বোকাবাক্সের চুম্বক আকর্ষণ সেদিন উপেক্ষা করতে পারিনি। হ্যাঁ টেলিভিশনের কথাই বলছি। তখন পিতৃদেবের দৌলতে আমাদের ঠিকানা ছিল বালিগঞ্জের একটি সরকারি আবাসনে। কলেজ-ফেরতা কফিহাউসে আড্ডাপর্ব সেরে পাড়ার কালিয়ার চায়ের ঠেক ছিল দ্বিতীয় আড্ডাক্ষেত্র। সেই গুলতানিও ডকে উঠতে বসল। কারণ বাবা টিভি কিনেছেন।
সরকারি ইসিআইএল কোম্পানির ইসিটিভি। বিনাপয়সায় দেখা চলবে না। প্রয়োজনীয় লাইসেন্স ফি দিতে হবে। সেসব ব্যবস্থা দ্রুত মিটে গেল বাবার উচ্চপদস্থ আমলা হবার সুবাদে।
পিচবোর্ডের প্যাকিংবক্স খুলতেই বেরোল সেই কাঙ্ক্ষিত বস্তু। বসবার ঘরে স্থাপন করা হল। একটা কাঠের বাক্স। টানা খুলতেই দেখা মিলল টিভির। মূল মনিটর নীল প্লাস্টিক জ্যাকেট দিয়ে ঢাকা। যাতে আলো বিকিরণেও চোখের ক্ষতি না হয়। ঠিক হল তিনতলার ছাদে অ্যান্টেনা লাগানো হবে।
আরও পড়ুন-ভারতীয় টেলিভিশন আজও সাবালক হতে পারল না
অ্যালুমিনিয়ামের পাইপের তৈরি সেই অ্যান্টেনা থেকে তার ঝুলল একতলায়। সংযোগ হল টিভির সঙ্গে। এতেই দৃশ্য-শ্রাব্য তরঙ্গ সরাসরি ঢুকে পড়বে টিভি সেটে। টিভিকে বেশি ভোল্টেজ থেকে বাঁচাতে আরেকটা কানেকশন স্টেবিলাইজারে। সুইচ অন করতেই মনিটরে সমুদ্রের ডেউ-এর মতো শুধুই ঝিরিঝিরি। মেকানিক নব ঘোরাতেই ভেসে উঠল সাতরঙের কালার স্ট্রাইপ। ওটা দিয়ে কালার কারেকশন করা হবে। আজ কোনও প্রোগ্রাম চালু হচ্ছে না। দেখার জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত। এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা৷
ঠাকুমা ছিলেন রেডিওর ভক্ত। অনুরোধের আসর শুনতেন। আর ছিলেন রেডিও নাটকের নিয়মিত শ্রোতা। টিভি আসতেই স্বগতোক্তি করলেন, কী ফুটানি রে বাবা। তবুও কালীঘাটে পুজো দিয়েছিলেন নতুন টিভির জন্য। যন্ত্রটার ওপর জবার মালা চড়ানো হল। আমাদের কৌতূহলও বাড়তে থাকে। যেন তর সয়না কিছুতেই। প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে এল সেই বিশেষ দিনটা, ১৯৭৫ সালের ৯ অগাস্ট। বাঙালির জীবনে আমূল বিপ্লব ঘটিয়ে সূচনা হল টেলিভিশন অনুষ্ঠানের।
আরও পড়ুন-বিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস নিলেন বিডিও
উদ্বোধনে ছিলেন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্ল এবং পশ্চিমবঙ্গের তথ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশে টেলিভিশন সম্প্রচার আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। উপস্থিত ছিলেন সেখানকার ডিরেক্টর জামিল চৌধুরি ও কয়েকজন সংগীত শিল্পী। মাত্র পঞ্চাশ মিনিটের একটি অডিও-ভিস্যুয়াল ফুটেজ নির্মিত হয়েছিল টালিগঞ্জের রাধা স্টুডিওতে। প্রথম যে মুখটি ভেসে ওঠে টিভির পর্দায়, তাঁর নাম শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত। না, আকাশবাণীর মতো ঘোষিকা নন, নতুন নামকরণ হল সংযোজিকা। হাত জোড় করা তাঁর সুকণ্ঠে সবাই শুনলাম, নমস্কার। আজ থেকে কলকাতা টেলিভিশনের যাত্রা শুরু।
