মোদি–শাহ জমানায় নারী নির্যাতনের হার বেড়েই চলেছে। এই শাসক গোষ্ঠী যে নারী বিদ্বেষী তা উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর উবাচেই ফের স্পষ্ট। লিখছেন আকসা আসিফ
আরও পড়ুন-সিঙ্গাপুরে আন্তর্জাতিক কফি সম্মেলন,বিশ্ব দরবারে ভারতের ২৯
“ আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে।”
মোদি-শাহ শাসিত ভারত ভুমির দিকে তাকালে জীবনানন্দ দাশের ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতার এই পঙক্তিটাই বার বার জলের মতো ঘুরে ঘুরে বুকের গভীরে কথা কয়।
২০১৮-তে আন্তর্জাতিক স্তরে সেই বেইজ্জতির কথা এখনও স্পষ্ট। গণভোটে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষজন অংশ নিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ভারত পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ। ২০২১-এ পৌঁছে মনে হচ্ছে, বিজেপির সৌজন্যে অবস্থার উন্নতি তো দূর অস্ত, আরও অবনতি হয়েছে। জাতীয় মহিলা কমিশন যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে স্পষ্ট বলা হয়েছে একটি ভয়ংকর কথা। গত বছরের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম আট মাসেই মহিলাদের প্রতি অপরাধের অভিযোগ ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
আরও পড়ুন-ভবানীপুরের সিপিআইএম প্রার্থী শ্রীজীবের নামে বাড়ি নেই, কিন্তু ৮ লাখি গাড়ি
ওই সরকারি উপাত্তে আরও প্রকাশ, মহিলাদের প্রতি অপরাধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ সম্ভ্রম নিয়ে বাঁচার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে, এই বিষয়ে। এর পরে আছে পারিবারিক হিংসা, পণপ্রথার জন্য বধূ নির্যাতন ইত্যাদি। আর নারী নির্যাতনের এই তালিকায় ওপরের দিকে জ্বল জ্বল করছে যে তিনটি রাজ্য সেগুলো হল যথাক্রমে উত্তর প্রদেশ, দিল্লি ও হরিয়ানা। প্রথম ও তৃতীয়টি বিজেপি শাসিত। দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন। অর্থ্যাৎ, শুধু বিজেপি জমানাতে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে, তা নয়। বিজেপি যেখানে প্রত্যক্ষ শাসনে, যেখানে ডবল ইঞ্জিনের দৌরাত্ম্য বেশি, সেখানে নারী নির্যাতনের ঘটনাও বেশি। এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ, বিজেপি একটি নারী বিদ্বেষী দল। আর এই তালিকায় এগিয়ে উত্তর প্রদেশ, এটাও অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয়। কারণ, যে রাজ্যে হাথরসের মতো ঘটনা প্রায় রোজই ঘটে চলেছে, যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মনে করেন, মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়া উচিতই নয়, যে রাজ্যে নির্যাতিতাকে সাহায্য করার বদলে তাঁর পরিবারের ওপর হামলা চালানটাই দস্তুর, যে রাজ্যের সংস্কৃতিতে লাভ-জেহাদের ছুতো আর রোমিও স্কোয়াডের রক্তচক্ষুতে নিত্য কম্পিত নারী স্বাধীনতা, সর্বোপরি যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গোরু মহিষ আর মহিলাতে কোনও প্রভেদ দেখেন না, সে রাজ্য যে নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে সেরার সেরা তকমা পাবে, সেটাই স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন-ভারত গণতান্ত্রিক দেশ, আইনের শাসন মেনে চলতে হবে কেন্দ্রকে : সুপ্রিম কোর্ট
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো তাদের পরিবেশিত তথ্যে জানাচ্ছে, ২০১৯-এ সারা দেশে ৪ লক্ষ ৫ হাজার ৮৬১টি নারী নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছিল। ২০১৮-র তুলনায় তা ছিল ৭ শতাংশ বেশি। অর্থ্যাৎ, মোদি-শাহদের সুশাসনের সৌজন্যে কেবল পেট্রল ডিজেলের দাম বাড়ছে না, নারী নির্যাতনও ঊর্ধ্বমুখী। নিম্নমুখী শুধু জিডিপি। এই ৪,০৫,৮৬১টি ঘটনার মধ্যে ১৩ হাজার আক্রমণ ও ৩ হাজার ৪৮৬টি ধর্ষণের ঘটনার শিকার দলিত সম্প্রদায়ের মা-বোনেরা। অর্থ্যাৎ, বিজেপি মেয়েদের তো গোরু-মহিষ ভাবেই, সমাজের প্রান্তিক মেয়েদের আরও অপমানযোগ্য বস্তু বলে মনে করে তাঁরা। তাঁরা যেন আরও সহজলভ্য ও সস্তা, দুর্বল ও প্রতিরোধ ক্ষমতাহীন।
