জলের উজ্জ্বল শস্য। বাঙালির ইলিশ। জলের রুপোলি শস্য। ইলিশের বাঙালি। হাতে ইলিশ, পাতে ইলিশ, ভাতে ইলিশ। ঝোলে-ঝালে-অম্বলে প্রাণের ইলিশ। কবিতায়, গানে, গল্পে, উপন্যাসে ইলিশের গুণগান। ইলিশের জয়গানে মুখর বুদ্ধদেব বসু থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। কবিতা ‘ইলিশ’ থেকে উপন্যাস ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ ইলিশে-ইলিশে ছয়লাপ। এই রুপোলি উজ্জ্বল শস্য কোথাও মূল চরিত্র, আবার কোথাও বা গুরুত্বপূর্ণ নেপথ্য শিল্পী। তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা নিয়ে ঘনগৌরবে শ্যামগম্ভীর নবযৌবনার আবির্ভাবে যখন প্রকৃতি আনন্দে মত্ত, যখন গগনে গরজে মেঘ আষাঢ় সন্ধ্যায়, অবিরল ঝমঝম বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা, তখন বাঙালির রসনা জুড়ে ইলিশ।
আরও পড়ুন-অতি-পরীক্ষায় নাকাল ব্যাটিং
যখন শ্রাবণের গগনের গায় বিদ্যুৎ চমকিয়া যায়, যখন নীল-অঞ্জনঘন পুঞ্জছায়ায় সম্বৃত অম্বর, তখন বাঙালি বাতাসে কার আভাস পায়?
বর্ষা এলে বাঙালির পাত থেকে ইলিশ কি দূরে থাকতে পারে? রূপসি ইলিশের সাতকাহন বাঙালির চেয়েও বেশি আর কে জানে? বাঙালির ইলিশপ্রেম আদি, অকৃত্রিম, চিরন্তন। পেটি, গাদা, ল্যাজা, মুড়ো, তেল, কানকো, কাঁটা, ডিম— কোনও কিছুই যে ছাড়া যায় না। এ কি শুধুমাত্র একটা মাছ? বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ নয় কি? শুধু গানে, গল্পে, কবিতায় নয়, ইলিশ মিশে রয়েছে নানা ধরনের সংস্কারেও। যাঁরা ইলিশ ধরেন, পয়লা বৈশাখের দিন তাঁদের ইলিশ খেতেই হবে। ইলিশ ধরতে গেলে বুঝতে হয় জলের মন। চিনতে হয় জলের বিশেষ আঁশটে গন্ধ, দেখতে হয় জলের বদলে যাওয়া রঙ। এমন বলেন পোড় খাওয়া জেলেরা। ইলিশ ভ্রমণপিপাসু। তাই এর আরেক নাম ‘মাইগ্রেটরি ফিশ’। নোনা জলের সাগর এর শ্বশুরবাড়ি। আর মিষ্টি জলের নদী এর বাপের বাড়ি। কৌলিন্যে শ্রেষ্ঠ এই মাছ সাহিত্যিক শংকরের বয়ানে মৎস্যসমাজে একমাত্র উপবীতধারী। এর দু-পিঠে যে দুটো সুতো থাকে, তার নাম পৈতা। আসলে সুন্দরী ইলিশ উপবীতধারী নারী মৎস্য। উল্লেখ্য, অতিরিক্ত চাহিদার চাপে এই মহার্ঘ্য মাছ আজ বিপন্ন।
আরও পড়ুন-জ্বলছে মণিপুর, লজ্জিত-মর্মাহত দেশ, নির্লজ্জ বিজেপি, দিল্লির ‘গুন্ডা’কে তৃণমূলের তোপ
ইলিশ মাছ ধরতে বেরোনোর আগে ধূপধুনো জ্বেলে নৌকায় ওঠেন জেলেরা। জালপুজো করেন। নৌকার গলুইয়ে চিনি-বাতাসা-মিষ্টি দিয়ে তারপর জাল তোলেন। এরপর জালে যখন প্রথম ইলিশটা ওঠে, তখন তাকে একটা থালায় তুলে জালের ওপর রেখে সিঁদুর-হলুদ মাখিয়ে বরণ করা হয়। যেন প্রতিমাবরণ! তারপর মাছের মাঝের খানিকটা অংশ কেটে নৌকার গলুইয়ে পুঁতে ফেলা হয়। এটা পরম্পরাগত আচার। কোনও কোনও জায়গায় আবার অন্য নিয়ম, অন্য আচার। যেমন, মাছের রানিকে আগে প্রদীপ জ্বালিয়ে সিঁদুর মাখিয়ে উলুধ্বনি সহযোগে বরণ করা হয় সরস্বতী পুজোর দিন। তারপর তিনি ঢোকেন হেঁশেলে। এদিন কিন্তু ঝোল-ঝাল-অম্বল রাঁধা বারণ। শুধু নুন, হলুদ আর গোলমরিচ দিয়ে রাঁধা হয় ইলিশের ঝোল। আর মাছের আঁশগুলো পুঁতে দেওয়া হয় ঘরের প্রধান খুঁটির গোড়ায়। অনেকে আবার ধানের গোলার নিচে আঁশ পুঁতে রাখেন। এতে নাকি ভবিষ্যতে ধনসম্পদ বৃদ্ধি হয়। কোথাও আবার এমনও সংস্কার আছে যে, দুর্গাপুজোর দশমীর দিনে ইলিশের ডিম লাগবেই। উনুনের পাশে রেখে সেই ডিম শুকোতে দেওয়া হয় আগে থেকেই। তারপর দশমীর দিন সেই ডিম ভেজে বাড়ির সকলে একসঙ্গে খান। প্রসঙ্গত বলা যাক, ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এটি মূলত একটি সামুদ্রিক মাছ, যা ডিম পাড়ার জন্য বাংলাদেশ ও পূর্ব ভারতের নদীগুলিতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসে। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ওড়িশা, ত্রিপুরা ও অসমে এই মাছ অত্যন্ত জনপ্রিয়। ইলিশ অর্থনৈতিকভাবে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি মাছ। পদ্মার ইলিশ স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয়। এক এক জায়গায় ইলিশের এক এক নাম।
আরও পড়ুন-বন্ধ ইন্টারনেট, যানবাহন প্রায় নেই, শিবির না নরককুণ্ড, ক্ষোভ
‘জাটকা’ অপ্রাপ্তবয়স্ক ইলিশের স্থানীয় নাম। পোলাসা, পাল্লুমাছি, ইলিহি, ইলিশী, মোদেন (স্ত্রী), পালভা (পুরুষ), চাকসি, মুল্লাসু, উল্লাম ইত্যাদি সবই ইলিশের ভিন্ন নাম। হিলসা শ্যাড ও আলোস হিলসা ইলিশের আন্তর্জাতিক পরিচিতি। ছোট ইলিশের নাম খোকা ইলিশ। ফ্যাস, খাপতা, মুখপোড়া এগুলোও ইলিশের নাম। জোড়া ইলিশ শুভ লক্ষণের প্রতীক। ইষ্টবেঙ্গল ক্লাব ডার্বি অথবা কোনও ফুটবল টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হলে বাজারে ইলিশের দাম বেড়ে যায়। খাদ্যরসিক বাঙালির কাছে ইলিশ আবেগের অন্য নাম। এক দারুণ সুখকর অনুভূতি।
সর্ষে-ইলিশের স্বাদ স্বর্গীয়। ইলিশ-পাতুরি অসামান্য। কচু ইলিশে জিভে জল। ইলিশ ভাজার গন্ধে মরা মানুষ উঠে বসে। ভাজা, ঝোল, ঝাল, ভাপা, টক ইত্যাদি অসংখ্য রসনা রসসিক্ত করা পদের উৎস এই মাছ। গরম ভাতে নুন ও লঙ্কার সঙ্গে ইলিশের মহার্ঘ্য তেলের অমৃত স্বাদে যাঁরা বঞ্চিত তাঁদের জন্য বাঙালির দীর্ঘশ্বাস অফুরান।
আরও পড়ুন-রাশিয়াতেই দেখা মিলল ওয়াগনার প্রধান প্রিগোজিনের
খিচুড়ি আর ইলিশ? পান্তা ভাতে ইলিশ? ওঃ, সমস্ত সংযম যেন লাফিয়ে পড়ে ফুটন্ত কড়াইয়ে।
সর্ষেবাটা, পোস্তবাটা, কালোজিরা, বেগুন, আলু, নারকেল, শুকনো লঙ্কা, কাঁচালঙ্কা, আদা, গোলমরিচ ইলিশের পদগুলোকে উৎকৃষ্ট থেকে উৎকৃষ্টতর করে তোলার জরুরি উপাদান। এসব জানেন মহার্ঘ্য ব্যঞ্জনরাঁধুনিরা। শুধু কি স্বাদ আর গন্ধ? ইলিশের পুষ্টিগুণ অপরিসীম।
মানবদেহের ইনসুলিন স্তরকে সুরক্ষিত রাখা থেকে শুরু করে কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করা এই মাছ হার্টকেও সুস্থ রাখে।
আরও পড়ুন-বাতাসে আর্দ্রতার প্রকোপ ৪৮ ঘণ্টায় ৬ জেলায় ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস
পদ্মায় তিন রকম ইলিশ পাওয়া যায়। পদ্ম, চন্দনা বা চান্দিনা এবং গুর্তা ইলিশ। পদ্মের পিঠ সবজে রঙের। চন্দনার পিঠ কালচে, গায়ে উজ্জ্বল আঁশ এবং এরা আকারে ছোট। গুর্তার গায়ে কাঁটা থাকে। গঙ্গায় মেলে খোকা ও বড় ইলিশ। ভাদ্র মাসে দুই নদীরই ইলিশের পেটে ডিম পাওয়া যায়। প্রায় ৫০ রকমের রন্ধনপ্রণালী আছে মূল্যবান এই মাছের। এর টক হয় দুর্দান্ত। দই-ইলিশ না খেলে নাকি জীবনটাই বৃথা। ইলিশের তেলঝাল না খেলে নাকি বোঝাই যেত না যে, স্বর্গ অন্য কোথাও নয়, আছে এই পৃথিবীতেই। মধ্যযুগের কবিরা মঙ্গলকাব্য-সহ বিভিন্ন কাব্যে বারবার ইলিশের প্রসঙ্গ এনেছেন। মাছের রাজা নিঃসন্দেহে ইলিশ। মিষ্টি জলের ইলিশের স্বাদ অনন্য। ইলিশসংস্কৃতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের খাদ্যসংস্কৃতি থেকে পৃথক করেছে গর্বের বাঙালিয়ানাকে। স্বাস্থ্যরক্ষায় জুড়ি নেই এই মাছের। চোখ, ফুসফুস ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে, বাতের ব্যথা উপশমে, অবসাদ ও দুর্বলতার মোকাবিলায় এবং শিশুদের হাঁপানি রোধে ইলিশের চেয়ে উপকারী আর কোনও মাছের নাম করা যাবে না।
ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল কাব্যে রয়েছেন মাছের রানি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও জীবনানন্দ ইলিশ নিয়ে কোনও কবিতা না লিখলেও ইলিশের নানা পদ তাঁদের ভীষণ প্রিয় ছিল।
আরও পড়ুন-সুনীলদের নিয়ে জট খোলার চেষ্টায় ফেডারেশন
‘রাত্রিশেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে জলের উজ্জ্বল শস্য রাশি-রাশি ইলিশের শব, নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।’ এই বর্ণনা বুদ্ধদেব বসুর। আবার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বর্ষার মাঝামাঝি, পদ্মায় ইলিশ ধরার মরশুম চলিয়াছে। দিবারাত্রি কোনো সময়েই মাছ ধরিবার কামাই নাই। … নৌকার খোল ভরিয়া জমিতে থাকে মৃত সাদা ইলিশ মাছ। লণ্ঠনের আলোয় মাছের আঁশ চকচক করে, মাছের নিস্পলক চোখগুলিকে স্বচ্ছ নীলাভ মণির মতো দেখায়।’
আরও পড়ুন-৬ যাত্রীর মৃত্যু দুই বাসের সংঘর্ষে
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ছড়ায় ছড়ানো ইলিশের ছড়াছড়ি। ইলিশ-বন্দনায় মেতেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, প্রমথনাথ বিশী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং আরও অনেক কবি-সাহিত্যিক। ‘বেহেশতের খাবারের বর্ণনায় যদি ইলিশের উল্লেখ থাকতো তাহলে কেউই পাপ ক’রে নরকে যেতো না’, বলেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী। গোপাল ভাঁড় ও নাসিরউদ্দিন মিঞার গল্পকথা ইলিশগন্ধী। ঢাকার রাস্তায় গভীর রাতে একা-একা ঘুরতে গিয়ে টহলদার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া থেকে বাঁচতে কবি নির্মলেন্দু গুণ তাৎক্ষণিক ছড়া কেটে পুলিশের প্রসংসা করে বেঁচে যান : ‘মাছের রাজা ইলিশ, মানুষের রাজা পুলিশ!’
আরও পড়ুন-সুনীলদের নিয়ে জট খোলার চেষ্টায় ফেডারেশন
বেশিরভাগ বাড়িতে রান্নার দায়িত্বে থাকেন মহিলারা। তাঁদেরও বিশেষ পছন্দ ইলিশ। শুধু খেতে নয়, ইলিশের বিভিন্ন পদ রেঁধে সবাইকে খাওয়াতে তাঁরা ভালবাসেন। আর এই রান্না করার সূত্র ধরেই তৈরি হয়েছে একের পর এক লোকগান। সেগুলি গেয়েওছেন তাঁরাই। জিভে জল আনা ইলিশের হাতছানি এইসব গানের পরতে পরতে।
আরও পড়ুন-মোহনবাগান দিবসে প্রাপ্তি সুব্রতর আত্মজীবনী
‘ইলিশ মাছ গা ধুই নিল ম্যাঘনা নদীর কুলে, ম্যাঘনা নদী ভাইস্যা গেল ইলিশ্যারো ত্যালে’। এটা নোয়াখালির গান। এবার ভানুমতি দিদির গান : ‘ইলিশ মাছগা ভাজিল বৌ থুইল নিজ ঘরে, একখান দুইখান তিনখান কইরা গালে ছুইরা মারে’। ইলিশ নিয়ে লোকগান অন্তহীন। ‘ইলিশ উঠিয়া বলে খইলসা রে ভাই, তুমি থাকো খালে বিলে আমি উজান বাই।’
‘ইলিশ মাছগা কুটে লো বউ পেটির দিকে চায়, আহারে ইলিশার পেডি কার পাতে যায়।’
বাঙালি ইলিশে থাকে, ইলিশে বাঁচে। আবহমান বাংলার চিরন্তন ভালবাসার ইলিশকথা অমৃতসমান।