স্তন ক্যানসার থেকে বাঁচুন

সদ্য পালিত হল জাতীয় ক্যানসার সচেতনতা দিবস। এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্যই হল দ্রুত এই মারণরোগের নির্ধারণ এবং চিকিৎসা। বেশ কিছু ক্যানসার রয়েছে যা ঠিক সময় ধরা পড়লে সম্পূর্ণ সেরে ওঠা সম্ভব। যার মধ্যে অন্যতম হল স্তন ক্যানসার। যা মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। স্তন ক্যানসার নিয়ে আলোচনায় বিশিষ্ট ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডাঃ অরুন্ধতী চক্রবর্তী। লিখেছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

আশি-নব্বইয়ের সময়সীমা সার্ভাইকাল বা জরায়ুর মুখের ক্যানসার ছিল মহিলাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। তারপর ট্রেন্ড বদল হয়েছে এবং ধীরে ধীরে সেই জায়গায় এসছে স্তন ক্যানসার। আমাদের দেশে মহিলাদের যতগুলো ক্যানসার হয় তার মধ্যে ২৫ থেকে ২৭ শতাংশই স্তন ক্যানসার। এদেশে প্রতিবছর একলক্ষ পঞ্চাশ হাজার স্তন ক্যানসার আক্রান্ত রোগী পাওয়া যায়। এর নির্দিষ্ট কারণ জানা নেই। তবে বলা যেতে পারে এখন মহিলারা বেশিরভাগ কর্মরত, তাঁদের দেরিতে বিয়ে হয়। দেরিতে বাচ্চা হয়, যাকে বলে লেট প্রেগনেন্সি, ফলে বেশির ভাগ মা শিশুর জন্মের পর আর ব্রেস্টফিড করাতে পারছে না বা চাইছেন না। এর ফলশ্রুতি হিসেবে স্তন ক্যানসার অনেকটা বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে স্থূলতা, অ্যালকোহল নেওয়া, জেনেটিক ইত্যাদি কারণও আছে।

আরও পড়ুন-গিনি দ্বীপপুঞ্জে এখনও আটকে ১৬ ভারতীয় নাবিক

সার্ভাইকাল, ওরাল এবং ব্রেস্ট ক্যানসার এই তিনটে মহিলাদের খুব কমন তিনটি ক্যানসার। যার মধ্যে এদেশে এবং বিদেশে স্তন ক্যানসারের পরিসংখ্যান অনেক বেশি।
কেন হয় স্তন ক্যানসার
স্তনের মধ্যে থাকা ডাক্টস বা লোবিউলস আচ্ছাদিত ইপেথেলিয়াম থেকে উদ্ভূত হয় এবং এই ক্যানসার ডাক্টাল বা লোবুলার কারসিনোমা হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ। আরও অনেক ধরনের স্তনের ক্যানসার রয়েছে তবে বেশিরভাগই ডাক্ট এবং লোবিউল থেকেই হয়।
লক্ষণ
একদম ব্যথাহীন মাংসপিণ্ড বা পেনলেস লাম্প দেখা যায়। যার ফলে অনেকেই এটাকে গুরুত্ব দেন না, ফল মারাত্মক হয়।
অনেকসময় দেখা যায় লাম্পটা হয়তো স্তনে নেই পরিবর্তে অ্যাকজিলা বা বগলের নিচে রয়েছে। অ্যাকজিলাতে ব্রেস্টের কিছু টিস্যু ছড়িয়ে যায় ফলে ওখানেই লাম্পটা হয়।

আরও পড়ুন-শহুরে নকশাল দমনে গোপন নির্দেশিকা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের

কী করে বুঝবেন
স্তনের আকৃতিগত পরিবর্তন।
স্তনের চারপাশে লাল রাশ, ফুসকুড়ি।
স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত বা রস নিঃসরণ হওয়া।
অনেক ক্ষেত্রেই স্টেজ ফোরে গিয়ে স্তন ক্যানসার ধরা পড়ে। দেখা গেল অসম্ভব মাথার যন্ত্রণা, খুব বমি বমি ভাব, কোমরে ব্যথা কমছেই না, কনভালশন হচ্ছে। ব্রেনে একটা টিউমার রয়েছে। সেটা বায়োপসি করে দেখা গেল ক্যানসার কিন্তু তার শিকড়টা কোথায় খুঁজতে গিয়ে ধরা গেল যে স্তন থেকেই এর সূত্রপাত হয়েছে, সেখান থেকে ব্রেনে। এটাকে বলে মেটাস্টেটিক অর্থাৎ প্রাইমারিটা ব্রেস্ট ছড়িয়ে গেছে ব্রেনে।
আবার প্রচণ্ড কাশি হচ্ছে কিছুতেই কমছে না সেখানে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা গেল স্তন ক্যানসার কিন্তু ছড়িয়ে গেছে লাং-এ। এইভাবে লিভারেও হয়।
স্তন ক্যানসার মেয়েদের মধ্যে বেশি হলেও পুরুষের মধ্যেও দেখা যায়। পুরুষের স্তন ক্যানসার খুব রেয়ার তবে লক্ষণ একই।

আরও পড়ুন-জলের পরিবর্তে মদ খান, পরামর্শ বিজেপি সাংসদের!

