অগ্রজ এক সাংবাদিকের মুখে গল্পটা শুনেছিলাম। তখন সাতের দশক। তরুণ বয়স। ব্যান্ডেল বা চুঁচুড়া, কোনও একটা জায়গা থেকে রোজ ট্রেন ধরে হাওড়া। তারপর লঞ্চ পেরিয়ে ময়দানের এ মাঠ-ও মাঠ ঘুরে খবর খুঁজে নিয়ে ঢুকতেন কাগজের অফিসে।
এমনই একদিন মোহনবাগান তাঁবুতে মুখোমুখি পড়ে গিয়েছেন ধীরেন দে-র। সদ্য মাঠে খবর করতে আসা তরুণদের জন্য বেশ ভয়-ভীতি-সম্ভ্রম জাগানো মাঠকর্তা। খুব গম্ভীর আর রাশভারি ব্যক্তিত্ব। অনেকের মতে কিছুটা উন্নাসিকও। তা সেই লোক ক্লাব তাঁবুতে এক অচেনা ছোকরাকে দেখে খুব গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন, কে আপনি? এখানে কী চাই?
পরেরটা সরাসরি সেই সাংবাদিক দাদার কথায় শোনাই। তিনি বলছিলেন, ‘‘তখন সাংবাদিক বলে পাড়ায় বেশ খাতির পেতাম। সবে কলেজ থেকে বেরিয়েছি। কাগজে নাম দিয়ে লেখা বেরোত। গর্বে আটখানা। যেন আমি কী হনু। কিন্তু সেই লোকের সামনে পড়ে মনে হল, ধুস, কী হবে সাংবাদিক হয়ে! এ তো কোনও পাত্তাই দিল না।” তা হয়েছে কী, ধীরেন দে-র প্রশ্ন শুনে বুক ফুলিয়ে সেই সাংবাদিক দাদা বলে উঠেছিলেন, আমি প্রেস। কিন্তু তাতে ময়দানি কর্তার কোনও হেলদোল হয়নি। ভুরু কুঁচকে বলে ওঠেন, প্রেস? কী প্রেস? বিজি প্রেস? ধরণী দ্বিধা হওয়ার অবস্থা। সেই দাদা তখন একটি বাংলা দৈনিকের ট্রেনি রিপোর্টার। কিন্তু রাশভারি কর্তার একটা কথায় গর্বের ফানুস মিইয়ে একাকার।
গল্পটা বলতে হল। নাহলে সেই রাশভারি ধীরেন দে-র অন্য রূপ বোঝানো যাবে না। আর সেটা পয়লা বৈশাখে বারপুজোর বিশেষ দিনে। ময়দানে এই দিনটার বিশেষ মাহাত্ম্য এখানেই। এই দিনে সবাই অন্যরকম। ধীরেন দে যেমন অনায়াসে কাছে ডেকে নিতেন চেনা-অচেনা সভ্য-সমর্থকদের। নিজে মোহনবাগান তাঁবুতে আসতেন নতুন শুভ্র বসনে। তখন ময়দানে সব ক্লাবেই বারপুজোর দিন ফুটবলার ও কর্তাদের নতুন পোশাক পরে মাঠে আসার রেওয়াজ ছিল। অনেকে আবার স্ত্রী-সন্তানদেরও সঙ্গে নিয়ে আসতেন। বারপুজো (BarPujo) তো আর শুধু বারপুজো নয়, এটা ছিল ফুটবলপুজো।
কেমন ছিল সাত বা আটের দশকের সেই বারপুজোর (BarPujo) সকাল? একেবারে অন্যরকম। লম্বা বিরতির পর এই বারপুজো দিয়ে হত নতুন ফুটবল মরশুমের আবাহন। ট্রফি জেতার শপথ। ‘‘আমরা তখন হাঁ করে বসে থাকতাম কবে পয়লা বৈশাখ আসবে। আবার নিজেদের মাঠে বল নিয়ে নামব। বারপুজো হয়ে গেলে আমরা ফুটবলাররা দুটো দলে ভাগ হয়ে ম্যাচ খেলতাম। সভ্য-সমর্থক মিলিয়ে প্রচুর দর্শক হত। একেবারে হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচ। রেফারি হতেন কোচ। খুব মজা হত সেই ম্যাচে। আসলে মন ভাল করা সকালে সবকিছুই ভীষণ ভাল লাগত সেদিন।” বলছিলেন মানস ভট্টাচার্য।
তখন ময়দানের সব ক্লাবেই এক ছবি। ইস্টবেঙ্গল বা মোহনবাগানের মতো বড় ক্লাব কেন, ময়দানের সমস্ত ক্লাবে একইরকম জাঁকজমক সহকারে হত বারপুজো। লাল-হলুদ তাঁবুতে শঙ্কর মালির তার আগে থেকেই নাওয়া-খাওয়ার সময় থাকত না। ফুটবলারদের অভিভাবকসম ছিলেন শঙ্কর। কোন তরুণ বয়সে দক্ষিণ ভারত থেকে ক্লাবে এসে আর ফিরতে পারেননি। ক্লাবকেই নিজের বাড়ি বানিয়ে ফেলেছিলেন। ফুটবলাররা শঙ্করকে আদর করে ডাকতেন বাবা বলে। সত্যিই তো কাজ কি তাঁর কম? আগের মরশুম শেষ হয়ে যাওয়ার পর তুলে রাখতে হত বার পোস্ট। কারণ তখন ঘেরা মাঠে ক্রিকেট ও হকি খেলা হত। বারপুজোর আগে সেই বার পোস্টে সাদা রং করতে হত। তারপর সেটা সযত্নে রেখে দেওয়া হত পয়লা বৈশাখের জন্য। সেদিন বারপুজো হবে বলে।
