লুঠ হয়ে গেছে ব্যাঙ্কের টাকা

নরেন্দ্র মোদির জমানায় ব্যাঙ্ক লুঠের অঙ্ক ১২ লক্ষ কোটি ছাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ঔদাসীন্য, অপদার্থতা এবং প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদত এ-জন্য দায়ী। সে-দায় মোদি ঝেড়ে ফেলবেন কোন যুক্তিতে? জিজ্ঞাসা করছেন সাংসদ জহর সরকার

Must read

(দ্বিতীয় পর্ব)
ভারতের অকার্যকর সম্পদের অনুপাত
প্রতিটি অনাদায়ী ঋণ অকার্যকর সম্পদ বা এনপিএ-তে পরিণত হয় না। এনপিএ কথাটি প্রযোজ্য সেইসব ব্যাঙ্ক (Bank)) ঋণের ক্ষেত্রে যেগুলি পরিশোধের সময় ৯০ দিনেরও বেশি পেরিয়ে গিয়েছে। এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবে পরিশোধের নির্দিষ্ট সময়ের পর ৯০ দিন পেরিয়ে গেলেই অনাদায়ী ঋণকে অকার্যকর সম্পদ হিসেবে দেগে দেওয়া হয় না। ব্যাঙ্ক বছরের পর বছর ধরে সেই খাতটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে, সেই লক্ষ্যে নানা পদক্ষেপ করে, তারপর সেটাকে ‘ক্ষতি’ বলে চিহ্নিত করে। ওই অ্যাকাউন্ট ব্যাঙ্কের খাতা থেকে মুছে ফেলার আগে ব্যাঙ্ক চার বছর বা তারও বেশি সময় ধরে ঋণ কাঠামোর অদলবদল করে মূল টাকাটা এবং তার সঙ্গে যতটা পারা যায় সুদের পরিমাণ উদ্ধারের প্রয়াস চালায়।

সকল ঋণখেলাপিই অপরাধী নন। বহু ক্ষেত্রে বাজারের গতিপ্রকৃতির কারণেই গ্রাহক সত্যি-সত্যিই ক্ষতির মুখে পড়ে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য হারান। আসলে ভারত এবং বিশ্বের দক্ষিণ গোলার্ধের আরও কয়েকটি দেশে ব্যাঙ্ককে প্রতারণার বিষয়টা বেশ ভালমতো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে রাজনৈতিক মদতের সুবাদে, ভুয়ো ব্যবসা-প্রস্তাব প্রদানের সৌজন্যে, প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে কাগজে-কলমে কম বা বেশি ব্যয়, যাকে পরিভাষায় আন্ডার-ইনভয়েসিং বা ওভার ইনভয়েসিং বলা হয়, তার মাধ্যমে, ইচ্ছাকৃতভাবে অর্থ ও সম্পদ ভিন্ন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে। এসব সুপরিকল্পিত পদ্ধতি প্রয়োগ করেই একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে ইচ্ছাকৃত ভাবে ‘রুগ্ণ’ করে ফেলা হয়।
সমগ্র পৃথিবীতে প্রচলিত প্রথা হল এটাই যে, ঋণদানকারী সংস্থাগুলোর মোট ঋণ বাবদ প্রদত্ত অর্থের ১ থেকে ২ শতাংশ অকার্যকর সম্পদ বা এনপিএ-তে পরিণত হয়। এমনটা ধরাই থাকে, তা সত্ত্বেও সম্পত্তিকে তরল অর্থে রূপান্তরিত করেই হোক বা আবেদন-নিবেদনের মাধ্যমেই হোক, যেভাবেই হোক ব্যাঙ্কগুলো অনাদায়ী ঋণ আদায়ের চেষ্টা চালিয়েই যায়।