আরও পড়ুন-ত্রিপুরা পুলিশের মিথ্যাচার, কোথায় মিছিল! প্রতিবাদে বিক্ষোভ-ধরনায় তৃণমূল কংগ্রেস
এদেশের মেয়েদের নিরাপত্তা ও ন্যায়প্রাপ্তির সুযোগ যে বিজেপির মধ্যযুগীয় মানসিকতার সুবাদে ক্রমেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে সেটাও ফুটে উঠেছে উল্লিখিত রিপোর্টে। ২০১৯-এ ধর্ষণে অভিযুক্তদের মধ্যে মাত্র ২৭.৮ শতাংশ শাস্তি পেয়েছে। মনে রাখতে হবে, বিজেপি কর্তৃক ‘আচ্ছে দিন’-এর কল্যাণে রোজ এদেশে অন্তত ৮৮টি ধর্ষণের মামলা রুজু হয়।
আরও পড়ুন-সরফারোশি কি তমান্না, গুরুদ্বারে ঘরের মেয়ে
সব মিলিয়ে একটি বিশ্রী চিত্র। অনাকাঙ্ক্ষিত তো বটেই, বরং বলা ভাল, নিন্দার্হ।
কথায় কথায় রামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, সারদাদেবীর মত মানার ও পথে চলার ইঙ্গিত দেন বিজেপি নেতারা। কিন্তু তাঁরা দেখান তো, যে পথে তাঁরা চলছেন ও দেশ চালাচ্ছেন তাতে এঁদের বাণীর চিহ্ন কোথায়? এঁরা কোথায় বলেছেন, মেয়েদের পদে পদে অপমানিত করার কথা? এঁরা কোথায় বলেছেন, মুসলমান আর দলিতকে অনাগরিক করে দিয়ে হিন্দুত্বের ঝান্ডা ওড়ানোর কথা? এঁদের কোন কথা থেকে এই তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীরা সামাজিকভাবে অনগ্রসর, সংখ্যালঘুদের গণপিটুনির শিকার করে তুলছে? এঁদের কোন বাণীর অনুপ্রেরণায় গেরুয়া শাসক ভারতের ২০২১-এ এসে ‘বিশেষ উদ্বেগের কারণ’ তকমা লাগিয়ে দিল? ২০১৮তে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশে’র লজ্জাজনক অভিধায় ভূষিত হয়েছিল সেই ভারত যাকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘জগৎপালিনী জগত্তারিনী জগজ্জননী’ অভিধায় ভূষিত করেছিলেন। আর ২০২১-এ এসে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত প্রতিবেদন সেই ভারতের সম্পর্কে ‘বিশেষ উদ্বেগ’ প্রকাশ করছে যে ভারতবর্ষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, তার সত্য আছে ‘অদ্বৈততত্ত্বে’র জ্ঞানে, ভাবে বিরাজ করছে ‘বিশ্বমৈত্রী’ আর কর্মে দ্যোতিত ‘যোগসাধনা’। সে দেশে ‘আর্যসভ্যতা যেমন সত্য, দ্রাবিড়সভ্যতাও তেমনই সত্য’, সে দেশে ‘হিন্দুও যত বড়, মুসলমানও তার চেয়ে নিতান্ত কম নয়’। ‘স্বদেশী সমাজ’ গ্রন্থে ‘আত্মশক্তি’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “মানুষের সঙ্গে মানুষের আত্মীয়সম্বন্ধস্থাপনই চিরকাল ভারতবর্ষের সর্বপ্রধান চেষ্টা ছিল।” আজকের এই ধ্বস্ত ধ্বান্ত ভারতভূমিতে দাঁড়ালে তিনি টের পেতেন, নব্য ফ্যাসিস্ট শাসককুল সেই ভারতের মনুষ্যপদবাচ্যদের তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলতে চাইছে দলিতকে, মুসলমানকে এবং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে নারীদের। মুখে ‘বেটি পড়াও, বেটি বাঁচাও’ স্লোগান নিয়ে ওরা নেমে পড়েছে ‘বেটি পোড়াও, বেটি পেটাও’ অভিযানে। আমাদের দেশ ক্রমশ অসীম লজ্জা ও অযুত অপমানের ভরকেন্দ্র হয়ে উঠছে স্রেফ এই গেরুয়া শাসকদের অপশাসনে।
আরও পড়ুন-থাকার খরচ দেবে প্রশাসন শুধু আবেদনের অপেক্ষা!
পরিশেষে একটা কথা। শ্রী শ্রী মা সারদা বলেছেন, লজ্জার সঙ্গে নারীকে ঘৃণাও রাখতে হয়। একথার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ ‘চিরন্তনী সারদা’ গ্রন্থে লিখেছেন, সাধারণ অর্থে ঘৃণা বলতে আমারা যা বুঝি, সারদাদেবী এখানে সেই ঘৃণার কথা বলেননি। তাঁর বলা ‘ঘৃণা’র মধ্যে নিহিত আছে ‘বীরত্বের ভাব’। “এই ঘৃণা হল যা আমার আদর্শবিরুদ্ধ, যা আমার ঐতিহ্যবিরুদ্ধ, যা আমার ধর্মবিরুদ্ধ, তার প্রতি সুতীব্র উপেক্ষা বা বিরূপতার ভাব।”
আরও পড়ুন-মাকে খুন করে ঘরের মেঝেতেই পুঁতে দিল ছেলে
ভারতীয় নারীসমাজের সেই ‘ঘৃণা’র আগুনে বিজেপির দহন না হলে ভারতাত্মার অস্তিত্ব, তার অস্মিতা, তার শুভবুদ্ধির বলয়, নিজের শেষ আশ্রয়টুকুও হারাবে।