বিজেপির নবান্ন অভিযানে বিক্ষোভকারীরা সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা, পুলিশের গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া, পুলিশ অফিসারদের আক্রমণ করা, সরকারি আধিকারিকদের আহত করা জখম করা ও কলকাতার রাজপথ অচল করা ইত্যাদি দুষ্কর্ম করে তাকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শান্তিপূর্ণ মিছিল বলতে চাইছেন। এসব ক্ষেত্রে বিরোধীরা যা সচরাচর বলে থাকে, যে এটা পুলিশের প্ররোচনাতেই হয়েছে, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এর আগেও বিজেপির মিছিল থেকে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে অপরাধীদের কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থেকে অন্য রাজ্যের বিজেপি সমর্থকরাও ওই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তারা অশান্তি পাকাতে এসেছিল বলেই মনে হচ্ছে কারণ গণতন্ত্রকে রক্ষার উদ্দেশ্যে প্রতিবেশী রাজ্যের ভাইয়েরা মারমুখী হয়ে উঠেছিল, বিশেষত প্রশাসনিক কর্তাদের টার্গেট করেই। এরকম যে একটা শক্তি প্রদর্শন বিজেপি করবেই তা বোঝা যাচ্ছিল বেশ কয়েকদিন ধরেই। নতুনত্ব হল বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারীর একটি মন্তব্যে।
আরও পড়ুন-শুনেছি প্রতিহিংসাপরায়ণ! তোপের মুখে বিচারপতি
১৪৪ ধারা ভেঙে যখন শুভেন্দুবাবু পিটিএস-এর সামনে আস্ফালন করছিলেন তখন ওই আইন অমান্য করার জন্য পুলিশ গ্রেফতার করতে গেলে তিনি এক জনৈকা মহিলা পুলিশকর্মীকে বলেন, তিনি পুরুষ হওয়ায়, মহিলা কর্মী তাঁকে স্পর্শ করতে পারবেন না এবং ফলত তাঁকে গ্রেফতারও করতে পারবেন না। বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কর্তব্যরত পুলিশ আধিকারিকরা কখনও লাঠি চালান, কখনও জলকামান দাগেন, গ্রেফতারও করে পরে ছেড়ে দেন। একই ভাবে পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের ধস্তাধস্তি চলে, বিরোধীরাও গ্রেফতার এড়াতে এবং তাঁদের কর্মসূচি সফল করতে নানান কৌশল নেন। কিন্তু গ্রেফতারি এড়াতে শুভেন্দুবাবুর এই ন্যারেটিভ প্রথম শোনা গেল। বাংলায় প্রথম এবং ভারতবর্ষেও প্রথম। একেবারে অভিনব।
আরও পড়ুন-শুনেছি প্রতিহিংসাপরায়ণ! তোপের মুখে বিচারপতি
তাকে নিয়ে মিম হয়েছে। অনেকে ট্রোল করেছেন। অনেকে ট্রোল করেছেন। বুকে পোস্টার সেঁটে অনেককে বিধানসভায় দেখা গিয়েছে। অনেকে তির্যক মন্তব্য করেছেন। কেউ বা আবার কয়েক ধাপ এগিয়ে সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন নিয়েও দু’চার কথা বলে ফেলেছেন। শুভেন্দুবাবুও তাঁর মতো যুক্তি দিয়েছেন, শ্লীলতাহানির ঘটনা এড়াতেই তিনি নাকি এরকম বলেছিলেন। কিন্তু এসব সোশ্যাল মিডিয়ার খুনসুটি এড়িয়ে মন্তব্যটিকে একটু বিশদে বিবেচনা করা যাক।
আরও পড়ুন-অপদার্থ কেন্দ্র, আরও বেশি দামি হচ্ছে চাল
আইন ভাঙার কোনও ঘটনা ঘটলে পুলিশ আইপিসি এবং সিআরপিসি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়। এখানে পুলিশের নিজস্ব কিছু পছন্দ বা অপছন্দ থাকে না। অপরাধী রোগা না মোটা, বাংলাভাষী না হিন্দিভাষী, পুরুষ না মহিলা, শিক্ষিত বা পণ্ডিত— এসব বাছবিচার পুলিশ করতে পারে না। ভারতীয় দণ্ডবিধি বা আইপিসি আসলে নারীদের অধিকার সুরক্ষিত করেছে। এটাকে কেউ নারীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বলতে পারেন। যেটা তার আচরণের মধ্যে দিয়ে শুভেন্দুবাবু পরোক্ষভাবে বলতে চেয়েছেন। কিন্তু প্রতিদিন অহরহ ঘটে যাওয়া— ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, অ্যাসিড আক্রমণ বা ভ্রূণহত্যা, পারিবারিক অত্যাচারের থেকে মহিলাদের সুরক্ষা দিতে গেলে আইনে মহিলাদের জন্য কিছু পৃথক সুবিধে দিতে হয়। এটা শুধুমাত্র ভারতে নয়, পৃথিবীর সব সভ্য রাষ্ট্রেই একই নীতি অনুসৃত হয়। ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪, অনুচ্ছেদ ১৫ এবং অনুচ্ছেদ ৩৯(ক)-এ আইনের চোখে সাম্যর কথা বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন-সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার নিয়ে আইন ও রাজনৈতিক মহলে তীব্র বিতর্ক
