্বনাশ পর্যন্ত ধরা পড়ে না। আর যে ছেলেটা সদ্য-রাবীন্দ্রিক রোমাঞ্চে চোখ ঢুলু করে— ‘বর্ষশেষের আলোর রাঙা’ উচ্চারণ করেছিল এবং নিপুণভাবে লক্ষ্য করেছিল অভি-দণ্ডায়মান তরুণীর চোখ-দুটিতে প্রেমময়ী দীর্ঘছায়া ঘনিয়ে আসে কি না— তরুণী উত্তর দিয়েছিল— কী সব চৈত্র-ফৈত্র বলছিস, আর তোর সর্বনাশটাই বা কী করলাম আমি? দ্যাখ, এইসব কবিতা-ফবিতা দিয়ে আমাকে একদম ‘হেকল’ করার চেষ্টা করিস না।
এই মর্মান্তিক ‘সেমানটিক’ বিপর্য্যাস শুনেই আমি বুঝেছিলাম— আর বাংলা ক্যালেন্ডার থাকার কোনও মানেই হয় না। ছোটবেলায় এইসব বালক-বালিকাকে কালবিষয়ক কোনও রচনা লিখতে হয়নি, এমনকী ‘টিক’ দেবার জন্য দুটো ‘খোপ’-ও থাকে না কোথাও যে, ঠিক দিয়ে শুদ্ধ করবে— ফাল্গুন-চৈত্র এই দুই মাস বসন্তকাল, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ এই দুই মাস গ্রীষ্মকাল। এই অবস্থায় যেখানে বাঙালির মনে আর চৈত্রের প্রত্যয় হয় না, সেখানে বৈশাখের (Pahela Boisakh) আমপাকা দুপুর কোন রোমাঞ্চ বয়ে আনবে বাঙালির মনে। ফলে বঙ্গাব্দের মাস, তারিখ, তিথি এসবের প্রয়োজন পড়ে শুধু ঐতিহ্যবাহিতায় কখনও অন্নপ্রাশন, কখনও বিবাহ অথবা একাদশী, পূর্ণিমা-অমাবস্যা, আর সেই সাড়া-জাগানো পুজোর দিন— দুর্গাপূজা, কালীপূজা, সরস্বতী পূজা আর লক্ষ্মীপূজা— এ-গুলিতে বাংলা সন ইংরেজিতে অনুবাদ হয়। কিন্তু এইরকম কতগুলি বিশেষ দিন ছাড়া বঙ্গাব্দের দৈনন্দিন উপযোগ নেই কোনও।
অথচ দেখুন, প্রতি বছর বঙ্গাব্দ আসে, আমরা বর্ষবরণ করি, যথাসাধ্য যথামতি। এমনকী সকাল এবং সন্ধ্যায় মহোৎসাহও দেখা দেয় এক বিশেষ শ্রেণির মানুষের মধ্যে— যাঁরা আমাদের অন্ন-ব্যঞ্জন, বেশবাসের ব্যবস্থা করেন। সকালে তাঁদের গুণ্ঠিত ধুতিতে জাবদা খাতা আর সিদ্ধিদাতা গণেশের মূর্তি নিয়ে কালীমন্দিরে যেতে দেখি, কেননা বঙ্গদেশে পুজোর প্রথমাংশ সিদ্ধিদাতা গণেশের জন্য বরাদ্দ থাকলেও এ-দেশে গণেশ-চতুর্থীর দেশ নয়, আমরা মাথা বিকিয়ে আছি জগন্মাতার কাছে আর ভোলানাথ শংকরের কাছে— মাতা মে পার্বতী দেবী, পিতা দেবো মহেশ্বরঃ। আমরা ধামায় করে সিদ্ধিদাতা গণেশকে নিয়ে জনক-জননীর আদর খাইয়ে আনি কালীমায়ের থানে, তারপর জাবদা খাতায় হিসেব আরম্ভ করি শুভলাভ লিখে।
বছরের পর বছর আমাদের বঙ্গাব্দ আসে, কিন্তু নিউ ইয়ার্স ডে-র মতো সেটা সাধারণ্যের মর্মকেন্দ্রে স্পর্শ করে না। তার কারণ বোধহয় এটাই যে, বাঙালির নববর্ষ বাঙালির কোনও ‘বৃহদারম্ভ’ থেকে সৃষ্টি হয়নি। কোনও শক-কুষাণ নয়, কোনও বিক্রমাদিত্য-শালিবাহনও নয়, বাঙালির বঙ্গাব্দ কোনও বঙ্গীয় রাজার বিজয়-অভিষেক থেকে আরম্ভ হয়নি, কোনও ধর্মান্দোলনের প্রসূতিও নয়, এই বঙ্গাব্দ, এমনকী যে-চৈতন্য