আরও পড়ুন- মান্দারের সংস্থার বিদেশি অনুদান লাইসেন্স খারিজ করল কেন্দ্র

আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার বা আইএমএফ এই প্রক্রিয়া-পদ্ধতি সমর্থন করে। এই সংস্থার প্রতিবেদনে প্রকাশ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপিয়ান কমিউনিটির অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ দেশে মোট এনপিএ-র অনুপাত ১.১ শতাংশের আশেপাশে থাকে, খুব বেশি হলে ১.২ শতাংশে পৌঁছায়।
এই দেশগুলোতে আর্থিক সংস্থার নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কড়া, জনসচেতনাও খুব বেশি আর রাজনৈতিক মদতদান অত্যন্ত কম। কানাডার এনপিএ মাত্র ০.৪ শতাংশ। দক্ষিণ কোরিয়ায় এই অনুপাত কেবল ০.৫ শতাংশ। সুইৎজারল্যান্ডে এটা ০.৬ শতাংশ। যারা ব্যাঙ্ক প্রতারণার সঙ্গে জড়িত, চিনে তাদের কঠোরভাবে মোকাবিলা করা হয়। ফলে, সেদেশে এনপিএ অনুপাত ১.৮ শতাংশ। প্রগতিশীল এশীয় দেশগুলিতে এনপিএ-র অনুপাত হয় এর চেয়েও কম নয়, এর কাছাকাছি। এর বেশি নয়। কিন্তু যদি রাশিয়ার দিকে তাকানো যায়, তাহলে দেখব, সেদেশে রাজনীতির সঙ্গে পুঁজির একটা অশুভ আঁতাত রয়েছে। ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজনীতিকদের জোট সেদেশে অতি-পরিচিত ঘটনা। ফলে সেই দেশে এনপিএ বৃদ্ধি পেয়ে ৮.৩ শতাংশ। কিন্তু ভারত, আমার ভারতবর্ষ, ব্যাঙ্ক প্রতারণার ক্ষেত্রে এদের সব্বাইকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। বিশেষত মোদিজি-শাসিত ভারতেই এটা বেশিমাত্রায় ঘটেছে। সরকারি তথ্য এই বক্তব্যকে সমর্থন করছে।

কেন্দ্রীয় অর্থ-মন্ত্রক প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে, মোদি যখন ক্ষমতায় আসেননি এবং দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার যখন বিদায়ের পথে, তখন ৩১ মার্চ, ২০১৪-তে এই এনপিএ অনুপাত ছিল ৪.১ শতাংশ আর মোদি-জমানায় ৩১ মার্চ, ২০১৮-তে তা শিখরে পৌঁছায়, হয় ১১.৪৬ শতাংশ। তবে অর্থমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী বহু সাধাসাধির পর তাঁর আমাকে দেওয়া শেষ পত্রে জানিয়েছেন, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২-এ এনপিএ কমে ৪.৪১ শতাংশ হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লখযোগ্য, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক (Bank) অব ইন্ডিয়া কিন্তু তার আর্থিক স্থিতিশীলতা-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে এই তথ্যটি জোর দিয়ে জানাতে পারেনি। তাদের অনুমান, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর এনপিএ ২০২৩-এর সেপ্টেম্বরে ফুলে-ফেঁপে ৯.৪ শতাংশে পরিণত হবে আর বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলোর ক্ষেত্রে অঙ্কটি দাঁড়াবে ৫.৮ শতাংশে। এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই যে সম্প্রতি এনপিএ-পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে। সেই সঙ্গে এটাও ঠিক যে অন্যান্য উন্নত ও উন্নয়শীল দেশসমূহ যেখানে এনপিএ বৃদ্ধির সম্ভাবনা সমধিক এবং শাসক গোষ্ঠীর অতি-ধনীদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব একটু হলেও কম, সেইসব দেশের তুলনায় ভারতের এনপিএ অনুপাত দু-তিন গুণ বেশি।
এনপিএ অনুপাত এবং খেলাপি ঋণ মুছে ফেলার ব্যাপারে ভারত বিশ্ব রেকর্ড করে ফেলেছে। বিষয়গুলোকে অনিবার্য বলে উড়িয়ে দিয়েছে মোদি সরকার। আর্থিক নীতির বাড়াবাড়ির কারণেই এমনটা ঘটেছে বলে লঘু করে দেখানোর চেষ্টাও চলেছে। কিন্তু সত্যিটা হল এই যে, অর্থ বা টাকাটা কখনওই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়নি, খোয়া যায়নি। যারা এ-বিষয়ে উদাসীন তাদের বেবাক বুদ্ধু বানিয়ে যারা আতি-চালাক, তাদের ভাঁড়ারে জমা হয়েছে। যে-যেভাবে পারে ওই টাকা হাতিয়েছে।
(পরবর্তী অংশ আগামিকাল)

Latest article