বয়ঃসীমা
বিদেশে ষাটোর্ধ্ব মহিলাদের মধ্যে স্তন ক্যানসার বেশি হয় কিন্তু এদেশে বা যে কোনও ডেভেলপিং কানট্রিতে অনেকটা আগে স্তন ক্যানসার দেখা দেয়। ৪০ বছরের পর থেকেই স্তন ক্যানসার হয়।
যখনই এটা কমবয়সে হয় তখনই এর রিস্ক ফ্যাক্টর অনেক বেড়ে যায়।
কেন স্তন ক্যানসার বেশি
আমাদের দেশে স্তন ক্যানসারের আক্রান্তরা স্টেজ ওয়ানে খুব কম আসে, মাত্র আট থেকে দশ শতাংশ। বিদেশে তিরিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশের শুধু স্টেজ ওয়ানেই রোগটা ধরা পড়ে যায়, ওরা এতটাই সচেতন। এখানে চট করে কেউ স্তন ক্যানসার নিয়ে ভাবতে চায় না। সচেতনতার অভাব।
খুব খরচসাপেক্ষ চিকিৎসা সঙ্গে সামাজিক ভয় ও চাপ থাকে তাই সহজে কেউ পরীক্ষা করাতে চায় না। লুকিয়ে রাখে। ফলে শেষমুহূর্তে ধরা পড়ে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।
স্তন ক্যানসার কিউরেবল। স্টেজ ওয়ানে ধরা পড়লে ৯৫ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। স্টেজ টুতে ৭০ শতাংশ, স্টেজ থ্রিতে ৫০ শতাংশ, স্টেজ ফোরে সেটা আরও কমে গিয়ে দাঁড়ায় ২০ শতাংশ। কিন্তু ক্যানসার স্ক্রিনিংও এখানে খুব কম, সেলফ এগজামিনেশন অফ ব্রেস্ট বিষয়টা অর্ধেক মহিলা জানেন না বা জানলেও করেন না, ফলত রোগটা হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন-‘যারা স্বচ্ছতার সঙ্গে জিতে কাজ করে এসেছেন মানুষের আশীর্বাদে ফের তারা জয়ী হবেন’ তমলুকে বিজেপিকে নিশানা কুণালের

সেলফ এগজামিনেশন
তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ এর ঊর্ধ্বে পিরিয়ডের সাতদিন পরেই প্রতি মাসে সেলফ ব্রেস্ট এগজামিন জরুরি। কিংবা ক্লিনিক্যাল ব্রেস্ট এগজামিনেশন, যাকে বলা হয় সিবিই। সেটা হল প্রতি দু’বছর অন্তর ফ্যামিলি ফিজিশিয়ানকে দিয়ে পরীক্ষা করানো। বিশেষ করে যাঁদের পরিবারে স্তন ক্যানসারের ইতিহাস আছে, তাঁদের অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা
স্তন ক্যানসারের জন্য ম্যামোগ্রাফি করতে হবে। ৪০-এর পরে প্রতি দু’বছর অন্তর ম্যামোগ্রাফি করা উচিত। আল্ট্রাসাউন্ড ব্রেস্টও খুব কার্যকরী একটি পরীক্ষা।
নিজে সচেতন হোন
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজে স্তনে কোনও লাম্প আছে কি না পরীক্ষা করুন। পিরিয়ডের সাতদিন পর বা যাঁদের মেনোপজ হয়ে গেছে তাঁদের মাসের প্রথম রবিবার ধরে সেলফ এগজামিনেশন করতে হবে। শুয়ে পরীক্ষা করলে কাঁধের তলায় একটা বালিশ রাখুন। ডান হাত দিয়ে বামদিকে স্তন, একইভাবে বাঁহাত দিয়ে ডানদিকের স্তন পরীক্ষা করতে হবে হাতের তালুর সাহায্যে। চেপে চেপে অনুভব করতে হবে কোনও লাম্প আছে কি না। শুধু স্তন নয়, বগলের নিচটাও নিজেকেই পরীক্ষা করতে হবে।

আরও পড়ুন-সৈকতশহর দিঘায় গড়ে উঠবে ওয়াটার পার্ক

চিকিৎসা
স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে সাজার্রি, রেডিথেরাপি, কেমোথেরাপি, হরমোন থেরাপি এই সব ধরনের চিকিৎসাই রয়েছে। এখন আরও উন্নত হয়েছে চিকিৎসা পদ্ধতি। তাই ছোট লাম্প প্রথম স্টেজে ধরা পড়লে ম্যাসটেকটমির পরিবর্তে লাম্পেকটমি করা হয়। তারপর রেডিয়েশন দেওয়া হয়। তবে প্রথম স্টেজে ধরা পড়লে এটা সম্ভব। এখন স্তন ক্যানসার চিকিৎসা অনেক উন্নত।
স্তনের নিচে হৃদযন্ত্র এবং নিচে ফুসফুস সবই থাকে ফলে রেডিয়েশন দেবার সময় ডোজ যাতে বেশি না যায় সেজন্য নানা উন্নত ব্যবস্থা এসেছে যা করলে হার্ট বা লাং সুরক্ষিত থাকে। রোগীকে রেডিয়েশন দেবার পরে এখন একদম বোঝা যায় না যে তার ট্রিটমেন্ট চলছে।
এখন সিম্পল ম্যাসটেকটমি করা হয়। তবে এর কিছু সমস্যা আছে। এটা করার সময় বগলের তলায় অ্যাগজেলরি নোডসগুলো বের করে বাদ দেওয়া হয় এর ফলে হাত ফুলে যায়, লিম্ফিডিমা হবার সম্ভাবনা থাকে, মহিলাদের একটা মানসিক চাপ হয়। তাই আর্লি ধরা পড়া জরুরি। তবে ম্যাসটেকটমি করেও বহুবছর সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকেন।
এখন ব্রেস্ট ক্যানসার চিকিৎসা এতটা উন্নত যে স্টেজ ফোরে ধরা পড়লেও এখন লাইফ স্প্যান বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে।

Latest article