কারুকার্যমণ্ডিত বিশাল রাজসভা। নিমন্ত্রিত রাজপুরুষরা সভা আলো করে বসে আছেন। ভাগদত্ত-কন্যা ভানুমতীর স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করা হয়েছে। প্রাগ দেশের রাজা ছিলেন ভাগদত্ত। তাবড় তাবড় সব বীর রাজা-মহারাজাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তিনি। কলিঙ্গ রাজ্যে তাই সাজ-সাজ রব।
আরও পড়ুন-উপেক্ষিতা বীরাঙ্গনা চারুশীলা
দুর্যোধনদের একশো ভাই, ভীষ্ম, কর্ণ, দ্রোণ, শিশুপাল জরাসন্ধ— কে নেই সেখানে?
‘‘দুর্য্যোধন শত-ভাই ভীষ্ম কর্ণ দ্রোণ।
কলিঙ্গ কামদ মৎস্য পাঞ্চালনন্দন।।
শাল্ব শিশুপাল দন্তবক্র পুরোজিৎ
জয়দ্রথ মদ্র শল্য কৌশল-সহিত
রাজ চক্রবর্ত্তী জরাসন্ধ মহাতেজা
স্বয়ম্বরে গেল আশি সহস্রেক রাজা”।
অস্ত্র-সহ নানা বিদ্যায় এইসব রাজনদের জুড়ি মেলা ভার। সুসজ্জিত সভা আলো করে তাঁরা বসে আছেন। শুধু বসে আছেন বললে ভুল হবে। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন সকলে। কখন ভুবনমোহিনী, রূপবতী রাজকন্যার দেখা পাওয়া যাবে। কেননা ভাগদত্তের কন্যার রূপের খ্যাতি সম্পর্কে তাঁরা অবহিত। তবে শুধু দেখা পাওয়া গেলেই তো হবে না, কার গলায়— কোন ভাগ্যবান রাজপুরুষের গলায় শোভা বর্ধন করবে ঈপ্সিত সেই রত্নহার অর্থাৎ বরমালা। কেননা, স্বয়ম্বরের নিয়মই হল রাজকন্যা নিজের ইচ্ছায় যাকে খুশি নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করবেন।
তবে এইখানে রাজা ভাগদত্ত শুধু স্বয়ম্বর ডেকেই ক্ষান্ত দেননি। তিনি রাজপুরুষদের বীরত্ব, গুণ এবং শৌর্যের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য লক্ষ্যভেদের ব্যবস্থা রেখেছিলেন সেই সভায়।
আরও পড়ুন-খোলা চিঠি
এইমতো মৎস্য-লক্ষ্য উচ্চার্ধ যোজন।
এই ধনুর্ব্বাণে বিন্ধিবেক যেই জন
সেই লভিবেক মম কন্যা ভানুমতী
এত বলি কন্যা আনাইল
অসামান্য রূপবতী ভানুমতীর প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ম্বরসভা যেন আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। পূর্ণচন্দ্রের শোভায় যেন দ্যুতিময় হয়ে উঠেছে সেই সভা। সমস্ত রাজপুরুষেরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন নিজেদের বীরত্ব জাহির করার জন্য। ভানুমতীর রূপের কথা তাঁরা শুনেছেন বটে, কিন্তু চাক্ষুষ করার পর প্রত্যেকেরই বিমোহিত দশা। প্রত্যেকেই মনে মনে ভাবছেন এখনই সেই সময়।
লক্ষ্যভেদ তো করবেনই সঙ্গে অসামান্যা রূপবতী গুণবতী রাজকন্যাকে নিয়ে রাজ্য ফিরবেন।
কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর ঘটে আর-এক। উপস্থিত রাজপুরুষদের বেশিরভাগ রাজাই লক্ষ্যভেদে পরাস্ত হলেন। সমবেতভাবে রাজপুরুষেরা ভাগদত্তের কাছে করজোড়ে অনুরোধ করতে লাগলেন— ‘অন্য কোনও উপায় বলুন রাজন। আজ্ঞা করুন।’ কিন্তু প্রাজ্ঞ রাজা, ভানুমতীর পিতা নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।
