ফাল্গুনের শেষে চৈত্রের আগমন। তারই সঙ্গে বাসন্তী নবরাত্রিও উপস্থিত। বঙ্গদেশ শক্তিপ্রধান। এখানে বৈদিক প্রভাবের তুলনায় শক্তি আরাধনার বেশি প্রচলন। এই বঙ্গদেশেই পালিত হয় দুটি শক্তি পুজো। একটি বসন্তকালে বাসন্তী দুর্গার পুজো, অন্যটি শরৎকালে শারদীয়া দুর্গা পুজো। শ্রীশ্রীচণ্ডী অনুসারে, বাসন্তী দুর্গার আরাধনাই সর্বপ্রথম শুরু হয়। পরবর্তীকালে শারদীয়া দুর্গা আরাধনার সূচনা। শরতের শক্তি আরাধনা যেমন শ্রীরাম সর্বপ্রথম শুরু করেন, ঠিক তেমন চৈত্র মাসে দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেছিলেন দু’জন, রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য। শ্রীশ্রীচণ্ডী বর্ণিত এই কাহিনিতে বলা হয়েছে, কোনেও এক সময় সর্বস্বান্ত হয়ে বনবাসী হয়েছিলেন রাজা সুরথ ও সমাধি নামে এক বৈশ্য। কিন্তু তাঁরা দুজনেই লক্ষ্য করলেন, যাঁদের জন্য তাঁরা বনবাসে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের কথা মন থেকে মুছে ফেলা একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না। কোনও না কোনওভাবে স্মরণে আসছে তাঁদের মুখ! কিছু না কিছু স্মৃতি ভেসে আসছে মনের মণিকোঠায়। কিছু তৃপ্ত অনুভূতি, কিছু ব্যক্ত কথা, কিছু সুখময় পটচিত্র একের পর আঁকা হয়ে চলেছে মনের ক্যানভাসে। কে আঁকছে? কেন আঁকছে? কেন সেই স্মৃতি ভুলে যেতে এত বিড়ম্বনা? এই বিড়ম্বনা নিয়েই দুজনে বিষাদগ্রস্ত হলেন। কিন্তু বিষাদ এলেই প্রসাদ উপস্থিত হয়। প্রশ্ন এলেই আসে উত্তর। ঠিক এই বিষাদ নিয়ে দুজনে উপস্থিত হলেন মেধস ঋষির আশ্রমে।
আরও পড়ুন-অস্কারজয়ী নারীরা
বিষাদমগ্ন রাজা সুরথ আর সমাধি বৈশ্যকে সাদরে আহ্বান করছেন মেধস ঋষি। ঋষি আশ্রমে প্রবেশ করে দুজনের একই প্রশ্ন— এই মায়ার সৃষ্টিকারক কে? ঋষি তাঁদের শুনিয়েছেন সেই মহামায়ার কথা, যে মহামায়ার মহাশক্তি আবৃত করেছে আমাদের মনকে এবং সেই শক্তিই ব্রহ্মরূপা সনাতনী! মেধস ঋষি মহামায়ার কথা বললে রাজা সুরথ তাঁকে প্রশ্ন করেছেন, ‘ভগবন কা হি সা দেবী মহামায়াতি যাং ভবান— ভগবন, আপনি যাঁকে মহামায়া বলছেন, তো এই দেবী মহামায়া কে?’ এ-কেবল রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যের প্রশ্ন নয়, এ হল আমাদের সকলের প্রশ্ন। কে ইনি? ঋষি মেধস নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন দেবীর স্বরূপ। তিনিই আমাদের মনঃচক্ষুকে মায়া দিয়ে আবৃত করে রেখেছেন। এই মায়াশক্তির জন্যই একটি পাখি তার সন্তানের মুখে খাবার গুঁজে দেয় পরম স্নেহে!
