লেখা আঁকা মিলিয়ে তিনি এক অন্য ধারার রচক। সেই ধারা সারল্য আর সাবলীলতার ঐশ্বর্যে এতদিন ধরে ঘিরে রেখেছিল বাঙালি শিশুমনের আকাশ। সেই ধারার স্রষ্টার জীবনে এবার পূর্ণচ্ছেদ পড়ল। কিন্তু উত্তরসূরি এখনও অমিল। লিখছেন অধ্যাপক অভীক মজুমদার
নারায়ণ দেবনাথ বাঙালির ছেলেবেলার একান্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাহিত্যিক। তিনি বাঙালির ছেলেবেলার বহু মুহূর্তকে, কিশোরবেলার অভিজ্ঞতাকে আশ্চর্য সংবেদন দিয়ে ছবিতে গল্পে রূপান্তরিত করেছেন।
নারায়ণ দেবনাথ ‘কার্টুন কমিকসের স্রষ্টা’-ই ছিলেন তা নয়, তাঁর বহুমাত্রিক ভূমিকা একজন শিশু সাহিত্যিকের থেকেও বেশি ছিল। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। এ কথাটা বলার পেছনে একাধিক কারণ আছে।
আরও পড়ুন-কার্টুনিস্ট নন, শিশু সাহিত্যিক
এক, নারায়ণ দেবনাথ শুধুমাত্র কিছু কাহিনি তুলে আনেননি তার চিত্ররূপও নির্মাণ করেছেন। সেই চিত্ররূপগুলি মন দিয়ে দেখলে বোঝা যায় প্রবহমান বাঙালি জীবনের ছোট ছোট অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, দৃশ্যকল্প ঢুকে পড়েছে তাতে। আর সেই সুতো ধরে তা জায়গা করে নিয়েছে বাঙালি শিশুদের মননে।
যেমন ধরা যাক হোস্টেল জীবন। সেখানের সুপার, হোস্টেল বাড়ি, সকলের একসাথে থাকা-খাওয়ার মধ্যে দিয়ে নিম্নবিত্ত বাঙালি জীবনের নানা রোমাঞ্চকর, উদ্ভট, হাস্যকর অভিজ্ঞতার কোলাজ ধরা পড়েছে তার শিল্পকর্মে। এভাবেই গত ষাট বছর ধরে বাঙালি সংস্কৃতি তিনি নির্মাণ করেছেন। তাকে ফুটিয়ে তুলেছেন আঁকায়, পাশাপাশি তিনি একটা করে গল্পও উপহার দিয়েছেন।
আরও পড়ুন-টপ অর্ডারে আজ রানের খোঁজ ভারতের
দুই, ভাবতে অবাক লাগে, ওঁর প্রতিটা গল্পে একটা আশ্চর্য গতি আছে, রোমাঞ্চকর, রোমহর্ষক ঘটনার ঘনঘটা আছে যা অসংখ্য চরিত্রের মধ্যে সংঘাত তৈরি করে। প্রথাগত সাহিত্যে কনফ্লিক্ট থেকে ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছানর যে ধারাপথ, সেটাও তাঁর গল্পে রক্ষিত হয়েছে।
চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমায় যেমন উদ্ভট, হাস্যকর অথচ মানবিক প্রসঙ্গ নিরবিছিন্নভাবে অনবরত ঘটতে থাকে ঠিক তেমনই নারায়ণ দেবনাথের কমিকসেও দৃশ্য ও ঘটনার চমৎকার নানান সব চমক আমাদের চমকিয়ে দিয়েছে বার বার।
তিন, বাঙালি জীবনে সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের প্রভাব পড়েছে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’, ‘নন্টে ফন্টে’, ‘হাঁদা ভোঁদা’-তে। প্রচ্ছন্নভাবে নয়, সুস্পষ্টভাবে।
আরও পড়ুন-টানা দ্বিতীয়বার বর্ষসেরা লেয়নডস্কি
