বাঙালি জাতির নিজস্বতা কী? ইলিশ খাওয়া? ইলিশ খাওয়ার আর্থিক বল ভারতের খুব কম শতাংশ বাঙালির আছে। তাহলে কি মাছ খাওয়া? মাথাপিছু বাঙালির থেকে বেশি মাছ খায় বিশ্বের অনেক জাতি। তাহলে কি ধুতি পরা? খুব কম শতাংশ বাঙালি ধুতি পরে। তাহলে কি লুঙ্গি পরা? বঙ্গোপসাগর-তটস্থ যে-সকল জাতি লুঙ্গি পরে, অর্থাৎ তামিল, তেলুগু, বাঙালি, বর্মি, থাই, মালয় ইত্যাদি জাতির মধ্যে বাঙালি সর্ববৃহৎ হলেও লুঙ্গি বিষয়টি শুধু বাঙালির নয়— এটি বিস্তীর্ণ এলাকার। তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ-চর্চা? রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ পাওয়ার বছরে অর্থাৎ ১৯১৩ সালে বাঙালি জাতির সাক্ষরতার হার ছিল ১০%-এর কম আর সাক্ষরদের মধ্যে সাহিত্যচর্চাকারীরা যতই বেশি সংখ্যক হোক, বাঙালি জাতির মধ্যে তারা অনুপাতে নগণ্য। আচ্ছা, তাহলে কাঁচালঙ্কা দিয়ে ঘি-দেওয়া আলুভাতে খাওয়া— এটাকে কি বাঙালি জাতির ন্যূনতম নিজস্বতা বলতে পারি? এই শেষ প্রশ্নটার উত্তরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় বাঙালি জাতি কীভাবে আত্তীকরণ করেছে, সেই প্রশ্ন।
আরও পড়ুন-বাঙালির ব্যবসা স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ
বাঙালি জাতির নিজস্বতা হল বাঙালি জাতির ভাষা। সেটা ভাষার মহিমা নয়, সে ভাষা যে আমাদের, আমাদের মায়ের, বাপের। সংস্কৃতি বা কৃষ্টি হল ইহজগতে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতি, জ্ঞান ও দৈবের আচরণের পদ্ধতি যা আমরা উত্তরাধিকারে পাই এবং ইহজীবনে তার উপর নিজস্বতার ছাপ ফেলতে থাকি কারণ জগৎ এবং ফলত মানুষ বদলায়। মাতৃভাষা হল সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্কের মূল ভিত্তি। ধরা যাক খাবার। খাদ্য-সংস্কৃতি যেমন উত্তরাধিকারে পাওয়া, তেমনই ইহজীবনে পরিবর্তনশীল। যখন বাংলায় প্রথম আলু এসেছিল পর্তুগিজদের হাত ধরে, আমরা কিন্তু বাঙালি হিসেবে আমাদের খাদ্য-সংস্কৃতির উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে তার সঙ্গে দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক গড়েছি। এর ফলাফল হল আলুভিত্তিক খাবার বলতে আমরা যা বুঝি। আবার মার্কিনিরা তাদের উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে আলুভিত্তিক খাবার বলতে যা বোঝে তা একইসঙ্গে এক ও ভিন্ন। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও আলুভাজা, দুই আলু অর্থাৎ এক এবং দুটো ভিন্ন। আলুভাজার জাতি যখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খায় প্রথমবার, সে তার উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে ও নিক্তিতে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইকে খায়। খাওয়ামাত্র তার সংস্কৃতি বদলায়।
আরও পড়ুন-বিশ্ববাসীর মঙ্গল কামনায় কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিলেন মুখ্যমন্ত্রী
উত্তরাধিকারে এই দেওয়া-নেওয়া যুক্ত হয়। ভাষা স্বজাতির সঙ্গে আমাদের স্রেফ মনোভাব প্রকাশের বা কথা বলার সম্পর্ক শুধু নয়, আমাদের বস্তুগত জগৎ ও চেতনা, যা একইসঙ্গে স্বজাতির যৌথ জগৎ ও চেতনার অংশ তার সঙ্গে আমাদের সংযোগ এবং একইসঙ্গে নিজস্বতার মাধ্যমে সেই যৌথ উত্তরাধিকারে নিজ যোগদানের ভিত্তি। ভাষা ও সংস্কৃতি অতএব সাংঘর্ষিক নয়, বরং নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত এবং পরিবর্তনশীল জগতে একে অপরের হাত ধরে পরিবর্তনশীল। ১০০০ বছর আগে বাংলায় আলু ছিল না। দক্ষিণ আমেরিকার উপনিবেশ থেকে পর্তুগিজরা এনেছিল। কিন্তু আলুভাতের স্বাদ, প্রণালী, স্মৃতি— বাংলার, বাঙালির। ফুটবল ইংরেজরা এনেছিল, কিন্তু ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের উত্তেজনা বাংলার, বাঙালির। নিজ জাতির উত্তরাধিকারের শর্তে ও ভিত্তিতে গড়া স্বাদ ও চেতনা।
আরও পড়ুন-অধ্যক্ষের নিশানায় বিচারপতি!
