সদ্য সমাপ্ত পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের ফল নিয়ে নানা চর্চা চলছে। প্রশ্ন উঠেছে, বিজেপি যেভাবে গোবলয়ে তিন রাজ্যে কংগ্রেসকে উড়িয়ে দিয়েছে, সেটা কি বাস্তবের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাচ্ছে? অতীতে পশ্চিমবঙ্গেও এমন হত।
আরও পড়ুন-সাধ্বীর মিথ্যা.চার সুদীপের জবাব
হাটে-বাজারে, ট্রেনে-বাসে, অফিস-কাছারিতে ভোটের আগে মানুষের মুখে মুখে বামফ্রন্ট সরকার-বিরোধী বাক্যবাণের বন্যা বয়ে যেত। অথচ ব্যালট-বাক্স খুললে দেখা যেত, সিপিএমের জয়-জয়কার! সঙ্গত কারণেই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড় বিধানসভা নির্বাচনের ফল নিয়ে বহুজন সমাজ পার্টির নেত্রী মায়বতী-সহ অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। ইঙ্গিতটা ইভিএম মেশিন নিয়ে।
সামনেই লোকসভা নির্বাচন, নরেন্দ্র মোদি অ্যান্ড কোম্পানির মরণবাঁচন প্রশ্ন ছিল এবারের ভোট। বিজেপি স্বাভাবিক কারণেই ছিল বেপরোয়া। জেতার প্রশ্নে যে কোনও অপকর্মেই তারা পিছপা নয়। তাই তথাকথিত ‘গেরুয়া-ঝড়’ নিয়ে প্রবল সন্দেহ জনমনে দানা বেঁধেছে। বিতর্ক চলবে। চলতেই থাকবে। কারণ, নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহদের কাজকর্ম সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীকে কু.কথা, ক.ড়া জবাব তৃণমূলের
সদ্য সমাপ্ত বিধানসভাগুলির নির্বাচনে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। গোবলয়ের তিন রাজ্য মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস আত্মসন্তুষ্টিতে ভুগছিল। ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিকদের তারা ভোটে আসন রফার প্রশ্নে পাত্তাই দিতে চায়নি। অথচ তিন রাজ্যেই দেখা গিয়েছে ভোট ভাগাভাগির কারণে বেশ কিছু আসন জিতে নিয়েছে বিজেপি। অর্থাৎ পদ্মফুল-বিরোধী ভোট এককাট্টা হলে ফলাফল এরকম হতই না।
আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে এই ভোটে। সেটা হল, বামেদের অবস্থা! দেশের রাজনীতিতে সিপিএম-সহ বামেরা যে দ্রুত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে, ভোটের ফলাফল চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিচ্ছে। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরির রাজ্য তেলেঙ্গানায় পার্টির প্রার্থীদের মোট ভোট নোটার চেয়ে কম! এক সময় কমিউনিস্টদের গড় ছিল ওই রাজ্য (অভিবক্ত অন্ধ্রপ্রদেশ)। তেলেঙ্গানায় নোটায় পড়েছে ০.৭২ শতাংশ ভোট। আর সিপিএম প্রার্থীদের মিলিত ভোট ০.৬১ শতাংশ।
আরও পড়ুন-৫৫ হাজার শূন্যপদ, রাজ্য নিয়োগে তৈরি
কালিদাসের মতো যে ডালে বসে আছি, সেই ডালই কাটছি, এই রকম উদাহরণ কংগ্রেসের ইতিহাসে অনেক আছে। এবারও সেই নজিরই কংগ্রেসকে ডুবিয়েছে। কংগ্রেসের ভোট খুব বেশি না কমলেও, ইন্ডিয়া জোটের শরিকদের ভোট কাটাকাটিতে অনেক জায়গাতে তাদের সর্বনাশ হয়েছে। রাজস্থানে চারটি আসনে কংগ্রেস হেরেছে শরিকি লড়াইয়ের জেরে। আরও ৯টি আসনে বিজেপি-বিরোধী ভোট যোগ করলে পদ্মফুলের পরাজয় ছিল নিশ্চিত।
মধ্যপ্রদেশ যেহেতু উত্তরপ্রদেশের লাগোয়া রাজ্য সেহেতু অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টির বেশ কিছুটা প্রভাব আছে। বিশেষ করে চম্বল অঞ্চলে। কিন্তু কংগ্রেস নেতা কমল নাথের জেদের জন্যই সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে শরিকি সমঝোতা হয়নি। ফলে, যা হওয়ার তাই হয়েছে। এমনিতেই গোয়ালিয়র ডিভিশনে সিন্ধিয়া-পরিবারের প্রবল প্রভাব। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া ৫ বছর আগের ভোটে কংগ্রেসে ছিলেন। তখন ওই অঞ্চলে ৩৪টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছিল ২০। কমল নাথের কারণেই কংগ্রেস ছাড়েন মাধবরাও সিন্ধিয়ার পুত্র। এবার হিসাব উল্টে গেছে। কংগ্রেসের গড় ভেঙে বিজেপি দখল করেছে ২৩টি আসন।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের চক্রা.ন্তে ক্ষু.ব্ধ মুখ্যমন্ত্রী, রাহুলের ফোন নেত্রীকে, খুব শীঘ্রই ইন্ডিয়ার বৈঠক