অবশ্য ১০ অগাস্ট টিভিতে কোনও ট্রান্সমিশন পাওয়া গেল না। আমরা ধরে নিলাম টিভিসেট গন্ডগোল করছে। আসলে রাধা ফিল্ম স্টুডিওর সঙ্গে ট্রান্সমিটারের সংযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ কারণটা ছিল কলকাতায় প্রবল ঝড়-দুর্যোগ। প্রাকৃতিক বিপর্যয় রুখবে কী করে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ! খবরের কাগজে সমালোচনার ঝড় উঠল। তবে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় গলফগ্রিনে একটি অস্থায়ী স্টুডিও থেকে সংযোগস্থাপন সম্ভব হল সন্ধে সাড়ে ছ’টা নাগাদ। অবশ্যই একটি ওবি ভ্যান থেকে ফের চলমান চিত্রমালায় মজে উঠল মহানগরী। সেই সঙ্গে আমরাও। তখন দিনে মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য সম্প্রচার। তা-ও কলকাতার ভেতরে পঞ্চাশ কিলোমিটারের মধ্যে। দর্শনের সৌভাগ্য শুধুমাত্র তাঁদেরই। ছবিগুলি সাদাকালো হলেও গায়ে যেন একটা নীলচে আভা। অবশ্যই টিভির স্ক্রিন বাঁচাতে প্লাস্টিকের নীল আবরণের জন্য। তাতে কিছু এসে যেত না আমাদের। টিভি তো ঠিকঠাক চলছে।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের দুর্নীতি, রাজ্যের প্রতি বঞ্চনা নিয়ে সমালোচনায় সরব তৃণমূল
কলকাতায় টিভি সম্প্রচার একটু আস্তে-ধীরেই এগিয়েছে। ১৯৩৬ সালে বিবিসি প্রথম টিভি-সম্প্রচার শুরু করলেও ভারতের রাজধানী দিল্লিতে দু-দশক কাটিয়ে ১৯৫৯ সালে ১২ সেপ্টেম্বর একটি মেকসিফট স্টুডিও ও ছোট ট্রান্সমিটার দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে সম্প্রচার শুরু হয়। সহযোগিতা ছিল ইউনেস্কোর। প্রথমে স্কুল শিক্ষা ও পরবর্তীকালে পাঁচ মিনিটের নিউজ বুলেটিন ও কিছু বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান সাইট প্রকল্পের অন্তর্গত হয়। মূল উদ্দেশ্য, ইনস্যাট ১এ উপগ্রহকে কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি এই সম্প্রচারকে নিয়ে আসা এবং আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলির মধ্যে নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। এরপরেই ১৯৭৫ সালের মধ্যে ভারতের সাতটি শহরে চারকোনা ম্যাজিক বাক্স থেকে পারিবারিক বিনোদন অভূতপূর্ব বিপ্লব নিয়ে আসে। কঠিন জীবনে যেন বিশাল প্রাপ্তি। চলমান সাদাকালো ছবির এক অনন্য স্মৃতি।
