শুরুর কথা
স্ত্রীর নাম যদিও লক্ষ্মী, তবু আচরণে সে অলক্ষ্মী। ঘরের কোনও কাজ করে না। খায়দায় আর কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমোয়। স্বামীর সঙ্গে নিত্য ঝামেলা লেগেই আছে। স্বামী উদাস ঘরে ফেরার নাম পর্যন্ত করে না। শ্বশুরের কাছ থেকে বাস গাড়ি চালানোর সুবিধা নিতে গিয়ে লক্ষ্মীকে বিয়ে করতে হয়েছে উদাসকে। কিন্তু লক্ষ্মী ঘর করার মেয়ে নয়। স্বামীর মন পড়ে থাকে বিয়ের আগের প্রেমিকা পদ্মের জন্য। এ কথা লক্ষ্মীর অজানা নয়। একদিন এদের দু’জনকে হাতেনাতে ধরেও ফেলে লক্ষ্মী। স্বামী যখন মনের আনন্দে জলকেলিরতা পদ্মাকে নিয়ে গাইছে— ‘দেখুক পাড়াপড়শিতে কেমন মাছ গেঁথেছি বঁড়শিতে।’ সেদিন রাত্রে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তুলকালাম কাণ্ড। লক্ষ্মী খুন করতে ছোটে পদ্মকে। কাটারির কোপে খুনোখুনি হয়ে যায়। পাঠকেরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরে গেছেন প্রাসঙ্গিকতায় কোন ছবির কথা বলেছি। ঠিকই ধরেছেন। ছবির নাম ‘বনপলাশীর পদাবলি’। শিল্পী সংসদ প্রযোজক। শিল্পী সংসদেরই প্রথম সভাপতি উত্তমকুমার এই ছবির পরিচালক। তিনি উদাস চরিত্রের শিল্পী। পদ্ম চরিত্রে সুপ্রিয়া দেবী। কিন্তু সবার নজর কাড়লেন লক্ষ্মী চরিত্রের শিল্পী বাসবী নন্দী। দজ্জাল বদমেজাজি রুক্ষ কঠিন চরিত্রকে কীভাবে বাস্তবায়িত করতে হয় তা বাসবী দেখালেন। ছবিটির যখন নির্মাণপর্ব চলছে তখন শিল্পী সংসদের অনেকেই লক্ষ্মী চরিত্রে বাসবী নন্দীকে নিতে মানা করেছিলেন। কিন্তু বাসবীর উপর ভরসা ছিল উত্তমকুমারের। বাসবী তাঁর দাপুটে অভিনয় দিয়ে তা প্রমাণিত করে দিয়েছেন। বাসবী এমন খলচরিত্রে সাবলীল অভিনয় করেছেন ‘আমি সিরাজের বেগম’ ছবিতে। সেখানে তিনি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশীদার হিসেবে চমৎকার অভিনয় করেছেন। ‘সেই চোখ’ ছবিতে তিনি খল চরিত্রে। নতুবা নিজের স্বার্থে অল্পবয়সি মহুয়া রায়চৌধুরীর সঙ্গে তিনি প্রায় প্রৌঢ় উত্তমকুমারের বিয়ে দিতে চান।
আরও পড়ুন-মাটির মানুষ রশিদ
ঘর ভাঙার কারিগর
৭০-এর দশকে আরেক স্মরণীয় খলনায়িকা সুলতা চৌধুরী। ছবির জগতে এসেছিলেন নায়িকা হিসেবে। পরে খলনায়িকায় বেশি কদর পেলেন। এমন সব চরিত্রে প্রায় স্বল্পবাস পরা অবস্থাতে অভিনয় করেছেন। ‘বাঘ বন্দী খেলা’য় মদ্যপ চরিত্রহীন ভবেন্দুরূপী উত্তমকুমার যেভাবে স্বল্পবাস পরিহিতা সুলতাকে নিয়ে গান করেন ‘আয় আয় আসমানী কবুতর’, তখন সুলতার অঙ্গভঙ্গি কটাক্ষ নজর কাড়ে। একই কথা প্রযোজ্য কায়াহীনের কাহিনী, সন্ন্যাসী রাজা, স্বয়ংসিদ্ধা, সংসার সীমান্তে, ফুলেশ্বরী প্রভৃতি ছবিতেও।