তাহলে চিরাচরিত নিজস্বতা সন্ধানের বাইরে আবার এই প্রশ্নটা রাখি— বাঙালির নিজস্বতা কী? এই প্রশ্ন আলোচনা করতে হলে প্রথম যেটা বোঝা উচিত— সকল জাতিতেই মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে। বাঙালি বিশ্বে কোনও অনন্য জাতি নয়। পৃথিবীতে নানা জাতির একটি বাঙালি। চিনা, ইঙ্গ-মার্কিন, হিন্দুস্তানির পর বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম জাতি তথা ভারতে দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি হল বাঙালি জাতি। পৃথিবীতে নানা জাতির যে-যে জিনিস নিজস্ব হওয়া বাধ্যতামূলক সেই জাতির নিজ অস্তিত্বের জন্য, সেই-সেই জিনিস ভারতেও বাঙালির নিজস্ব হবে, এটা আদর্শ অবস্থা। কী সেই জিনিসগুলি? প্রথমত, ভারতে বাঙালি জাতির নিজস্ব আবাদভূমি বা হোমল্যান্ড। এবং সেই আবাদভূমি বা হোমল্যান্ডের পুঁজি, বাজার, চাকরি, জমি, জনপ্রতিনিধিত্বের ওপর নিরঙ্কুশ আধিপত্য অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-নিরাপত্তা ব্যবস্থার উপর বাঙালির পূর্ণ আধিপত্য তথা মালিকানা।
আরও পড়ুন-নৈতিক আচার্য হলেন মুখ্যমন্ত্রীই, হয় সই করুন নইলে বিল ফের পাশ করাব, সাফ কথা ব্রাত্যর
কোনও জাতির অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে নিজ এলাকায় থাকা সকল মানবসম্পদ, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং পরিকাঠামো— সব মিলিয়ে জাতির সম্পদ অর্থাৎ জাতীয় সম্পদ। জাতির মানবসম্পদ বলতে প্রবাসী-সহ জাতির সকল পেশিশক্তি, মেধাশক্তি, লোকবল, কারিগরি, কৃষিশৈলী, গায়ক, বাদক, লেখক-সহ কৃষ্টির ধারক, সাধক, বিজ্ঞান-স্বাস্থ্য-শিক্ষা-রক্ষাকর্মী-সহ সব দক্ষ ও কর্মঠ মানুষ। জাতির প্রাকৃতিক সম্পদ বলতে জাতির নিজ আবাদভূমি/এলাকার সকল ফসল, ফুল, ফল, বন, নদী, পুকুর, পাহাড়, সাগর, কয়লা, তেল-সহ সব খনি, প্রাণী, মাটি, বায়ু, আকাশ, সূর্যালোক, ভৌগোলিক অবস্থান— যেমন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির ক্ষেত্রে কয়লাখনি, তিস্তা নদী থেকে রেডিও, ডেটা স্পেকট্রাম, ধান, চা, পাট থেকে সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর ইত্যাদি— বাংলার জল ও স্থলের উপরে যতদূর মহাকাশে এবং বাংলার মাটির নিচে— পৃথিবীর কেন্দ্র অবধি। পরিকাঠামো বলতে ঘর, বাড়ি, রাস্তা, রেললাইন, রেলস্টেশন, সমুদ্রবন্দর, নদীবন্দর, বিমানবন্দর, কারখানা, সেতু ইত্যাদি অর্থাৎ বাংলার মাটিতে মানুষের তৈরি সবকিছু। স্বাভাবিকভাবে জাতীয় সম্পদের উপর সেই জাতির মালিকানা থাকে। সাম্রাজ্যবাদী শাসন তথা বহিরাগত আগ্রাসনে জাতীয় সম্পদ জাতির হাত থেকে বেদখল হয়ে যায়।