আরও পড়ুন-যৌথ নেতৃত্বেই বীরভূমে লড়বে তৃণমূল
এই মায়াতেই সমস্ত জগৎ পরিব্যাপ্ত। এই মায়া নিত্যা, তাঁর উত্পত্তির কোনও ইতিহাস নেই। কোথা থেকে এই মায়া এল তা আমরা জানি না। তিনি জগৎকে মুগ্ধ করেন, তিনি জ্ঞানীদের মুগ্ধ করেন। অর্থাৎ তাঁর হাত থেকে কারেও নিস্তার নেই। এই শক্তিই হলেন জগৎ সৃষ্টির প্রারম্ভিক ক্ষণে বিষ্ণুর যোগনিদ্রা। দেবীর এই যোগনিদ্রা রূপটি বর্ণনা করতে গিয়ে মেধস মুনি মার্কণ্ডেয় পুরাণ অন্তর্গত ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’র কথা উল্লেখ করেছেন। যেখানে বলা হয়েছে শ্রীহরি যখন কারণ সলিলে যোগনিদ্রায় অভিভূত ছিলেন, তখন তাঁর নাভিকমল থেকে নির্গত পদ্মের মধ্যে ধ্যানরত ছিলেন ব্রহ্মা। জগৎ সৃষ্টি হয়েছিল জল থেকে বা জগৎ সৃষ্টির প্রধান উপকরণ হল জল— এ সকলেরই জানা। তাই পুরাণে জগৎ সৃষ্টি বর্ণনায় বারংবার জলের কথা বলা হয়েছে। এ কেবল সমুদ্রপ্রমাণ জল নয়, এ হল কারণ সলিল, জগৎ সৃষ্টির কারণ যাঁর মধ্যে নিহিত। আর তার উপরই অনন্ত শয্যায় শায়িত ভগবান বিষ্ণু ‘যোগনিদ্রায় অভিভূত’।
আরও পড়ুন-যৌথ নেতৃত্বেই বীরভূমে লড়বে তৃণমূল
এই উপমা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে যদি আমরা আমাদের চারপাশে নীরব সৃষ্টির খেলার দিকে দৃষ্টিদান করি তবে দেখব, কিছু সৃষ্টি হওয়ার আগে সৃষ্টিকে সম্পূর্ণ করার জন্য একটি পর্যায়ের প্রয়োজন। একটি বীজ বৃক্ষে পরিণত হওয়ার জন্য মাটির মধ্যে নিজেকে গুপ্ত রাখে। সেখানে নিজেকে ভেঙেচুরে নতুন রূপে গড়ে তোলে। তারপর প্রবল যন্ত্রণা নিয়ে মাটি ফুঁড়ে বের হওয়ার জন্য সংগ্রাম করে ও সংগ্রামে জয়ী হলে তবেই অঙ্কুর উদ্গম হয়। সৃষ্টির জন্য বীজের যে সংগ্রাম তার মূলে আছেন যোগমায়া, তিনি অনিত্য সংসারে নিত্যের আভাস দান করেন— তাই নতুন রূপে ফুটে বের হওয়ার এত সংগ্রাম। আমাদের পৌরাণিক সাহিত্য স্বীকার করে ব্রহ্মা প্রজা সৃষ্টি করেছেন পরম তপস্যার মধ্য দিয়ে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে আরেক ছবি— এখানে বিষ্ণু যেন মাটির মধ্যে আবদ্ধ বীজের মতো মগ্ন আর ব্রহ্মা তারই মগ্নতায় সৃষ্ট অঙ্কুরকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তপস্যারত।
আরও পড়ুন-রাহুলের সাংসদ পদ বাতিল, কেন্দ্রকে তোপ তৃণমূলনেত্রী ও অভিষেকের
শ্রীশ্রীচণ্ডীর পরের কাহিনি আরও রূপকে আচ্ছাদিত। কিন্তু প্রতিটি অংশের মধ্যেই সৃষ্টির সংগীত শুনতে পাই। সেখানে বলা হচ্ছে, যোগনিদ্রায় অভিভূত বিষ্ণুর কর্ণমল থেকে জন্ম হল মধু আর কৈটভ নামে দুই দৈত্য। এই দুই দৈত্য জন্মগ্রহণ করেই তাঁরা সামনে দেখলেন প্রজাপতি ব্রহ্মাকে। তাঁরা ব্রহ্মাকে দেখা মাত্র আক্রমণ করতেই ভীত বিহ্বল ব্রহ্মা যোগনিদ্রায় আবৃত বিষ্ণুকে জাগ্রত করতে চাইলেন। তাঁর এই আগ্রহ থেকে বেরিয়ে এল স্তব। যে স্তবের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে যোগনিদ্রারূপ দেবীর গুণগাথা ও স্বরূপের প্রথম আভাস। সেই স্তবে উত্থিত বিষ্ণুর সঙ্গে তাঁরই অঙ্গ-জাত মধু ও কৈটভের শুরু হল মহারণ। প্রথমে কেউ পরাজিত হন না, তখন বিষ্ণু জানুতে স্থাপন করে বধ করলেন দুই দৈত্যকে। মৃত্যুর পর মধুর চর্বিতে জলের পরিবর্তে চতুর্দিক স্থলে পরিপূর্ণ হল। তাই পৃথিবীর আরেক নাম মেদিনী। কারণ তা মেদ থেকে জাত। জগৎ সৃষ্টি সম্পূর্ণ দেখে বিষ্ণু জগৎপালনে মনোযোগী হলেন। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা আর বিষ্ণুকে পরিচালিত করলেন যোগমায়া। তাঁর ইচ্ছার অধীনে কেবল জীব-জগৎ নয় স্বয়ং ব্রহ্মা, বিষ্ণু পর্যন্ত তা পরিব্যপ্ত হল। যদি আমরা সৃষ্টির দিক দিয়ে এই রূপকটিকে ব্যবহার করি তবে দেখব, সৃষ্টির মধ্যে যে পদ্ধতি রয়েছে, প্রস্তুতি রয়েছে, যে তপস্যা ও নিষ্ঠার প্রয়োজন, সবই দেবী যোগমায়া-রূপে প্রদান করছেন। আবার তিনি মহামায়া-রূপে আবৃত করে রেখেছেন জীব–জগতের মন। মায়ার অধীনে সকলেই পুতুলের মতো চলাফেরা করে।
আরও পড়ুন-প্রয়াত পরিচালক প্রদীপ সরকার, শোকজ্ঞাপন করেছেন অভিনেতারা
শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত দেবী স্বতন্ত্রা, স্বাধীনা। তাঁকে মহাবিদ্যা, মহামায়া, মহামেধা ও মহাস্মৃতি রূপে বন্দনা করা হয়েছে। আবার তিনি মহানিদ্রা, মোহনিদ্রা, মহাদেবী। দেবী সর্ব বস্তুকে আচ্ছন্ন করে রয়েছেন। শক্তি বিনা কোনও কর্ম ফলদান করে না। মেধস ঋষি রাজা সুরথ আর সমাধি বৈশ্যের কাছে দেবীর স্বরূপ তুলে ধরেছেন। সর্বশেষে তাঁদের এ-ও বলছেন দেবীমূর্তি রচনা করে তাঁর আরাধনা করলে দেবী প্রসন্না হন এবং তিনিই এই দুঃখপূর্ণ অবস্থা থেকে মুক্ত করতে সক্ষম। ঋষি মেধসের আদেশ অনুযায়ী রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য নদীতীরে মূর্তি গড়ে পুজো সম্পন্ন করলেন। দেবী সেই পুজোয় তুষ্ট হয়ে দেখা দিলেন তাঁদের, প্রশ্ন করলেন, ‘আমার কাছে কী চাও?’ রাজা দেবীর কাছে চাইলেন রাজত্ব। যে-রাজ্য ত্যাগ করে বনে আশ্রয় নিতে হয়েছিল, সেই রাজ্যই তিনি ফিরে পেতে চাইলেন। বিপরীত দিকে বৈশ্য সমাধি চাইলেন তত্ত্বজ্ঞান। রাজা ভোগের দিকে হাঁটলেন, বৈশ্য বেছে নিলেন ত্যাগের দিক। যে যা চাইলেন, দেবী তাঁকে সেই বরই প্রদান করলেন। গীতায় দেখি যুদ্ধক্ষেত্রে বিষাদগ্রস্ত অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরম জ্ঞানের কথা শোনাচ্ছেন। যোগবাশিষ্ঠে দেখি শ্রীরাম বিষাদমগ্ন। ঋষি বশিষ্ঠ তাঁকে পরম জ্ঞানের তত্ত্বে পূর্ণ করছেন। কিন্তু শ্রীশ্রীচণ্ডী ত্যাগের পথ আর ভোগের পথ দুটিকেই সম্পূর্ণ পৃথক করে ফেলেছেন। তাই সমাধি বৈশ্য ত্যাগকে গ্রহণ করছেন আর রাজা সুরথ ভোগের পথ আশ্রয় করেছেন। সেই জন্যই নাটকের বিষাদমগ্ন কুশীলব একজন নয়, দু-জন। একজন রাজা, অপর জন বৈশ্য। তাঁদের সামাজিক অবস্থান ভিন্ন। ভিন্ন পরিবেশ থেকে তাঁরা উঠে এসেছেন। আর উপনীত হয়েছেন ঋষি সমীপে।
আরও পড়ুন-বাড়ছে বাজেট, বিদায় নিশ্চিত স্টিফেনের
পৌরাণিক সাহিত্য অনুযায়ী মেধস ঋষি চৈত্র মাসের শুক্লা তিথিতে রাজা ও বৈশ্যকে দেবীপুজো করতে আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন পুজো করতে হবে মাটির মূর্তি নির্মাণ করে দেবী আরাধনা করলে তবেই দেবী তুষ্ট হবেন। ঋষিবাক্যকে স্মরণ করে রাজা ও বৈশ্য যে পুজো সম্পন্ন করেন, তাই হল বর্তমানের বাসন্তী পুজো। পরবর্তীকালে রাজা শ্রীরাম রাবণ বধের জন্য চৈত্র মাসের পরিবর্তে শরৎ কালে দেবী পুজো সম্পন্ন করলেন। তাই দেবী আরাধনা বাসন্তিকা ও শারদীয়া— দুই পর্বে চিহ্নিত হল। আজ আমরা বাংলায় শারদীয়া দুর্গা পুজোর আধিক্য দেখতে পাই, কিন্তু পুজো-পদ্ধতির দিক দিয়ে দুটোই দেবী দুর্গার পুজো, যে পুজো সম্পন্ন করলে আমাদের দুর্গতি নাশ হয়। যা আমাদের সহস্র বাধা থেকে ত্রাণ করে।