শরিকি বিরোধের নজিরে বিজেপির জিতে যাওয়ার পরিসংখ্যান একাধিক। রাজস্থানে সিপিএমের বিধায়ক হেরেছেন। তাঁর নির্বাচন কেন্দ্র ভাদরা। তিনি বিজেপির কাছে ১ হাজার ১৩২ ভোটে পরাজিত হয়েছেন। ওই কেন্দ্রে আম আদমি পার্টি পেয়েছে ২ হাজার ২৫২ ভোট। রাজস্থানে তিনিটি আসন ছিল সিপিএমের। এবার একটিও জিততে পারেননি তাঁরা। হেরে যাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক অমরা রামও। গোবলয়ে রাজস্থানেই সিপিএমের পায়ের তলায় কিছুটা মাটি ছিল। কিন্তু এবার সেটাও চলে গেল।
তবে তেলেঙ্গানায় বুদ্ধি করে সিপিআই হাত ধরে কংগ্রেসের। তাতে তারা লাভবানই হয়েছে। কোথাগোডেম আসনে পার্টির প্রার্থী প্রায় সাড়ে ছত্রিশ হাজার ভোটে জিতেছে। তবে চার রাজ্য সার্বিকভাবে বামপন্থীদের ফল ভয়ঙ্করভাবে শোচনীয়। ছত্তিশগড়ে মাওবাদী আন্দোলনের কারণে কমিউনিস্টদের প্রভাবের কথা সবারই জানা। সেই রাজ্যেও নোটার চেয়ে কম ভোট পেয়েছে দুই কমিউনিস্ট পার্টি। সিপিএম ০.০৪ এবং সিপিআই ০.৪১ শতাংশ। আর নোটার ভোট ১.২৮ শতাংশ।
আরও পড়ুন-বিশ্বভারতীতে ফিরল রবীন্দ্র নামফলক
কিন্তু চার রাজ্যের মধ্যে হিন্দিবলয়ে ইন্ডিয়া জোটের শরিকি কাজিয়ায় নেপোয় দই মেরেছে। তিনটি রাজ্যে বিজেপি-বিরোধী ঐক্য না হওয়ায় ইন্ডিয়া জোটের শরিকরা সঙ্গত কারণেই দুষছে কংগ্রেসকে। জোটের বড় শরিক হওয়া সত্ত্বেও তারা দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো আচরণ করেছে। রাজনৈতিক মহল মনে করছে, কর্নাটক এবং হিমাচল প্রদেশ নির্বাচনে জিতে কংগ্রেসের মাথাটাই ঘুরে গিয়েছিল। দলের কর্তারা ধরাকে সরা জ্ঞান করছিলেন। আত্মসন্তুষ্টি তাদের পেয়ে বসেছিল। কংগ্রেস ভাবছিল, বিজেপিকে ঠেকাতে তারা একাই কাফি। এমনকী তিন রাজ্যে জয় নিশ্চিত ধরে নিয়ে কংগ্রেস দলপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গেকে লোকসভার ভোটে তারা ‘প্রধানমন্ত্রী’র মুখ করে লড়বে বলেও ঘরোয়াভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। ভাবুন অবস্থা!
চার রাজ্যের ভোটের ফল বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘বিজেপি জেতেনি, কংগ্রেস হেরেছে।’ সেই সঙ্গে বড় দল হিসাবে কংগ্রেসকে জোটধর্ম পালন করতেও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সেই ধর্ম হল, বিজেপি-বিরোধী দলগুলিকে মর্যাদা দেওয়া। সেটা এই নির্বাচনে কংগ্রেস দেয়নি।
আরও পড়ুন-ঘুরে আসুন দুকা ভ্যালি
বরাবর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এটাও বলে আসছেন, ‘বৈঠক নয়, আগে আসন সমঝোতা করতে হবে।’ কেন্দ্রের শাসক দলকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ১৯৭৭ এবং ১৯৮৯ সালে কংগ্রেস বিরোধীদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল সঠিক ঐক্য। প্রথমে জয়প্রকাশ নারায়ণ পরে বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সব দলকে একজোট করেছিলেন জয়প্রকাশ। কার্যত সব আসনে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর দল হালে পানি পায়নি। খড়কুটোর মতো কংগ্রেস উড়ে গিয়েছিল। ১৯৮৯ সালে ৩০০-র মতো লোকসভার আসনে একই ফরমুলা প্রয়োগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ভি পি সিং। রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সেবার পর্যুদস্ত হয়েছিল। এবারও সেই ঐতিহাসিক ক্ষণ উপস্থিত হয়েছে। আসন্ন লোকসভার নির্বাচনে সম্ভব হলে বিজেপির বিরুদ্ধে সব আসনে একের বিরুদ্ধে এক। তা হলেই দেশের শাপমুক্তি হবে!