আরও পড়ুন-নতুন দার্জিলিং গড়ার ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর
ভারতে বাঙালি জাতির যা স্বাভাবিক জাতীয় সম্পদ, সেটাই বাঙালি জাতির পুঁজির ভিত্তি। যা কিছু আমরা আপাতভাবে বাঙালি জাতির বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলে ভেবে থাকি, যেমন সংস্কৃতি, মেধা— সবকিছুই পুঁজির সাগরে ভেসে থাকা ফেনা। সাগরে যত ঢেউ কম, অর্থাৎ বাঙালি জাতির পুঁজিবৃদ্ধি যত কম বা সাগরে জল যত কম, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের মোট পুঁজির মধ্যে বাঙালির কাছে থাকা অংশের অনুপাত যত কম, তত কম বলশালী বাঙালির সংস্কৃতি, বাঙালির মেধা, বাঙালির সৃজনশীলতা— সবকিছু। নিজ রাজ্যে পুঁজির উপর মালিকানা-ছাড়া হাওয়ায় কিছুই হয় না। যে জাতির নিজ মালিকানায় যত বেশি কিছু, তত বেশি সম্ভাবনা সে জাতির মালিকানাধীন নিজ জিনিসগুলির নিজস্ব চরিত্র পাওয়া। এটাই রাজ্যে কোনও জাতির নিজস্বতা। ভারতে বাঙালি জাতি আজ নিজস্বতা হারাচ্ছে কারণ ভারতে বাঙালি জাতির স্বাভাবিক জাতীয় সম্পদ অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের উপরোক্ত সবকিছু থেকেই বাঙালিকে ক্রমে বেদখল করা হচ্ছে। এ-প্রক্রিয়া বহু দশকের।
আরও পড়ুন-রাজ্যপালের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন প্রসঙ্গে কী বলছেন শিক্ষামন্ত্রী?
কিন্তু বাংলা ও বাঙালির শত্রু হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী বিজেপির দিল্লি-কেন্দ্রের শাসনামলের বিশেষ বর্শাফলা ও পশ্চিমবঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে জনবিন্যাস বদলে শহরাঞ্চল-শিল্পাঞ্চলগুলি থেকে বাঙালির বিতাড়িত হওয়ার যৌথ প্রক্রিয়ায় এই সময়ে যা ভারতে বাঙালির অস্তিত্বের সংকটের বিষয় হিসেবে দেখা দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বাঙালির থেকে অনেক কিছু দখল করেছে বহিরাগতরা। সেটা অন্যায়। দখল হয়ে যাওয়া সবকিছু যেন-তেন-প্রকারেণ পুনর্দখল করা, অর্থাৎ বাঙালির মালিকানায় তথা নিয়ন্ত্রণে ফেরত আনা, সেটাই ন্যায়। সেই ন্যায়ের উপর রাষ্ট্রশক্তির সিলমোহরের নাম আইন। ভারতে বাঙালি জাতির নিজস্বতা পুনরুদ্ধার ও রক্ষার সেই আইনের নাম ভূমিপুত্র সংরক্ষণ— বেসরকারি কাজে, ট্রেড লাইসেন্সে, টেন্ডারে, অটো লাইনে, টোটো লাইনে, হকারি স্পটে— সবকিছুতে। সাদা-কালো, কালো-ধূসর, ঠিক-বেঠিক, সোজা-বাঁকা— সবকিছুতে। যা বাংলার, তা বাঙালির। যা বাংলার, তা বাঙালির নিজস্ব। যা বাঙালির নিজস্ব, সেটাই সেই চাষজমি যার উপরে ফলানো ফসলকে আমরা বলি বাঙালির নিজস্বতা।