বললেন—
‘‘ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র চারিজাতি
যে বিন্ধিবে লক্ষ্য, সে লভিবে ভানুমতী”
এই ভাষা পুনঃ পুনঃ বলিলেন রাজন্ …
আরও পড়ুন-রনিলকে চায় না বিক্ষোভকারীরা, এগিয়ে সাজিথ
তারকাখচিত সেই সভায় মহাতেজি রাজা জরাসন্ধ উপস্থিত ছিলেন। ধনুকে টংকার দিয়ে বাণ ছাড়লেন। কিন্তু সেই বাণ লক্ষ্যে না পৌঁছে চক্রের মধ্যে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তা মাটিতে পড়ে যায়। মহারাজ জরাসন্ধ অত্যন্ত লজ্জিত হন নিজের অপারগতার জন্য। মগধের রাজার এহেন অবস্থা দেখে অন্য রাজারাও কেউ এগিয়ে যেতে সাহস পান না। এদিকে ভাগদত্ত তো বেজায় রেগে গেছেন। তিনি সবার মধ্যে চিৎকার করে বলতে লাগলেন— ‘‘এই যে রথী-মহারথীদের ভিড়ে ভরা এই রাজসভা। এখানে এমন একজনও কি নেই যে লক্ষ্যভেদ করে আমার কন্যাকে জয় করে নিতে পারে? বৃথাই আমার এত আয়োজন!” ভাগদত্তের এই কথা শুনে এবার উঠে দাঁড়ালেন সূর্যের ন্যায় তেজস্বী, অসাধারণ পরাক্রমশালী মহাবীর কর্ণ। আজানুলম্বিত বাম বাহু দিয়ে অবলীলায় ধনুর্বাণ তুলে নিয়ে মাছের চোখ খুঁজে নিয়ে লক্ষ্যে অবিচল থেকে ধনুতে গুণ দিলেন এবং লক্ষ্যভেদ করতে সক্ষম হলেন। ভানুমতী বরমালা নিয়ে ছুটে এলেন। সভা জুড়ে গুঞ্জন চলছে। কিন্তু রাজকন্যা ভানুমতীর চোখ পরাক্রমী ধনুর্ধর বীর কর্ণের দিকে। ক্ষত্রিয় কুলে জন্মের সুবাদে তিনি সুপুরুষ কম দেখেননি। কিন্তু কর্ণের মতো রূপবান তাঁর অদেখাই ছিল। নীলপদ্ম সমান আঁখি, কাঁচা সোনার মতো গাত্রবর্ণ, আজানুবাহু, সুললাটের দুপাশে কৃষ্ণ মেঘবর্ণ কেশরাশি কর্ণের মুখমণ্ডলকে সমৃদ্ধ করেছে।
আরও পড়ুন-রনিলকে চায় না বিক্ষোভকারীরা, এগিয়ে সাজিথ
সর্বসুলক্ষণ গোটা দেহ জুড়ে। এমন দিব্য রূপ দেখে মুগ্ধ ভাগদত্ত-কন্যা। সমস্ত রাজপুরুষের চেয়ে ইনি শ্রেষ্ঠ। বরমালা নিয়ে এগোলেন ভানুমতী। এই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! বহু প্রতীক্ষিত সেই মুহূর্ত। পছন্দের রাজপুরুষের গলায় পরম যত্নে তিনি পরিয়ে দেবেন বরমালা। কিন্তু বিধিবাম! আসলে মহাভারতের ছত্রে ছত্রে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস আর ঐতিহ্যের এক অনবদ্য ঘটনা পরম্পরা। সবশেষে ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ছোট-বড় নানা ঘটনা এবং সুবিশাল পটভূমিকায় মহাভারতের অজস্র চরিত্র জীবনের নানা রূপ নিয়ে আজও ব্যঞ্জনাময়। চিন্তাভাবনা নীতিবোধ, লোভ, দৈব এবং ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ও আমরা বারবার নানা চরিত্রে রূপায়িত হতে দেখেছি। তা না হলে ভাগদত্তের লক্ষ্যভেদের পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হলেও কর্ণ কিন্তু ভানুমতিকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাননি। যে সময় রাজকন্যা ছুটে এলেন কর্ণের সামনে বরমালা হাতে সেই সময়ে জরাসন্ধ বলে উঠলেন— ‘‘দাঁড়াও রাজকন্যে। তোমার উপর কর্ণের অধিকার নেই। কেননা লক্ষ্যভেদের সময় গুণ আমি আগে তুলেছিলাম। আমার গুণ দিয়ে ধনু বিঁধেছে সে। অর্থাৎ লক্ষ্যভেদ করেছে। অতএব আমার তোমার