শহর কলকাতায় এর স্বাদ পেয়েছি একটু দেরি করেই। কিন্তু আমাদের তরুণ কালের টিভিজনিত আবেগ থাকাটা অবাস্তব নয়। চিরাচরিত রেডিও ব্রডকাস্ট থেকে একটা বিশাল লাফ দেওয়া। টিভি থেকে দূরদর্শন— সে এক অন্য ইতিহাস। সেই উন্নয়নের পর্ব সব গ্রাহকই খেয়াল করেছেন। আবাসনে তখন অনেক ফ্ল্যাটেই টিভির আবির্ভাব ঘটেছে। তবে আমাদের ফ্ল্যাট একতলা হওয়ার সুবাদে, লিভিংরুমের বাইরে জানলার গ্রিল ধরে অনেক দর্শক সমাগম হত। লাগোয়া একটা পেয়ারাগাছ বেয়েও অনেককে উঠতে দেখা যেত। পোষ্য জার্মান শেপার্ডের সেই অবাঞ্ছিত ভিড় মোটেই পছন্দের তালিকায় ছিল না। ঘরের ভেতরেও একস্ট্রা চেয়ারের ব্যবস্থা করতে হত। কারণ অনেকেই অনুষ্ঠান দেখতে আসতেন। চা-জলখাবার তো থাকতই সেই সঙ্গে।
আরও পড়ুন-কেন্দ্রের দুর্নীতি, রাজ্যের প্রতি বঞ্চনা নিয়ে সমালোচনায় সরব তৃণমূল
প্রথম ধারাবাহিক দেখেছিলাম টেনিদা। অভিনয় করেছিলেন বিখ্যাত রবি ঘোষ। এরপর জোছন দস্তিদারের ধারাবাহিক তেরো পার্বণ তো সুপার ডুপার হিট। স্টার হয়ে গেলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী কিংবা ইন্দ্রাণী হালদার। বাংলা অনুষ্ঠানের থেকেও বেশি আকর্ষণ ছিল দিল্লি ও বম্বের তৈরি বিভিন্ন সিরিয়াল। কলকাতায় রিলে করা হত বুনিয়াদ, হামলোগ বা পরের দিকে জনপ্রিয় মহাভারত। রবিবার সকালে তো সব কাজ বাদ দিয়ে টিভির সামনে বসে পড়া। সেই সঙ্গে আবেগের ঢেউ। দৃশ্যায়িত সিরিয়ালগুলোর মধ্যে ছিল সংস্কৃতি, ধর্ম ও নীতিবোধের আখ্যান।
টিভির খবর ছিল খবরের কাগজের থেকেও টাটকা। ইংরেজি খবর পড়তেন অধ্যাপক এন বিশ্বনাথন কিংবা লীনা সেন। রুমা চ্যাটার্জিও ছিলেন অনবদ্য। ওঁদের উচ্চারণ শুনে আমরা ঋদ্ধ হতাম। সমৃদ্ধ হতাম। বাবা বলতেন, দেখেছিস! কী নিখুঁত উচ্চারণ। বাংলা সংবাদ পাঠেও নজর কেড়েছিলেন ছন্দা সেন, তরুণ চক্রবর্তী, দেবরাজ রায় বা রমেন পাইন। দর্শকের দরবারে কিংবা সাহিত্য সংস্কৃতি অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল টিভি সম্প্রচারে। সিনেমার আগমন একটু দেরি করে হলেও জনপ্রিয় হতে সময় লাগেনি। কিন্তু হলে বসে বড় স্ক্রিনেই সিনেমা দেখার বেশি মজা ছিল। ঘরে বসেও সুপার এইট মিলিমিটারের হোম প্রোজেকশন দেখেছি। সেও দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। সেই সময় টিভিতে সিনেমা দেখানো হত সপ্তাহে দু-দিন। শনিবার বাংলা আর রবিবার হিন্দি। অনেকেই হা-পিত্যেশ করে থাকতেন এই দিন দুটির জন্য। এ ছাড়া ছিল হিন্দি সিনেমার গান চিত্রহার ও বাংলা সিনেমার গান চিত্রমালা। ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার সরাসরি সম্প্রচার আমাদের ঘরবন্দি করে রাখত।
আরও পড়ুন-আইডল নেইমারের চাপ কমাতে চান ভিনি