বড় ক্লাবে বড় আয়োজন। ছোট ক্লাবে ছোট। কিন্তু ময়দানে বারপুজো সবার। গত দু’বছর কোভিড এসে সেই চেনা ছবিটাই যেন বদলে দিয়েছিল। গতবছর তা-ও নমো-নমো করে ক্লাব মাঠে বারপুজো হয়েছে। তার আগের বছর সেটুকুও হয়নি। এখন আতিমারির ঝাপটা কমে এসেছে। এবার তাই অনেক ক্লাবেই জমিয়ে বারপুজোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। ময়দানের এক ছোট ক্লাবের কর্তা বলছিলেন, স্পনসর নেই। দল গড়তে নাজেহাল অবস্থা। কোভিড সব কেড়ে নিয়েছে। অনেকের প্রাণ গিয়েছে। কিন্তু ময়দানের চিরাচরিত বারপুজোকে কোভিড কেড়ে নিতে পারেনি। এটা ছিল, আছে এবং থাকবে।
এবারই মোহনবাগানে নতুন আঙ্গিকে বারপুজোর আয়োজন করা হয়েছে। এই লেখা যখন পাঠকের হাতে পৌঁছবে, হয়তো ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে সেই অনুষ্ঠান। সকাল ন’টায় পুজো। দশটায় সংগীত অনুষ্ঠান। থাকছে রবীন্দ্রসংগীত ও কবিতা পাঠের আসর। গত দু’বছরের না হওয়া অনুষ্ঠানের খেদ এবার মিটিয়ে নিতে চায় নবগঠিত কর্মসমিতি। প্রাক্তন ফুটবলারদের সপরিবারে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে প্রভাতী মিলন উৎসবে। এমন মিলন মেলায় আসার সুযোগ কে হাতছাড়া করতে চায়!
আগে বড় ক্লাবে প্রায় ভিয়েন বসে যেত। কম লোক তো নয়। সকালে দেদার চা-বিস্কুট। পুজো শেষে হরেক খাওয়াদাওয়া। লুচি আর আলুর দম মাস্ট। একসঙ্গে সবাই মিলে বসে লুচি, আলুর দম আর রকমারি মিষ্টি খাওয়ার মজাই ছিল আলাদা। সেই মিষ্টির আবার অনেক বাহার ছিল। কর্তাদের কেউ বর্ধমান থেকে আনতেন মিহিদানা আর সীতাভোগ। মিষ্টি আসত কৃষ্ণনগর থেকেও। অনেক সময় প্লেয়ারদের জন্য আলাদা প্যাকেট হত বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য।
তবে পয়লা বৈশাখের সকালে মোহনবাগান প্লেয়ারদের কাছে অমোঘ আকর্ষণ ছিলেন ধীরেন দে স্বয়ং। আগেই লিখেছি, এই একটা দিনে তিনি সবার সঙ্গে মিশে যেতেন গাম্ভীর্যের মুখোশ সরিয়ে। সেদিন ধীরেন দে সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন রুপোর কয়েন। ফুটবলারদের নতুন বছর শুরু হত এই কয়েন উপহার নিয়ে। ‘‘আমাদের কাছে ধীরেনদার এই রুপোর কয়েনের আকর্ষণ ছিল সাংঘাতিক। উনি কয়েন হাতে দিয়ে আশীর্বাদ করতেন যেন নতুন মরশুমে ভাল খেলি। ভীষণ ভাল লাগত যখন রাশভারি ধীরেনদা কাছে ডেকে হাতে এটা তুলে দিতেন”— আরও বলছিলেন মানস।
বারপুজো একই থাকলেও বহু ক্লাবে এখন ভোজনের পরিসর বেড়েছে। লুচি আর আলুর দমের জায়গায় এসেছে ফ্রাইড রাইস, চিলি চিকেন। কোথাও বিরিয়ানি। এর বাইরে ছবিটা সেই এক। সকাল থেকে ফুলে সজ্জিত ক্লাব তাঁবু। কোথাও মৃদু স্বরে বাজছে রবীন্দ্রসংগীত বা মান্না-হেমন্ত। ধুতি-পাজামা-পাঞ্জাবিতে সজ্জিত ক্লাব কর্তাদের ব্যস্ততা। যা সবাইকে বুঝিয়ে দেয়, আজ অন্য এক সকাল।
তবে উৎসবের এই সকালে তাল কাটে না তা নয়। এমনই এক পয়লা বৈশাখের সকালে ধুন্ধুমার লড়াই বেধে গিয়েছিল দুই প্রধানের সমর্থকদের মধ্যে। ‘‘আমরা তখন মাঠে খেলছিলাম। দেখি গ্যালারিতে লড়াই বেধে গিয়েছে। খেলা থামিয়ে আমরা ফুটবলাররা দৌড়ে গিয়ে সেই লড়াই থামাই। সেবার উৎসবের তাল কেটে দিয়েছিল এই ঘটনা।” পিছন ফিরে মনে করতে পারলেন মানস। তবে তিনি ও তাঁর মতো অনেকেই আশ্বস্ত এটা দেখে যে, এমন সকাল আর কখনও ফিরে আসেনি বারপুজোর প্রভাতে।