মহিলাদের উইকার সেক্স বলে অবহেলা করা হয় বলেই। আইপিসি-র প্রভিশনগুলো যেমন ধারা ৩১৩, ৩১৪, ৩০৪(খ), ৩০৬, ৩৫৪, ৩৬৬, ৩৭২, ৩৭৩, ৩৭৬, ৪৯৮(ক), ৫০৯, ৩২৬(ক)-এর মাধ্যমেও মহিলাদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়। এখন শুভেন্দুবাবু বলছেন মহিলাদের যেমন পুরুষ পুলিশকর্মী গ্রেফতার করতে পারেন না, তেমনই তিনি পুরুষ বলে কোনও মহিলা পুলিশকর্মী গ্রেফতার করতে পারবেন না। কিন্তু সিআরপিসিতে মহিলাদের যে বিশেষ সুবিধে দেওয়া হয়েছে, তা পুরুষ নাগরিকদের জন্য দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে আইনে সেই সুযোগ পুরুষরা পান না। তাহলে কি তিনি এই আইনটিকে চ্যালেঞ্জ করছেন? তিনি সাংসদ ছিলেন, বর্তমানে বিধায়ক অর্থাৎ তিনি আইন প্রণেতাদের একজন অর্থাৎ আইনসভার সদস্য। তিনি আইনটি ভাল ভাবে জানেন, তবুও তিনি প্রকাশ্যে এভাবে আইনের স্কোপটিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছেন কেন? তাহলে কি তিনি নারীদের রক্ষাকবচ চান না। তিনি কি নারী বিরোধী? এই সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভের কারণ কি আসলে তাঁর প্রধান বিরোধিতা একজন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বলেই? না হলে এভাবে তিনি ‘সাম্যের’ অপব্যাখ্যা দেবেন কেন?
সিআরপিসি-র নিদান অনুযায়ী কোনও মহিলাকে বিশেষ কারণ ছাড়া সূর্যাস্তর পর থেকে সূর্যোদয়ের মধ্যের অন্তর্বর্তী সময়ে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে না। তাহলে শুভেন্দুবাবু তো এই সুবিধা দাবি করতে পারেন তাঁর নিজের জন্যও। কেরল, কর্নাটক-সহ দক্ষিণ ভারতের পুলিশ পুরুষ অপরাধীদের পোশাক খুলে নেয়, তাদের অন্তর্বাস বা স্বল্প কাপড় পরেই পুলিশের লকআপে রাখে। কারণ হিসাবে বলা হয়, যেকোনও ছুরি বা গোপন আগ্নেয়াস্ত্র তারা পোশাকের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে পারে। অথবা নিজের পোশাক দিয়ে লকআপে আত্মহত্যা করতে পারে। জেল থেকে অন্তর্বাস পরে পালিয়ে গেলে জনগণের হাতেও ধরা পড়ে যাবে। বহু দশক ধরেই এই পুলিশি প্রথা চলে আসছে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও আদালত তা নিষিদ্ধ করেনি বা পুলিশকে কোনওরকম নির্দেশ দেয়নি। আজ শুভেন্দুবাবু যদি দক্ষিণ ভারতে গ্রেফতার হন, তাহলে কি তিনি মহিলা জেলবন্দিদেরও পোশাক খুলে নেওয়ার মতো অসভ্য, বর্বর দাবি করবেন?
আরও পড়ুন-বন্ধ স্কুল খুলতে এবার নতুন নীতি
আসলে বিজেপি হল চরম পুরুষতান্ত্রিক দল। বিলকিস বানোর ধর্ষক ও খুনিদের মুক্তির উল্লাসে পুনরায় যা নির্লজ্জভাবে সামনে এসেছে। হাথরস থেকে আমাদের বাংলাদেশ বর্ডার, বিজেপির হাতে অসুরক্ষিত হয়ে পড়েছে। চলছে গণধর্ষণ। সেই দলের বিরোধী দলনেতাদের কাছে এরকম বিভ্রান্তিমূলক সাম্যের অপব্যাখ্যা আসলে নারীবিদ্বেষী চরিত্রেরই প্রতিফলন।
ওইদিন শুভেন্দুবাবু আসলে দুটি আইন ভেঙেছেন। ১৪৪ ধারা অমান্য করেছেন এবং সিআরপিসি মেনে কাজ করা কর্তব্যরত পুলিশকে স্পর্শ না করার হুমকি দিয়ে আইপিসি-র ৩৫৩ ধারাও ভঙ্গ করেছেন। আইনের চোখে দোষ আদালত বিচার করলেও, শুভেন্দুবাবুর মহিলা সরক্ষণের বিরুদ্ধে ক্ষোভকে জনতা কি বিদ্রুপ করবে না?