মহাপ্রভুকে সামনে রেখে এক উদার শতাব্দী শুরু হতে পারত, তা-ও হতে পারল না, কেননা বঙ্গ তখন অন্য প্রশাসনের অধিকারে। প্রশাসনিক মদত ছাড়া অব্দ চালু হয় না। যেখানে ‘ঋতু শূন্য বেদ শশী’র শকাব্দ দিয়ে হুসেন শাহি প্রশাসনের অব্দ-গণনা হচ্ছে, সেখানে চৈতন্যাব্দ শুরু হল বৈষ্ণবাচার্যদের অঙ্কগণনায়, বঙ্গাব্দ পড়ে রইল আকবর শাহের বদান্যতার জন্য।
ওই যে কথাটা বলেছি— বাঙালির বঙ্গাব্দ স্মরণ করার ক্ষেত্রে আমাদের বৈশ্য-ব্যবসায়ী সম্প্রদায় যতখানি উজ্জ্বলভাবে উপস্থিত, সাধারণ্য তত নয়— তার কারণ বাঙালির নববর্ষ জড়িয়ে আছে প্রথমত ব্যবসার সঙ্গেই। মহামতি আকবর যখন তামাম হিন্দুস্তানের সম্রাট তখন ভারতবর্ষে হিজরী সন চলছে। হিজরী সন যেহেতু চান্দ্রমাস গণনা করে, তাই প্রতিবছর একই সময়ে দিন-ক্ষণের হিসেব চলত না। এতে খাজনা আদায়ের সমূহ অসুবিধে হত। কেননা তখন খাজনা দেওয়ার ব্যাপার ছিল কৃষিনির্ভর। জমিদার-জোতদার-কৃষকের ঘরে ফসল উঠবে, ধারদেনা শোধ হবে, খাজনা জমা পড়বে রাজকোষে। অতএব একটা ফসলী সন অলিখিত ভাবে চলত। কিন্তু হিজরী সনের গণনায় খাজনা-আদায়ের সময় গণনা ফি-বছর হয়ে যেত অন্যরকম। আকবরের অর্থমন্ত্রী এবং আমির শিরাজির বিদ্যাবত্তায় তখন উঠে এল বঙ্গাব্দের গণনা। সেখানে বাঙালির সূর্য সিদ্ধান্তে সৌরমাসের গণনাটা মেনে নিয়ে আমির শিরাজ তার ওপর চাপিয়ে দিলেন হিজরী সন ৯৬৩। তার মানে বঙ্গাব্দের একক থেকে বঙ্গাব্দ শুরু হল না। হিজরী সন মাথায় চাপিয়ে বঙ্গাব্দ জন্মাল প্রায় হাজার বছরের কৈশোর অতিক্রান্ত করে, আর এমনভাবে সেটা সয়ে-সইয়ে গেল বাঙালির উদার হৃদয়ে যে, আমরা ভাবলাম ১৪২৯ বছর ধরে আমাদের এই বঙ্গাব্দ চলছে, কী আনন্দ।
সবার শেষে এটাই বলব যে, পাটিগণিতের অঙ্ক দেওয়ার সময়— রাম-রহিম আর হ্যারি-র নাম নিলেই জাতীয় সংহতি হয় না। আমাদের বঙ্গাব্দের বর্ষভাবনার মধ্যেই সবচেয়ে বড় জাতীয় সংহতির চিহ্ন আছে। অত্যুৎসাহী জনে কেউ কেউ এই ঘটনাটাকে সম্রাট আকবরের ‘গিফট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আমরা শুধু বলব— জাঁহাপনা নিজের প্রশাসনের প্রয়োজনেই এই ব্যবস্থা চালু করেছেন বটে কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড় উদারতা— তিনি অত্রস্থ হিন্দুদের সৌর-সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন, এমনকী মেনে নিয়েছেন ‘বঙ্গাব্দ’ শব্দটাও। আর বাঙালির উদারতা শুধু এমনটা নয়, যেমনটা আকবর শাহের পিতামহ বাবর বলেছিলেন, অর্থাৎ বাঙালি সবসময় Loyal to every changing Sultan, বরঞ্চ বাঙালির উদারতা এই যে, সে মহামতি আকবরের উদারতাকে সম্মান জানিয়ে হিজরী সনটাকে সে আত্মসাৎ করার গৌরব দেখিয়েছে।