ওপর অর্ধেক অধিকার বর্তায়।”
আরও পড়ুন-কপ্টার ভেঙে মৃত ১৪
জরাসন্ধের কথা শুনে স্বয়ম্বরসভায় পিন-পতনের নীরবতা। নীরবতা ভঙ্গ হল মেঘমন্দ্রিত কণ্ঠের অধিকারী অসীম বাহুবলী কর্ণের প্রত্যুত্তরে।
‘‘মিথ্যা দ্বন্দ্ব বাড়াবেন না রাজন। ভরা সভায় ধনুর্ধর বীর রাজপুরুষদের সামনে আমি লক্ষ্যভেদে সক্ষম হয়েছি। অতএব আপনার কথার কোনও মানেই হয় না।”
কিন্তু জরাসন্ধ ও কম যান না। তিনি বীভৎস চিৎকার করে শোরগোল ফেললেন সেই সভায়। সভার অন্য রাজাদের উত্তেজিত করে নানা যুক্তি-কুযুক্তি দেওয়ায় সভাস্থ রাজারা জরাসন্ধের মতেই সায় দিলেন। কেননা, রাজারা দেখলেন নিজেরা তো পারেননি কিন্তু এত সহজে কর্ণ রাজকন্যা লাভ করবেন? সেটাই বা হয় কী করে! বাধুক তর্ক-বিতর্ক, দ্বন্দ্ব। লাগুক যুদ্ধ।
আরও পড়ুন-দেশের জাতীয় প্রতীকে বিকৃতি যাচাইয়ের দাবি
রাগে ক্ষোভে এরপর অকুতোভয় কর্ণ বললেন— ঠিক আছে পুনরায় লক্ষ্যস্থির হোক। গুণ টানতে আমি একশোবার রাজি। আবার প্রতিযোগিতা হোক নতুন করে। যিনি জয়ী হবেন তাঁকেই রাজকন্যা ভানুমতী স্বামী হিসাবে সসম্মানে বরণ করে নেবেন। নতুবা দুজনে যুদ্ধ করে দেখি কার শক্তি কত!
‘‘নতুবা আইস দোঁহে করিব সমর, এত বলি ডাকে বীর কর্ণ ধনুর্ধর।”
শুরু হল যুদ্ধ, প্রথমে বাণযুদ্ধ, পরে গদাযুদ্ধ আরও পরে মল্লযুদ্ধ। তিন দিন যুদ্ধ করার পরে শেষমেশ মগধের রাজা জরাসন্ধ পরাজিত হয়ে চলে গেলেন নিজ রাজ্যে।
‘‘হারি অপমান হৈয়া মগধের পতি
আপনার দেশে গেল হইয়া দুঃখমতি।”
আরও পড়ুন-হু-র সতর্কবার্তা
এরপর সূর্যের নন্দন পরাক্রমী বীর কর্ণ ভানুমতীকে জয় করলেন ঠিকই কিন্তু স্ত্রী হিসেবে নিজে গ্রহণ করলেন না।
মহাভারত এমন ছোট-বড় নানান ঘটনা নিয়ে রচিত হয়েছে। কর্ণ মিত্র দুর্যোধনের হাতে তুলে দিলেন ভানুমতীকে। কেননা, কর্ণ স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত থেকে বুঝেছিলেন দুর্যোধনের বিশেষ পছন্দ ভাগদত্ত- কন্যাকে। বন্ধুবৎসল সখার জন্য কর্ণ সবসময় নিবেদিতপ্রাণ। সূর্যপুত্র সবসময় মনে রাখেন যে তাঁর জীবনের এক লজ্জাকর মুহূর্তে এগিয়ে এসে তাঁর সঙ্গে আজীবন সখ্যে নিজেকে বেঁধেছেন সখা দুর্যোধন। তাই তাঁর পছন্দের অগ্রাধিকার সবার আগে।
কিন্তু ভানুমতী? তাঁর মনের খবর কি কেউ রেখেছিলেন? তাঁর পছন্দ-অপছন্দ ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোন মূল্য কি কেউ দিলেন? ঘটনা-পরম্পরায় তিনি নিয়তি বলে মেনে নিয়েছিলেন।
গ্রন্থ-সহায়তা : সুবোধচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত কাশীদাসী মহাভারত।