এই সমন্বয়ের জায়গাটাই আরও স্পষ্টভাবে ধরেছেন ড. দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ বইতে। তিনি বলেছেন—“মুসলমানগণ ইরাণ, তুরাণ, প্রভৃতি যে স্থান হইতেই আসুন না কেন, এদেশে আসিয়া সম্পূর্ণরূপে বাঙ্গালী হইয়া পড়িলেন। তাঁহারা হিন্দুপ্রজামণ্ডলী পরিবৃত হইয়া বাস করিতে লাগিলেন। মসজিদের পার্শ্বে দেবমন্দিরের ঘণ্টা বাজিতে লাগিল, মহরম, ঈদ, সবেবরাৎ (শবেবরাত) প্রভৃতির পার্শ্বে দুর্গোৎসব, রাস, দোলোৎসব প্রভৃতি চলিতে লাগিল। রামায়ণ ও মহাভারতের অপূর্ব প্রভাব মুসলমান সম্রাটগণ লক্ষ্য করিলেন। এদিকে দীর্ঘকাল এদেশে বাস-নিবন্ধন বাঙ্গালা তাঁহাদের একরূপ মাতৃভাষা হইয়া পড়িল। হিন্দুদিগের ধর্ম, আচার, ব্যবহার প্রভৃতি জানিবার জন্য তাঁহাদের পরম কৌতূহল হইল…মুসলমান ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণের কৌতূহল নিবৃত্তির জন্যই রাজদ্বারে দীনহীনা বঙ্গভাষার প্রথম আহ্বান পড়িয়াছিল”। বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগের ব্যাপ্তি ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ পর্যন্ত ছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্ (১৪৯৩-১৫১৯)। তাঁর উদার শাসনকালে অমুসলমানেরাও স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ধর্মীয় পরিচয় নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়নি। মন্ত্রী হয়েছিলেন সনাতন ও রূপ দুই ভাই। রাজধানী গৌড়ের শাসক সুবুদ্ধি রায়, গৌড়ের টাকশালের প্রধান হয়েছিলেন অনুপ। সেনাপতি বা সেনাদলের অধিপতির দায়িত্ব পেয়েছিলেন পরাগল খাঁ। ব্যক্তিগত চিকিৎসকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল মুকুন্দ দাসের ওপর। সুলতানের দেহরক্ষী বাহিনীর অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন কেশব রায়।
আরও পড়ুন-পণ্ড ম্যাচ, নাইটদের আকাশ মেঘাচ্ছন্নই
বাংলার স্বাধীন মুসলমান সুলতানেরা বাংলা ভাষার যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেছিলেন। তাঁদের নিরন্তর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎসাহে বাংলা ‘সাহিত্যিক ভাষা’ তৈরি হয়েছিল। সংস্কৃত রামায়ণ ও মহাভারতে প্রথম আকৃষ্ট হয়ে বাংলার সম্রাট নাসির শাহের (১২৮২-১৩২৫) আদেশে মহাভারত বাংলায় অনূদিত হয়। কবি বিদ্যাপতি এই নাসির শাহকে সঙ্গীতে অমর করেছেন। হোসেন শাহ ছিলেন বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক। ভাগবত পুরাণ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করার জন্য তিনিই মালাধর বসুকে নিযুক্ত করেন। হোসেন শাহ গৌড়ে যে মসজিদ তৈরি করেছিলেন, তার উপরে লেখা আছে—“হযরত মুহম্মদ বলেছেন, যদি চীন দেশে যেতে হয়, তবুও জ্ঞানের অনুসরণ করো”। তাই বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, জ্ঞানচর্চার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল যথেষ্ট। হোসেন শাহের সেনাপতি পরাগল খাঁ এবং তাঁর পুত্র ছুটি খাঁ মহাভারতের বাংলা অনুবাদে অক্ষয় কীর্তি রেখে গিয়েছেন। মুসলমান অধিপতি ও শাসনকর্তাদের উৎসাহে বহু সংস্কৃত ও ফারসি গ্রন্থ অনুবাদ করা হয়। কেবল রাজসভায় নয়, সামাজিক স্তরেও হিন্দু-মুসলিম যৌথ সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞান বাংলার নিজস্ব অর্জন। এই সোশ্যাল ফ্যাব্রিকই ভাঙতে চায় বিজেপি।