অন্যান্য বিনোদনের বাজার রীতিমতো দখল করে নিয়েছিল টিভি সম্প্রচার। এই দৃশ্য ও শ্রাব্যমাধ্যম আমাদের মনকে যেমন আকৃষ্ট করত তেমনি দূর করত নিঃসঙ্গতাকেও। একটা কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। এই সম্প্রচার কিন্তু দেশে জরুরি অবস্থাকালেই আত্মপ্রকাশ করেছিল। সরকারি কার্যক্রমের প্রচার চলত পুরোদমেই। তবু সাদাকালোর এক পশলা শান্তি স্মৃতির ক্যানভাসে এখনও সযত্নে আগলে রেখেছি। বিশ্বজগতের খবর থেকে শুরু করে বিচিত্র বিনোদন সম্ভার— সবই ইলেকট্রনিক বাক্সবন্দি। আমরা সেই সময় অত্যন্ত গতিশীলতার খোঁজে থাকতাম। কখনও বা ক্লান্ত হয়ে উঠতাম কর্মজীবনে প্রবেশের ইঁদুড় দৌড়ে। সেই সাদাকালো টিভিই দু-দণ্ড বিশ্রাম ও আরামের নিশ্চয়তা দান করত।
তবে একটা খারাপ দিকও ছিল। আমাদের তরুণকালে অনেকেই আসক্ত হয়ে পড়ত এই মাধ্যমে। আয়ত্তাধীন নয় এমন সব ভোগ্যপণ্যের প্রতি তীব্র আসক্তি গড়ে উঠত। টিভি দেখার সার্থকতা বা ব্যর্থতা নির্ভর করে নিজস্ব সচেতনতার ওপর। কলকাতা টিভি চ্যানেল জন্মলগ্ন থেকেই সুস্থ সংস্কৃতি ও পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট থেকেছে।
আরও পড়ুন-ব্যক্তিগত ডেটা সুরক্ষা বিল ২০২২ সংবিধান বিরোধী, বলছেন বিশেষজ্ঞরা
রাধা স্টুডিও থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে গলফগ্রিনের নিজের পাকা ঠিকানায়। নামকরণ হয়েছে দূরদর্শন। শুনেছি নামটা নাকি আচার্য সুনীতি চট্টোপাধ্যায় অনুমোদন করেছিলেন। সিগনেচার টিউন পণ্ডিত রবিশংকরের। সাদাকালোয় লাগল রঙের ছোপ। সাদাকালোর দিন পেরিয়ে স্যাটেলাইট যুগে আধুনিক হয়ে উঠল দূরদর্শন। আমাদের এখন আর ঝোড়ো হাওয়ায় অ্যান্টেনা ঠিক করতে ছাদে উঠতে হয় না। কত প্রাইভেট চ্যানেল এসেছে। ভাল না লাগলে রিমোট কন্ট্রোলের সুইচ টিপে অন্য চ্যানেলে চলে যাও। ভাল্ব টিভি কিংবা পিকচারটিউব শব্দগুলো এখন বাতিল। এলইডি বা ফোর-কে প্রযুক্তিও অচল হতে চলল।
আরও পড়ুন-টাকা পাচার রুখতে তৈরি হল টাস্কফোর্স
ইন্টারনেট আসা সত্ত্বেও বর্জন করতে পারি না এই বোকা বাক্সকে। এই দৃশ্যমান যন্ত্রটি নাকি চিন্তা করার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে আমাদের ক্রমে নির্বোধ বানিয়ে ফেলে। কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি সেদিন। এখন আর পিছিয়ে যেতে পারি না সেই যুগে। বিষণ্নতার বোঝা বুকে ধাক্কা মারে। ইসিটিভির কাঠের বাক্সটাকে ধুলো ঝেড়ে সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম। ভেতরের বাতিল টিভিটা হয়তো শিশিবোতলওয়ালার কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছে বহুদিন হল।