যেমন ‘বাঁটুল দি গ্রেট’-এ দেখা যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বাঁটুল কীভাবে অংশ নিচ্ছে এবং খান সেনাদের সঙ্গে লড়াই করছে। এটাকে শুধুমাত্র মজার গল্প হিসাবে না দেখাই ভালো।
চার, culture studies বা সংস্কৃতি বিদ্যাচর্চা শিক্ষার ভাবনায় পরিসরে একটি নতুন ধারা যার অভিমুখ হচ্ছে, একটি জাতির সংস্কৃতি কীভাবে নির্মিত হয় তা দেখা এবং তা নিয়ে গবেষণা করা। নারায়ণ দেবনাথের কমিকস হচ্ছে সেই সংস্কৃতি বিদ্যাচর্চার আকর। যেখানে আমাদের সমাজ জীবন, সংস্কৃতি, বাঙালির ঈপ্সা কীভাবে পাল্টেছে তার ধারাবিবরণী ধরা আছে।
পাঁচ, নারায়ণ দেবনাথের কমিকসে বানান ভুল কোনওদিন চোখে পড়েনি। এটাও একটা বিস্ময়! এত দীর্ঘদিন ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে যত্ন নিয়ে কাজ করেছেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। শিশুদের বানান শেখানর ক্ষেত্রে গল্পের বইয়ের ভূমিকা পাঠ্য বইয়ের চেয়ে বেশি। বাংলা বানান শেখার ক্ষেত্রে এই কমিকসগুলির একটা বিরাট ভূমিকা আছে।
আরও পড়ুন-নতুন অধিনায়ক নিয়ে জল্পনা, ফিটনেসই সমস্যা,রোহিতে না সানির
পরিতাপের বিষয়, শিশু সাহিত্যকে একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখা দেখা হয় যেন শিশু সাহিত্য একটা লঘু বিষয়। বিষয়টা ঠিক উল্টো। শিশু সাহিত্যের মান অত্যন্ত উঁচু হওয়ার কথা এবং আমাদের সকলের এবিষয়ে যত্নশীল হওয়া কর্তব্য। এখানে স্মর্তব্য, নারায়ণ দেবনাথ যখন কাজ করেছেন তখন কম্পিউটার ছিল না। দীর্ঘসময় ধরে পুরোটা নিজে হাতে লিখেছেন। এঁকেছেন। সেখানে বানান ভুল নেই, অযথা তৎসম শব্দের প্রয়োগ নেই, সাবলীল সহজ সরল বাংলা ভাষার প্রয়োগ আছে। শিল্পের প্রতি এই সামগ্রিক যত্ন অভাবনীয় এবং অবশ্যই শিক্ষণীয়।
ছয়, সারা পৃথিবীতে কমিকস স্ট্রিপ যাঁরা তৈরি করেন তাঁরা তাঁদের নায়ককে নিজস্ব সংস্কৃতি ও জাতির প্রতিনিধি হিসাবে গড়ে তোলেন। নারায়ণ দেবনাথও ব্যতিক্রম নন। তাঁর সৃষ্ট নায়করাও আদ্যোপান্ত বাঙালি।
আরও পড়ুন-স্পেনের হুমকির মুখে এবার জকোভিচ
নারায়ণ দেবনাথকে আমরা সামগ্রিকভাবে আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি। তাঁকে নিয়ে তন্নিষ্ঠ গবেষণাও যে খুব একটা হয়েছে তা কিন্তু নয়। কিন্তু তাঁর সম্পূর্ণ কাজ আমাদের সংস্কৃতি ইতিহাসের অসামান্য দলিল। তিনি চলে গেলেন। বেদনার বিষয়, নারায়ণ দেবনাথের যে সাহিত্যধারা সেই ধারার কোনও সার্থক উত্তরসূরি আমরা কিন্তু এখনও পেলাম না।
আশা করব, বাঙালির সংস্কৃতি নির্মাণে নারায়ণ দেবনাথের গ্রন্থাবলি খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে গৃহীত হবে।