পিছু ফিরে দেখা যাক
পঞ্চাশের দশকের স্মরণীয় অভিনেত্রী রেণুকা রায়। ছবিতে এসেছিলেন নায়িকা হিসেবে। পরে দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন খলচরিত্রের জন্য। রেণুকা রায় পর্দাতে আবির্ভূত হলেই দর্শকরা বুঝতে পারতেন পারিবারিক শান্তির পরিবেশকে বিষিয়ে তুলতে তিনি এসেছেন। ‘মেজদিদি’ ছবির কথাই ধরা যাক। দজ্জাল বড় জা তিনি। তার বৈমাত্রেয় ভাই কেষ্টকে নিয়ে মেজজায়ের আদিখ্যেতা চক্ষুশূল হলো বড় জা’র কাছে। সেই নিয়েই চাপানউতোর। ‘চন্দ্রনাথ’ ছবিতে সরযূর (সুচিত্রা সেন) মা (চন্দ্রাবতী দেবী) অসতী খবর জেনে যেভাবে মেজো কাকিমা হিসেবে রেণুকা রায় চন্দ্রনাথের (উত্তমকুমার) সংসার থেকে সরযূকে বিদায় করলেন, সেটাই বিস্ময়ের সঙ্গে দেখার। ‘শেষ অঙ্ক’ ছবিতে মিথ্যুক খ্রিস্টান লজ মালিকের চরিত্রে রেণুকা চমকে দিয়েছেন।
আরও পড়ুন-হুথি জঙ্গিদের উপর আমেরিকা-ব্রিটেনের ক্ষেপণাস্ত্র হানা, হত ৫
রাশভারী চরিত্রের শিল্পীরা
নানান ধরনের চরিত্রে ছায়া দেবী অভিনয় করলেও রাশভারী নির্মম ক্ষমাহীন দাপুটে চরিত্রগুলিতে ছায়া দেবীর নিজেকে নিখুঁতভাবে মেলে ধরেছিলেন। ‘সাত পাকে বাঁধা’য় স্বামী সুখেন্দু (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) ও স্ত্রী অর্চনার (সুচিত্রা সেন) সুখের সংসার ভাঙনের কারিগর অর্চনার মা-রূপী ছায়াদেবী। ‘মেঘ কালো’ ছবিতে কন্যার সুখের জন্য নির্মাল্য (সুচিত্রা সেন) এবং খুড়শাশুড়িকে (মলিনা দেবী) চূড়ান্ত অপমান করতে দ্বিধাগ্রস্ত হন ছায়া দেবী। ‘থানা থেকে আসছি’ ছবির নায়িকার (মাধবী মুখোপাধ্যায়) অকালমৃত্যুর কারণ সমাজসেবী সংস্থার কর্মচারীর চরিত্রের শিল্পী ছায়াদেবী। সমাধান, করুণাময়ী, মান অভিমান, সুবর্ণলতা, ন্যায় অন্যায় তেমন আরও কিছু ছবি। ‘দেবদাস’ ছবিতে চন্দ্রমুখী চরিত্রে চন্দ্রাবতী দেবীর অভিনয় দেখে শরৎচন্দ্র মুগ্ধ হয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে দাম্ভিক অসহিষ্ণু চরিত্রে তিনি জমিয়ে দিতেন ‘পুত্রবধূ’ ছবিতে পুত্রবধূ-রূপী মালা সিনহাকে সহ্য করতে পারতেন না। প্রতিশ্রুতি ছবিতে তিনি এক পসারিণী গণিকা। যিনি ঘর ভাঙতে জানেন।
আরও পড়ুন-নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে কেন বাদ প্রধান বিচারপতি?
