প্রতিবেদন : বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানকে স্মরণ করে শনিবার বহু প্রতীক্ষিত পদ্মাসেতু (Padma Bridge) উদ্বোধন করলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina)। বর্ণময় উৎসবের আবহে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে সেতুর উদ্বোধন করেন হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী নিজেই প্রথম এই সেতুর টোল দেন। সওয়া ছ’কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মাসেতুর উদ্বোধনের পর এই আবেগঘন মুহূর্তকে ধরে রাখতে মেয়ে পুতুলের সঙ্গে সেলফিও তোলেন হাসিনা। পরে এক বিশাল জনসমাবেশে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। সেখানেই হাসিনা বলেন, আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আজ বাংলাদেশের মানুষ কতটা গর্বিত। আমি নিজেও আনন্দিত, উদ্বেলিত ও গর্বিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে, ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে শেষ পর্যন্ত আমরা পদ্মাসেতু নির্মাণ করতে সফল হয়েছি। এই সেতু শুধু ইট, সিমেন্ট, ইস্পাত, লোহার একটি কাঠামো নয়। এই সেতু হল আমাদের স্বপ্ন, আমাদের গর্ব, আমাদের অহঙ্কার। আমাদের সক্ষমতা ও মর্যাদার প্রতীক। এই সেতু দুই পারের মধ্যে এক নিবিড় বন্ধন তৈরি করবে। এই সেতু প্রত্যেকটি বাংলাদেশি নাগরিকের। এই সেতুর সঙ্গেই জড়িয়েছে আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের আবেগ, আমাদের সাহসিকতা ও প্রত্যয়।
হাসিনার (Padma Bridge – Sheikh Hasina) আক্ষেপ, বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারণে সেতু নির্মাণের কাজ দু’বছর পিছিয়েছে। তবে তার জন্য তিনি কখনও আত্মবিশ্বাসে হারাননি বা হতাশ হয়ে পড়েননি। বঙ্গবন্ধুর সেই বিখ্যাত মন্তব্য উল্লেখ করে হাসিনা বলেন, আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি। শেষপর্যন্ত আমরাই জয়ী হয়েছি। হাসিনা তাঁর ভাষণে বিদ্রোহী কবি সুকান্তের কবিতার লাইন উল্লেখ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়”। আমরা কখনও কারও কাছে মাথা নোয়াইনি, ভবিষ্যতেও নোয়াব না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কখনও আমাদের মাথা নোয়াতে শেখাননি।
সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার প্রায় সব সদস্য। ছিলেন সরকারের শীর্ষ আধিকারিকরা। এদিনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পদ্মাসেতুর উপর একটি ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। সেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এদিন স্মারক ডাকটিকিট, সুভ্যেনির শিট, উদ্বোধনী খাম ও সিলমোহর এবং ১০০ টাকা মূল্যের ডাকটিকিট প্রকাশ করেন। সেতু নির্মাতা সংস্থার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে সেতুর একটি রেপ্লিকা উপহার দেওয়া হয়। উদ্বোধনের পর হাসিনা পদ্মাসেতু ঘুরে দেখেন। সেতু উদ্বোধনের পর ভারত-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানানো হয়েছে। অভিনন্দন জানিয়েছে ওয়াশিংটনও। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুগান্তকারী এই প্রকল্পের সফল সমাপ্তি ও উদ্বোধন উপলক্ষে ভারত সরকার ও ভারতের প্রতিটি নাগরিক বাংলাদেশ সরকার ও সেদেশের মানুষকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানায়। এই সেতু ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ককে আরও মজবুত করবে। আমেরিকা বলেছে, পদ্মাসেতু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নতুন ও গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ তৈরি করবে। বাণিজ্য বৃদ্ধি করবে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করবে। বাংলাদেশের এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছে পাকিস্তানও। এদিন উদ্বোধন হলেও রবিবার সকাল ৬টা থেকে এই সেতু সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হবে। এই সেতু চালু হলে ঢাকার সঙ্গে কলকাতার দূরত্ব অনেকটাই কমবে।
আরও পড়ুন: যানজট মুক্ত করার লক্ষ্যেই চালু হবে ‘ফিডার সিস্টেম’, জানালেন ফিরহাদ হাকিম
কোনও বিদেশি সংস্থার অর্থসাহায্যে নয়, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থে ৯০ মাসের মধ্যে সওয়া ছ’কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু গড়ে তুলেছে। ২০১৪ সালের শেষদিকে সেতুর কাজ শুরু হয়েছিল। এই সেতু নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রায় চার হাজার মানুষ। সেতুতে মোট ৪২টি স্তম্ভ আছে। স্প্যান সংখ্যা ৪১টি। শেষ স্প্যানটি বসানো হয় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। প্রত্যেকটি স্তম্ভ তৈরি হয়েছে মজবুত পাইল ইস্পাত দিয়ে। জলের নিচে ১২২ মিটার পর্যন্ত গভীরে গিয়েছ স্তম্ভের ভিত। গোটা বিশ্বে আর কোনও সেতুর স্তম্ভ এত গভীরে নেই। পদ্মাসেতুর ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ সহজ হবে। দোতলা এই সেতুর একতলা দিয়ে চলবে বাস এবং অন্যান্য যানবাহন। নিচের তলায় চলবে ট্রেন। বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে এই সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। এই সেতুর নকশা এমনভাবে করা হয়েছে যাতে ভূমিকম্পেও কোনও ক্ষতি হবে না। এই সেতু রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প অনায়াসে প্রতিরোধ করতে পারবে। সম্ভবত আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতে আসতে চলেছেন হাসিনা। সেক্ষেত্রে তিনি পদ্মাসেতু দিয়েই ভারতে আসবেন।
এক নজরে
নির্মাণ খরচ হয়েছে ৩০১৯৩.৩৯ কোটি টাকা।
সেতুর দৈর্ঘ্য সওয়া ছ’কিমি, প্রস্থ ৭২ ফুট।
সর্বোচ্চ ৮০ কিলোমিটার বেগে ৭৫ হাজার গাড়ি চলাচল করবে।
চার লেনের সড়কের মাঝে রোড ডিভাইডার।
প্রায় সাড়ে সাত বছরে নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ।
এই সেতু মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ের সঙ্গে শরিয়তপুর ও মাদারিপুর জেলাকে যুক্ত করেছে।
বড় লঞ্চ চলাচলে যাতে সমস্যা না হয় তার জন্য জল থেকে ৬০ ফুট উঁচুতে করা হয়েছে এই সেতু।
সেতুতে মোট ৪২টি স্তম্ভ আছে।
ডিজিটাল পদ্ধতিতে সেতুর টোল আদায়।