এই যুক্তসাধনার ছবি সবচেয়ে বেশি প্রকট হয় সাধনকাব্যে। আঠারো-উনিশ শতকের বাংলার সমাজেও এই মুসলমান কবি-রচিত কালীসঙ্গীতের অজস্র প্রমাণ মেলে। কবি বেলায়েৎ হোসেন থাকতেন শিয়ালদহ অঞ্চলে। তিনি ‘কালীপ্রসন্ন’ উপাধি লাভ করেছিলেন। ইনি পেশায় ছিলেন মৌলবী। ১৩১০ বঙ্গাব্দে হরিশ্চন্দ্র দত্ত সরস্বতী তাঁর ‘পরমার্থ-সঙ্গীত-রত্নাকর’ বইয়ের ভূমিকায় লিখেছিলেন— “অস্মদীয় গুণীগ্রগণ্য মহা মহা পণ্ডিতগণ উক্ত মৌলবী মহোদয়কে ভূরি ভূরি প্রশংসা করিয়া থাকেন। এই পরমার্থভাবপূর্ণ পদাবলিগুলি আমাদিগের পুরাকালীন সংস্কৃত অলঙ্কারশাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট প্রসাদগুণে পূর্ণ বলিয়া, পণ্ডিতমণ্ডলীর মধ্যে মৌলবী মহোদয় ‘কালীপ্রসন্ন’ উপাধিতে বিখ্যাত হইয়াছেন। ‘কালীপ্রসন্ন’ অর্থাৎ মহাশক্তির প্রসাদে সুযোগ্য ভাবুক ‘কবি’ মৌলবী বেলায়েৎ হোসেন মহোদয়কে পণ্ডিতেরা এইরূপ নামে সম্বোধন করিয়া থাকেন”। কবির একটি লেখায় এই সমন্বয়ী ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়—
আশ্চর্য্য হইলাম হেরে, পৃথিবীর আচরণ।
নিজ মন্দিরে আছে নাথ, কেহ নাহি তাঁরে চিনে।।
কেহ যায় গয়া কাশী, কেহ দেবালয়ে বসি,
জপে মালা দিবানিশি, কেহ যায় গঙ্গাস্নানে।।
কেহ বা মক্কায় যায়, কেহ বা মসজিদে ধায়,
ঊর্ধ্বমুখে কেহ তায়, ঘনস্বরে বাখানে।।
কালী গানে হয়ে প্রসন্ন, কহে ঠিক ধন্য ধন্য।
ত্রিকুটী যেই জ্ঞানশূন্য, সে জানিবে কেমনে।।
আরও পড়ুন-এক পয়েন্টই অনেক, বলছে কেকেআর
একইভাবে উনিশ শতকে অজস্র বই লিখেছিলেন হিন্দু লেখকেরা, যে বইগুলির বিষয়বস্তু হল—‘রসুল-চরিত’। হজরত মহম্মদের জীবনচরিত বাংলায় ছাপা হচ্ছে ১৮০২ সাল থেকে। ওই বছরেই শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে জনৈক লেখকের ‘মহম্মদের বিবরণ’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। এই ‘রসুলচরিত’ রচনার ধারা অবশ্যই আরও অনেক আগে থেকেই চালু রয়েছে। উনিশ শতকের শেষদিকে হিন্দুরচিত এরকম অনেক বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়—অতুলকৃষ্ণ মিত্রের লেখা ‘ধর্ম্মবীর মহম্মদ’ (১৮৮৫), ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের লেখা ‘মহাপুরুষ মোহাম্মদের জীবনচরিত’ (১৮৮৬), কৃষ্ণকুমার মিত্রের ‘মহম্মদ চরিত ও মুসলমান ধর্ম্মের সংক্ষিপ্ত বিবরণ’ (১৮৮৭), রামপ্রাণ গুপ্তের লেখা ‘হজরত মোহাম্মদ’ (১৯০৪) প্রভৃতি। প্রখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব ‘আলিবাবা’ নাটকের লেখক ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন মুর্শিদাবাদের নিমতিতার জমিদারের। তিনি জানতে পারেন, সেখানে আশেপাশের গ্রামের মুসলমান অধিবাসীরা একটি ধর্মীয় সভা করবেন। ক্ষীরোদপ্রসাদ অন্য সকলের আপত্তি উড়িয়ে সেই সভায় উপস্থিত হওয়ার কথা ঘোষণা করেন। সভাস্থলে গোল বাধে যখন ক্ষীরোদপ্রসাদ বক্তৃতা দিতে ওঠেন। মঞ্চে গিয়ে দাঁড়ান ক্ষীরোদপ্রসাদ। হাতজোড় করে চোখ বুজে প্রথমেই উদাত্ত স্বরে বলেন— “ওঁ নমো ভগবতে মহম্মদায়”। গোটা সভা নির্বাক, নিস্তব্ধ হয়ে যায়। এরপর বিদ্যাবিনোদ, অনেকক্ষণ ধরে শ্রুতি, কুরআন, বাইবেল, গীতা থেকে উদ্ধৃতি তুলে তুলে ধর্মীয় প্রক্রিয়ার মৌলিক সাদৃশ্য দেখান উপস্থিত শ্রোতাদের। গোটা সভার সমস্ত শ্রোতা মুগ্ধ হয়ে যান। ক্ষীরোদপ্রসাদ সেদিন দেখিয়েছিলেন বাংলাদেশে নারায়ণ আর পীর একাকার হয়ে গেছেন এক পরম ‘সত্য’-এ।
এই সামাজিক সমন্বয়ের বুনট ধ্বংস করতে চায় সংঘ পরিবার। বাংলা এদের রুখবেই।