মঞ্জু দে-র কথা
মঞ্জু দে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন খলচরিত্রে। তিনি নজর কাড়েন ‘রত্নদীপ’ ছবিতে। বাইজি হয়ে তিনি আবিষ্কার করেন জমিদার হয়ে যিনি এসেছেন তিনি নকল। ‘লৌহকপাট’ ছবিতে তিনি কাশিম ফকিরের (কালী বন্দ্যোপাধ্যায়) স্ত্রী কুট্টিবিবি, যাঁরা ধর্মান্ধতার সুযোগে মানুষের মৃত্যুর পথ দেখিয়ে দেন। পরে একে একে পরেশ, তীরভূমি, অর্পিতা, পরিশোধ, পথের শেষে প্রভৃতি ছবিতেও সেই ধারাবাহিকতা তিনি বজায় রেখেছিলেন।
গীতা দে ও অন্যদের কথা
গীতা দে যতটুকু সময় পর্দায় থাকতেন, ততটুকু সময় নানান ষড়যন্ত্র কূটকৌশলের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন। স্বয়ংসিদ্ধা, জয়া, অভয়া শ্রীকান্ত, বড় বউ, শাস্তি, বন্দি বলাকা, কৃষ্ণ সুদামা প্রভৃতি ছবিগুলি তার প্রমাণ। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে বেশ কিছু অভিনেত্রী মনে দাগ কেটেছিলেন খলচরিত্রে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন কাজরী গুহ (দীপ জ্বেলে যাই, হারানো সুর), নমিতা সিংহ (সাগরিকা, সোনার হরিণ, গঙ্গা), নীলিমা দাস (বিন্দুর ছেলে, কাল তুমি আলেয়া, আঁধারে আলো), জয়শ্রী সেন (সবার উপরে)। সত্তরের দশকের গোড়ায় প্রথমেই নজর কাড়লেন কণিকা মজুমদার (হার মানা হার, দুটি মন, বিলম্বিতলয়, সোনার খাঁচা)। একে একে এলেন ললিতা চট্টোপাধ্যায় (মোমের আলো, মুক্তিস্নান, জয়জয়ন্তী), জোৎস্না বিশ্বাস (মঞ্জুরি অপেরা, তাপসী), দীপিকা দাস (বালুচরি), শমিতা বিশ্বাস (আলোর ঠিকানা, হোটেল স্নো ফক্স), সুব্রতা চট্টোপাধ্যায় (মেঘ কালো, সংসার, বিষবৃক্ষ, অভাগিনী) সবিতা চট্টোপাধ্যায় (শ্রেয়সী, দাদু)।
আরও পড়ুন-উদ্বোধনের দিনই জমজমাট বাংলার সংস্কৃতি ও প্রকৃতি উৎসব
আশির দশকের শিল্পীরা
আশির দশকে এলেন একঝাঁক নতুন অভিনেত্রী যাঁরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খল। চড়া মেকআপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চড়ামাত্রার অভিনয়। সে-তালিকায় প্রথম নাম সংঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (বৌমা, ছোট বউ, পরশমণি, বিধিলিপি, শতরূপা, স্ত্রীর মর্যাদা, চৌধুরী পরিবার)। রত্না ঘোষাল কি কম যান (ছোট বউ, সাহেব, বাবুমশাই, বড় ভাই)? রাজেশ্বরী রায়চৌধুরী খলচরিত্রে বরাবর দুরন্ত (বিধিলিপি, আঘাত, ঊর্বশী, ব্যবধান)। শকুন্তলা বড়ুয়াও এমন চরিত্রে খুবই দাপুটে (যোগ-বিয়োগ, নয়নমণি, সাহেব)। একটু বেশি বয়সে এসেও আসামাত্র দর্শকদের নজর কাড়লেন মীনাক্ষী গোস্বামী। ‘ওগো বধূ সুন্দরী’তে তিনি লোলা বোস। সেই ধারাতেই পেলাম ছোট বউ, শ্বেতপাথরের থালা, স্ত্রীর মর্যাদা, চৌধুরী পরিবার, মায়া মমতা প্রভৃতি ছবি। রীতা কয়রাল দজ্জাল চরিত্রে সর্বদাই স্বতঃস্ফূর্ত (লাঠি, পূজা, বড় বউ, সন্তান)। এ ছাড়াও আছেন পাপিয়া অধিকারী, লকেট চট্টোপাধ্যায়, গীতা নাগ, কেতকী দত্ত প্রমুখ অভিনেত্রী।
আরও পড়ুন-স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরিতে ‘ডবল ইঞ্জিন’ রাজ্যগুলিকে পিছনে ফেলে দেশের সেরা বাংলা
অনামিকা সাহার কথা
এই পর্যায়ে ভিলেন চরিত্রে বর্তমানে সর্বশ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় অভিনেত্রী হলেন অনামিকা সাহা। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে শয়তান, নীলিমায় নীল, নাচ নাগিনী নাচ, সেজ বউ, খেলার পুতুল, অশ্লীলতার দায়ের মতো জনপ্রিয় সব ছবি। কিন্তু যে ছবির জন্য তিনি গব্বর সিং-এর মতো জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন সেই ছবির নাম ‘ঘাতক’। স্বপন সাহার ছবি। সেখানে তাঁর চরিত্রের নাম বিন্দু মাসি, যিনি তরোয়াল দিয়ে মানুষের গলাও কেটে ফেলতে পারেন অনায়াসে। আতঙ্কে শিউরে উঠতেন দর্শকেরা।
শিল্পীর নিজস্ব স্বীকারোক্তি হল এই যে তিনি যখন বিভিন্ন জায়গায় অর্থাৎ মেদিনীপুর, নদিয়া বা বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান করতে গিয়েছেন তখন দর্শকেরা তাঁকে অনামিকাদি, অনামিকামাসি বা অনামিকা কাকিমা বলেননি। সবাই বলেছেন ‘বিন্দু মাসি’। বাচ্চাদের ভয় পাড়িয়ে দেওয়া হত— ‘এই বিন্দুমাসি আসছে’ বলে। এটা শিল্পী হিসেবে যে তাঁর বিরাট স্বীকৃতি, তা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
নায়িকারাও যখন খলচরিত্রে
দেখা গেছে নামকরা নায়িকারাও কখনও কখনও দজ্জাল বা কূটচরিত্রে নিজেদের অন্যরকমের অভিনয় প্রতিভার পরিচয় দিয়ে গিয়েছেন। সর্বাগ্রে সুপ্রিয়া দেবী। ‘লাল পাথর’ ছবিতে হেমদাকান্ত (উত্তমকুমার) মাধুরীকে (সুপ্রিয়া দেবী) নিয়ে এলেন নিজের কাছে, সেই মাধুরীর ঈর্ষার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল হেমদাকান্তের বৈবাহিক জীবন। পরবর্তীকালে সুপ্রিয়া কড়ি দিয়ে কিনলাম, মিত্তির বাড়ির ছোট বউ প্রভৃতি ছবিতে দজ্জাল শাশুড়ির চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন। আরেক নায়িকা আরতি ভট্টাচার্য। ভ্যাম্পহিরোইন হিসেবে আমি সে ও সখা, জন অরণ্যে, প্রতিশ্রুতি ছবিতে তাঁর অভিনয় দাগ কেটেছে। উত্তমের বিপরীতে ‘বিকালে ভোরের ফুল’ ছবিতে যে সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় এলেন পরে তিনি খল চরিত্রে নজর কাড়লেন ‘শঠে শাঠ্যং’ ছবি-সহ অনেকগুলি ছবিতে।
আরও পড়ুন-ভোট বাড়ানো লক্ষ্য শতাব্দীর
পুনশ্চ
বর্তমান ছবিতে খল-অভিনেত্রীদের তেমন গুরুত্ব নেই। মনে দাগ কাটার মতো অবকাশও নেই। সেটা একচেটিয়া হয়ে গেছে ধারাবাহিকের ক্ষেত্রে। প্রতিটি সিরিয়ালে একঝাঁক খল-চরিত্রের শিল্পী। তাঁরাই সিরিয়ালের টিআরপি বাড়িয়ে চলেছেন। তাই ছবির জগতে খলনায়কের প্রাচুর্য থাকলেও খল-অভিনেত্রীর ভাটা পড়েছে।